করোনা: ৮০ লাখ আক্রান্তের বিশ্বে আমাদের করণীয়
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসকরোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি আকারে ছড়িয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ লাখ অতিক্রম করেছে। মারা গেছে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ।
চীনে উদ্ভূত হলেও ভাইরাসের হামলায় ক্ষতির শীর্ষ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। হটস্পট হিসেবে এসেছে ব্রাজিলের নাম। পেছনে আছে রাশিয়া, ভারত। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ক্রমবর্ধমান।
বিশ্বের প্রায়-সকল দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অনেকেই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে কমিয়ে রেখেছে ক্ষতির হার। তথাপি বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের ধারা মোটেও থেমে নেই। ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ছয় মাসে ৮০ লাখ মানুষকে আক্রান্তকারী করোনাভাইরাস যে অচীরেই নির্মূল হবেনা, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন।
কেউ জানেনা, কত লাখ মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্তের পর থামবে মানব-ইতিহাসের এই ভয়াবহতম মহামারির তাণ্ডব। ফলে এই মারাত্মক ও ক্রমবর্ধমান বিপদের মধ্যেই মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য করণীয় নির্ধারণের সবাই সচেষ্ট।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, মৃত্যু ও আক্রান্তের ক্ষতি ছাড়াও করোনা আবির্ভাবের পর পরই নানা ধরনের পরিবর্তন এনেছে সারা বিশ্বের সকল সমাজের মানুষের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে। প্রাত্যহিক জীবনের পাশাপাশি শিক্ষা, পর্যটন, ব্যবসা, বাণিজ্য, অর্থনীতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই করোনার আঘাতজনিত পরিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের পরিসরে। সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন, ঘরবন্দী ইত্যাদি দমবন্ধ বিষয়ের সঙ্গে করোনাকালে পরিচিত হয়েছে মুক্ত মানুষ। করোনার আগের আর পরের জীবনের যাপন প্রণালীতে এসেছে বিরাট পালাবদল।
মানুষের জীবনকে বিপন্ন ও রূপান্তরকারী করোনা আদৌ দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, হলেও কতদিন হবে, এর প্রভাব আরো কত গভীর ও সুদূরপ্রসারী হবে, এসব প্রশ্ন এখন সমগ্র বিশ্ববাসীর মুখে মুখে। যদিও এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, তথাপি করোনার বিপদের মধ্যেও একটি সুফল সকলের নজরে এসেছে। তথ্য-পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, করোনার কারণে সতর্ক ও সীমাবদ্ধ মানুষের জীবনে সাধারণ অসুখবিসুখের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কমেছে দৈনন্দিনতায় বাতাস, পানি ও জীবাণুবাহিত রোগ, খাদ্যে বিষক্রিয়া, চর্মরোগ, ফুসফুসের সমস্যার মতো অসুখ।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, লকডাউনজনিত গৃহবন্দিত্বই এই রোগহ্রাসের অন্যতম কারণ। তদুপরি, করোনা সংক্রমণের ভয়ে সাধারণ রোগী স্বাস্থ্যবিধি মানছেন, মহাবিপদ হলেও চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে সতর্ক থাকছেন। ফলে ভয়ঙ্কর করোনার সামনে নিত্যদিনের অন্য রোগগুলো কমে গেছে।
এই চিত্র জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে গুণবাচক হলেও করোনার বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন অনন্ত কাল চলবে না। মানুষের পেশাগত ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও দীর্ঘ দিন স্তব্ধ থাকতে পারবেনা। রুটি-রুজির প্রয়োজনে মানুষকে ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করতেই হবে।
ফলে এইসব তথ্যে আকৃষ্ট না হয়ে বিশ্বব্যাপী সবাই করেনাকালীন বা করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটিকে অত্যন্ত গুরুতর মনে করছেন এবং বর্তমানের সঙ্কুল ও ভবিষ্যতের বিপন্ন পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েই বিশ্ববাসী বিশেষভাবে চিন্তিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনায় ভীতির মধ্যে বেঁচে থাকার করণীয় নির্ধারণ করতে হবে সম্মিলিতভাবে সরকার ও নাগরিক সমাজকে। একদিকে সরকারকে আশু ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে উপযুক্ত নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, অন্যদিকে নাগরিকদের স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়টি দৈনন্দিনতার অঙ্গে পরিণত করতে হবে।
সরকারের চলমান স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য কাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার সমান্তরালে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বাধিক সচেতন হতে হবে। মাস্ক পরিধান করা, বারংবার হাত পরিস্কার করার মতো অভ্যাসগুলো বর্তমানের মতো আগামী দিনেও মেনে চলতে হবে। এতে করোনার পাশাপাশি অন্যান্য রোগের বিপদও কমবে।
একটি স্বাস্থ্যবার্তা সবাইকেই মনে রাখতে হবে যে, চিকিৎসকদের মতে, ব্যক্তিগত-নাগরিক জীবনের অধিকাংশ অসুখই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের পরিণতি। করোনার মহামারি এ কথাটিকে আবার প্রমাণ করেছে। করোনাভাইরাস না এলে হয়তো এই উপলব্ধি আসত না যে, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন সত্যিই রোগব্যাধিকে দূরে রাখতে পারে।
বস্তুত, মহামারি রোধ করতে যে পরামর্শগুলো বিশ্বব্যাপী দেয়া হয়েছে, তাতে নতুনত্ব কিছু না থাকলেও আছে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের তাগিদ। টাটকা খাদ্যগ্রহণ, খাবার আগে হাত পরিষ্কার করা, থুতু না ফেলা, বাইরের পরিধেয় ব্যবহারের পর প্রতি দিন ধৌত করা, জুতা ঘরের বাইরে রাখা ইত্যাদিকে এককালে সাধারণ স্বাস্থ্যজ্ঞান বা ব্যক্তিগত সচেতনতা বা কাণ্ডজ্ঞান বলা হতো।
একবিংশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক অতি অগ্রসর ব্যস্ত জীবন সেসব প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকে বিস্মৃত করেছিল। করোনার বিরুদ্ধে সেসব স্বাস্থ্য শিক্ষামূলক চর্চাকে পুনরায় স্মরণ ও পালন করেই বেঁচে থাকার জরুরি করণীয় হিসেবে গণ্য করতে হবে।