আজ বেদনার দিনে মিথুনকে নিয়ে গল্প

  • মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শোয়েব মিথুন

শোয়েব মিথুন

মিথুনকে নিয়ে যে কোনো সময়ই লিখতে পারতাম। সেই ২০১০-১১-১২-১৩-১৪-১৫-১৬-১৭'র যে কোনো দিন। সাংবাদিকতা চর্চার সেই সোনাঝড়া সাফল্যের দিনগুলোর যেকোনো দিনই মিথুনকে নিয়ে লেখা যেতো। ওর দারুণ সব ক্যামেরার কাজ নিয়ে লেখা যেতো, কিংবা চাইলে লেখা যেতো ওর সব সুন্দরতা নিয়েও। কিসব কাণ্ডই না করতো ছেলেটা!

লিখিনি একেবারে তেমনও নয়! সহকর্মীদের মধ্যে বর্ষসেরা যারা হতো তাদের নিয়ে লিখতে গিয়ে মিথুনের নাম এসেছে একাধিকবার এবং লিখেছি। কিংবা যারা হতো স্টাফ অব দ্য মান্থ। কিন্তু আজ যে লিখতে বসলাম। সে একবুক কষ্ট বুকে নিয়ে। এমনই একটি সময়ে লিখছি যখন মিথুন আর এই দুনিয়াতেই নেই। ও দেখবে না, জানবে না, পড়তেও পারবে না এই লেখা। সেও এক নিদারুণ কষ্ট।

বিজ্ঞাপন

সেসব সময়ে যারা বর্ষসেরা হতো কিংবা স্টাফ অব দ্য মান্থ- আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত তা গোপন রাখতাম। আর কিছুটা গভীর রাতে যখন সহকর্মীদের সেরা কাজগুলোর প্রশংসা করে লিখতাম, ছবিসহ প্রকাশ হতো সে লেখা- মিথুন মধ্যরাতে ফোন করতো অথবা ম্যাসেঞ্জারে লিখতো। ভুলভাল বাংলায় কিসব লিখতো! আর বকা দিতাম। বলতাম- শুধু ছবি তুলতে পারলেই হবে? লিখতেও জানতে হবে। বলতো- "হ' ভাই ঠিক কইছেন। এরপর থেইকা লিখতে শিখুম।"

মিথুন লিখতে ভালো পারতো না। কিন্তু যখন ও ক্যামেরা হাতে কাজে নামতো তখন এক ভিন্ন লিখিয়েকে আমি খুঁজে পেতাম। ওর তোলা ছবিতেই লেখা হতো অনেক গল্প। আবার অনেক গল্পের জন্য ও তুলতো কত ছবি…বিশেষ করে ওর ছবি তোলা নিয়েই হতে পারে একটা গল্প… সে সব এখন দৃশ্য হয়ে ভেসে উঠছে চোখের সামনে…। সে গল্পটাই লিখছি।

মিথুনকে সাথে নিয়ে যেখানেই যেতাম, কিংবা টিমের সাথে যেখানেই পাঠাতাম- কি পাহাড়ে, কি সমতলে? কিংবা নদীতে, হাওড়ে, বিলে কিংবা ঝর্নায়, বিপুল জনসভায় কিংবা উত্তাল মিছিলে! হাটে মাঠে বাজারে কিংবা কোনো অনুষ্ঠান-পার্বনে। মিথুন দলে থাকলে একটা ভরসা পেতাম। সাংবাদিকতায় রিপোর্টার ও ফটোসাংবাদিকের মধ্যে যে একটা সিনক্রোনাইজেশন দরকার হয়, সেটা মিথুনের সাথে সকলেরই খুব হতো। আমার সাথেই কেবল নয়, অন্য সকলের সাথেই হতো। সত্যি কথা বলতে কি দীর্ঘ ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় সকল ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কাজ করেছি সকলের সাথেই এই সন্তুষ্টিটা পেয়েছি। কিন্তু মিথুন একটু ব্যতিক্রমই ছিলো।

হুটহাট ক্লিক করাও ছিল মিথুনের অভ্যাস, স্টেডিয়ামে খেলা চলাকালীন তোলা ছবি

মিথুনকে নিয়ে স্পট থেকে ফিরে কখনোই এটা মনে হয়নি, লেখার সঙ্গে মিলিয়ে ছবি পাওয়া যাচ্ছে না। খবরের ছবি ও যেমন মোক্ষমটা তুলতে পারতো, তেমনি ফুল-পাতা-নদী-পাখিও ও তুলতো ঠিক লেখার জন্য যেমনটা প্রয়োজন তেমনটা।

মিথুন আমার সহকর্মী ছিলো বাংলানিউজে। আমরা সাতটি বছর একসাথে কাজ করেছি। ওকে নিয়ে অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার মধ্যেও একটা বিনোদন মিশে থাকতো। কি যে এক প্রাণবন্ত মানুষ। আর কর্মঠ। আর নিজের কাজের প্রতি শতভাগ নিয়োজিত।

দলগত কাজগুলোতে মজাটা বেশি হতো। কোথাও গেছি- পদ্মাসেতুর রিপোর্টিংয়ে কিংবা কোথাও কোনো জনসভায়। হঠাৎ দেখি মিথুন নেই আসে পাশে। এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়তো দেখতাম- উঠে গেছে কোনো গাছে কিংবা কোনো বাড়ির ছাদে। কিংবা সেতুর কোনো ক্রেনের উপর চড়ে বসেছে। ফিরে এসে বলতো- ভাই দুইটা লং শট নিয়ে রাখলাম। কাজে লাগবে। একটু আগে হাতের কাছে না পেয়ে বিরক্ত আমি নিমিষেই গলে যেতাম। পিঠ চাপড়ে দিলে বলতো- ভাই মাথায় হাত দিয়ে একটু দোয়া করে দেন। 'যা দিলাম'- এই বলে মাথায় হাত দিয়ে তবেই রেহাই পেতাম।

কিংবা কখনো হঠাৎ হঠাৎ দল থেকে ছিটকে যেতো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ক্যামেরার স্ক্রিন থেকে সদ্য তোলা ছবিগুলো দেখিয়ে বলতো- 'ভাই দেখেন, কয়েকটা এক্সক্লুসিভ মেরে দিলাম।' কথার কি ছিরি! কিন্তু ছবিগুলো হতো সত্যিই সেরা।

এসব কারণেই মিথুনকে আমি ভালোবাসতাম। তাই মাঝে মধ্যে যখন বাইরে কোনো দলগত কাজের টিম সাজাতাম, মিথুনের নাম দিতাম। আর এটাও ছিলো বড় ন্যাওটা। ভাই আমারে নিয়েন, আমারে নিয়েন। ঘ্যান ঘ্যান করতো। আমি নিলে এডিটর ইন চিফ আলমগীর ভাই ধমক দিতেন, মিথ্যা রাগ দেখিয়ে মিথুনের নাম কেটে দিতেন। বলতেন ও বাদ। কিন্তু এরপর মিথুন ঠিক এমন কিছু একটা করতো বা বলতো যে সবাই হেসে দিতাম। আর এডিটর ইন চিফ ঠিক মিথুনকেও রাখতেন টিমে। কারণ তিনিও জানতেন, ও গেলে ভালো কিছু আসবে।

বাংলানিউজে আমাদের ফটোসাংবাদিক টিমে সদস্য সংখ্যা ১৩-১৪-১৫'য় ওঠানামা করতো। এদের সকলেই ছিলো নিবেদিতপ্রাণ। তাদের সকলেই মিথুনের মতো। আজ শুধু মিথুনের কথা বলছি- তাই আশা করি অন্য কেউ মনোকষ্ট পাবে না।

তবে এটাও সত্য মিথুনের একটি গুন ছিলো সত্যিই বিরল। যা ছিলো না আর কারো মধ্যে অতটা। ও ছিলো হাস্যোচ্ছ্বল এক তরুণ। হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখা এক প্রাণবন্ত মানুষ।

ভালো ছবি তুললেই তার আবদারটাও বেড়ে যেতো। একবার পদ্মাসেতু রিপোর্টিংয়ে গেছি ৭-৮ জনের টিম নিয়ে। তখন ইলিশের মওসুমও নয়, কিন্তু মিথুনের দাবি- ভাই দুপুরের খাবারে ইলিশ চাই। বললাম এখন ইলিশ পাবি কোথায়? কিন্তু সে নাছোরবান্দা। অবশেষে অনেক খুঁজে-পেতে দীর্ঘপথ হেঁটে পুরোনো ঘাটের কাছে এক দোকানে ইলিশ ভাত খাওয়াতে হলো। এমনই ছিলো মিথুন।

মিথুনের এতক্ষণের গল্পে আপনারা হতো জানতেই পারলেন না, ও মূলত স্পোর্টস ফটোসাংবাদিক ছিলো। ক্যামেরাখানা ছিলো রীতিমতো এক কামান। যতদূর মনে পড়ে আলমগীর ভাই সাড়ে সাত লাখ টাকা দিয়ে লেটেস্ট মডেলটাই কিনে দিয়েছিলেন। বিশাল লম্বা লেন্স। আর সবমিলিয়ে ক্যামেরা ব্যাগের ওজন ২০ কেজির কম নয়। এই নিয়ে ছুটতো ক্রিকেট গ্রাউন্ডের এদিক থেকে ওদিক। কিংবা কখনো, মাঠে শুয়ে পড়ে, লেন্সে চোখ রেখে নিশ্চুপ অপেক্ষায় থাকতো একটি সেরা অ্যাকশন ছবি তোলার জন্য। পেয়েও যেতো। আর যদি নাও পেতো, ছবি বানিয়ে নেবার তরিকাও তার জানা ছিলো। ক্রিকেটারদের সে চিনতো, ক্রিকেটাররাও তাকে চিনতো। এই চিন-পরিচয়ের একটা সুবিধা মিথুন ঠিক বের করে আনতো।

মিথুনের সাথে সাত বছরের কর্মজীবনে ওর সাথে আমার সকল স্মৃতিই আনন্দের, ভালোলাগার ও মুগ্ধতার। কিন্তু আজ মিথুনের সঙ্গে যে স্মৃতির অবতারণা হলো- তা স্রেফ বেদনার, কষ্টের আর মন খারাপের।

মিথুন আর আমাদের মাঝে নেই। মরণঘাতি ক্যান্সারে ভুগে মিথুন চলে গেছে পরপারে। পৃথিবীর মায়া ও ত্যাগ করে গেছে। কিন্তু ওর মায়া আমরা ভুলতে পারছি না। না আমি, না আলমগীর ভাই, না কেউ, যারা আমরা ওর সহকর্মী ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে জাকিয়া ফোন করে কাঁদলো। ফেসবুকের পোস্টে দেখছি সকল সহকর্মীর সে কি প্রাণের আকুতি।

ত্রিশের কোটাও পার করেনি মিথুন! কিন্তু ওকে পৃথিবী থেকে তুলে নিলেন সর্বশক্তিমান। পেছনে পড়ে রইলো ওর পাঁচ বছরের মেয়েটি। ওর স্ত্রী। মেয়েটি হতো বুঝলোই না, কাকে হারিয়েছে সে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি- মিথুনকে হারিয়েছি আমরা। একটি প্রাণবন্ত মানুষকে হারিয়েছি। একজন সহকর্মীকে হারিয়েছি, যার সকল স্মৃতি আমাদের কাছে আনন্দের।

মিথুন, তুই বেঁচে থাকবি আমাদের স্মৃতিতে। শুধু তুই ভালো থাকিস। যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।