করোনায় ভয়াবহ সংকটে পোশাক খাত, এলসি কমেছে ৭০ শতাংশ

  করোনা ভাইরাস
  • মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাসের কারণে ভায়বহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের পোশাক খাত। প্রায় ২ মাস ধরে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি রফতানি বন্ধ থাকায় একদিকে বায়ার হারাচ্ছে অন্যদিকে বিনা পরিশ্রমে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে। তাতে এলসি খোলা কমেছে ৭০ শতাংশ। ফলে প্রতিদিনই হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাত।

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভয়াবহ সংকটের কথা জানিয়েছে আমদানি-রফতানি সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন। বাণিজ্যমন্ত্রণালকে এই তথ্য জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান দ্বিতীয়। তৈরি পোশাক খাতের ৭০-৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমাদনি করা হয় চীন থেকে। প্রায় দুই মাস ধরে চীনের সঙ্গে আমদানি রফতানি বন্ধ থাকায় একদিকে মালিকেরা সেল-বাই অর্ডার হারাচ্ছেন। পাশাপাশি ক্রেতারাও পাশ্ববর্তী দেশে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও ভিয়েতনামে চলে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিচ্ছে। তবে বেশির ভাগ কোম্পানি শ্রকিদের ছুটি দিয়েছে। অর্থাৎ কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ৭০ শতাংশ এলসি খোলা বন্ধ রয়েছে। এক কথায় অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। বড় ধরনের সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে পড়েছে অর্থনীতি।

বিজ্ঞাপন

তৈরি পোশাক মালিকাদের সংগঠন বিজিএমইর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে ৮ মাস ধরে নেগেটিভ অবস্থায় রয়েছে দেশের পোশাক খাত। কারোনাভাইরাসের কারণে নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, আমরা উভয় সংকটে পড়েছি। কাঁচামাল আমদানির জন্য নতুন করে কারো কাছে যেতেও পারছি না। ঠিক কবে চীন থেকে আমদানি করতে পারবো তাও বলতে পারছি না। তিনি বলেন, শুধু পোশাক আর চামড়া খাতই নয় সব খাতে একই অবস্থা বিরাজ করছে।

করোনা ভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর প্রয়োজনীয় উপকরণসহ সব ধরনের শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি হয় চীন থেকে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাক কারখানার মালিকরা। তৈরি পোশাক খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ওভেন সেক্টরে। এ খাতের ৬০ শতাংশ ফেব্রিক্স চীন থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ রয়েছে। তাতে সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।

অপরদিকে নিট ওয়ার খাতের ১৫-২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। এছাড়া নিট এবং ডায়িং খাতের কেমিক্যাল এবং এক্সেসরিজ খাতের আমদানি ৮০-৮৫ শতাংশ চীন থেকে আসে। এক্ষেত্রেও সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা দেখা দিবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের শিল্প উৎপাদন, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, সরবরাহ ব্যবস্থায় ও সেবা খাতে প্রভাব পড়বে। কারণ সরবরাহ ব্যবস্থায় কাঁচামালের সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। এর ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও প্রভাব দেখা দিবে। কাঁচামালের সংকটের কারণে রফতানি খাতেও বিরাট প্রভাব পড়বে। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা অর্থই হচ্ছে সেবা খাতেও সংকট দেখা দিবে। দেশের আর্থিক খাত বিশেষ করে ব্যাংক বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দিবে। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থায় এবং সরকারের রাজস্ব আহরণে প্রভাব পড়বে।

প্রতিবেদনে বিকেএমইএ’র পক্ষ থেকে প্রস্তবনা বলা হয়, দেশের জাতীয় রফতানি আয়ের ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও দেশের পোশাক খাতের ৪৯ শতাংশ অবদান রাখার মাধ্য নিটওয়্যার খাত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যে ভূমিকা রাখেছে। সম্প্রতিক সময়ে চীনের উহান প্রদেশ থেকে সংক্রমিত করোনাভাইরাসের প্রভাব আমাদের নিট পোশাক খাতের উৎপাদনকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।

প্রথমত, দেশের শতভাগ রফতানিকারী বেশির ভাগ নিট উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সাধারণত উৎপাদনের প্রয়োজনীয় মৌলিক কাঁচামাল এল.সি প্রক্রিয়ায় আমদানি করে থাকে। এক্ষেত্রে আমদানি নীতির বাধ্যবাধকতা থাকায় সাধারণত প্রতিষ্ঠানগুলো তিন-চার মাস বা সর্বোচ্চ ছয় মাসের বেশি পরিমাণ কাঁচামাল নিজেদের সংগ্রহ রাখতে পারে না।

জানুয়ারির শুরু থেকে এই ভাইরাসের প্রভাব এবং চীনের নতুন বর্ষ উদযাপন উভয় কারণে দেশের উৎপাদকদের কাছে উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল, কেমিকেলসহ মধ্যবর্তী কাঁচামাল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্রেতার অর্ডার অনুসারে সর্বোচ্চ তিন চার মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের কাছে মজুদকরা কাঁচামাল প্রায় শেষ হবার পথে এবং সে সুযোগে আমদানিকারকরা তাদের কাছে পূর্বের মজুদ করা কাঁচামালের মূল্য ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু ক্রেতার সাথে পূর্বনির্ধারিত মূল্যে পণ্য সরবরাহের চুক্তি বিদ্যমান থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত অন্যান্য দেশগুলোকে কাঁচামাল আমদানির বিকল্প উৎস হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দেখা যাচ্ছে, সেই দেশগুলোও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চীন থেকে আমদানি করা কাঁচামালের উপর সরাসরি নির্ভরশীল এবং চীন থেকে তারা কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না পারায় ও চাহিদার তুলনায় তাদের মজুদের পরিমাণ কম থাকায় প্রত্যেকটি কাঁচামালের মূল্য সেখানেও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

তৃতীয়ত, চীনের সাথে অতি দ্রুত আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে গেলেও দেশের নিট উৎপাদকদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে ২০-২৫ কার্যদিবস লেগে যাবে। ফলে সামগ্রিকভাবে রফতানি কার্যক্রমে আমরা ইতোমধ্যেই প্রায় এক দেড় মাস পিছিয়ে পড়েছি।
এক্ষেত্রে কিছু বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মানবিক কারণকে বিবেচনাধীন রেখে পণ্য গ্রহণ অথবা ডিসকাউন্টের বিষয়াবলিকে এখনো উপস্থাপন না করলেও বেশিরভাগ নিট উৎপাদক প্রতিষ্ঠান পণ্য রফতানিতে বড় ধরনের আশঙ্কায় রয়েছেন। চীন ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে সংক্রমিত করোনা ভাইরাস বছরজুড়ে ঋণাত্মক প্রবণতায় থাকা নিট রফতানিকে সরাসরি প্রভাবিত করছে এবং এর ফলে ছোট ও মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠানসমূহ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।

প্রাথমিকভাবে নিট উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনায় উক্ত বিষয়গুলো উপস্থাপিত হলেও সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এই সংক্রমণের দৃশ্যমান প্রভাব এখন সবাই অনুধাবন করতে পারছেন এবং আশু ভবিষ্যতের দিকে আমরা সবাই তাকিয়ে রয়েছি। যদিও এখানে লক্ষ্যনীয় যে, চীনের উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে পণ্যের অর্ডার দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং উদ্যোক্তারা এ বিষয়ে অনেক আশাবাদী।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি বলছে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে ১৩.৬৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। এর বিপরীতে রফতানি হয়েছে ৮৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। মূলত চীন থেকে থেকে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর উপকরণসহ নানা ধরনের শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি হয়। অন্যদিকে, পোশাক, চামড়াসহ বেশকিছু পণ্য রফতানি হয়। স্ক্রু ড্রাইভার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য ও মসলা পণ্যের সংখ্যা অসংখ্য। খেলনা, প্লাস্টিক পণ্য, খাদ্য থেকে শুরু করে ভারী শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হয় চীন থেকে। আবার রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ, কাঁচামাল, প্রাথমিক পণ্য ও আমদানি হয়। সামগ্রিকভাবে দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশের বেশি আমদানি হয় চীন থেকে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি বলছেন, আরএমজি শিল্পে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে প্রায় ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। পাশাপাশি টেক্সটাইল ও আরএমজি খাতে প্রায় ৪০ শতাংশ মেশিনারি ও যন্ত্রাংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়। দেশের ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন রফতানি আয়ের ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ এই খাত থেকে অর্জিত হয়েছে। উক্ত অর্থবছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১১ দশমিক ৪৯শতাংশ।

এছাড়া অন্যান্য উৎপাদনমূলক শিল্প প্রতিষ্ঠান যেমন- স্টিল, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, ইলেক্ট্রনিক্স, ফুড, ওষুধ ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করা হয়। এমতাবস্থায়, পর্যাপ্ত কাঁচামাল সরবরাহের অভাবে দীর্ঘমেয়াদি শিল্প উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছে। দেশে আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। গত ৮ দিনে এলসি খোলার হার প্রায় ৩৭ শতাংশ কমে গেছে বলে মনে করছে সংগঠনটি। নতুন এলসি খোলার হার কমে যাওয়াতে আগামীতে এই আমদানির পরিমাণ আরো অনেক কমে যাবে। এলসি খোলার হার কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফাতেও ঘাটতি দেখা দিবে।

এগুলোর পাশাপাশি চীনের সাথে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বর্তমান সরকার কর্তৃক চলমান ১ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার ফলে এসব প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দু’টোই বৃদ্ধি পাবার কারণে দেশের অর্থনীতির উপর বাড়তি চাপ পড়বে বলে আশংকা করছে। চীন থেকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও ইকুইপমেন্ট আসতে না থাকলে অবকাঠামো উন্নয়নের এসব প্রকল্পের কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই কর্ণফুলী টানেল-সহ অনেক মেগা প্রকল্প সম্পন্ন করতে দেরি হওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি পাবে। চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার বিকল্প উৎস জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করতে হবে এসব বিকল্প সূত্র থেকে এলসি খোলার মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এই অবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে সমন্বয় বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রলণালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। আমাদের দেশের বাহিরের মিশনগুলোতে আউট সোর্সিং সেল খুলে স্বল্প ও দীর্ঘকালীন যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে আগামী দিনে যাতে আর কখনো ভোগান্তিতে পড়তে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারিভাবে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি।