বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সমন্বয়হীনতা!
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসকরোনাভাইরাস/কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি আকারে মাত্র ছয় মাসে কোটির বেশি মানুষকে আক্রান্ত ও ছয় লাখ মানুষের মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানোর পটভূমিতে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। সংস্থার পক্ষেও জবাব দিয়ে দায়ী করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। এতে মহামারি পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে বিশ্বে বিরাজমান সমন্বয়হীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে।
তোপের মুখে থাকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবচেয়ে বড় সমালোচক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সংক্রমণ-তালিকায় শীর্ষ স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ১ লক্ষ ৪০ হাজার নাগরিকের মৃত্যুতে দিশেহারা।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আক্রান্ত ও প্রাণহানির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সেদেশের সংবাদ সংস্থাগুলোর একাংশের মত, এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। অন্যদিকে, একটি মার্কিন দৈনিকে হু-র উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখেছিলেন ২৩৯ জন বিজ্ঞানী। তাঁরা দাবি তোলেন, হু তাদের নির্দেশিকায় কোভিড-১৯-কে বায়ুবাহিত রোগ হিসেবে উল্লেখ করুক। এর পরে চাপের মুখে দিন দুয়েকের মাথায় হু নির্দেশিকা পরিবর্তন করে জানায়, সম্পূর্ণ ভাবে বায়ুবাহিত না-হলেও বদ্ধ ঘরের হাওয়ায় ছড়াতে পারে ভাইরাসটি।
হু-এর এ ভাবে মতবদল নতুন নয়। গোড়ার দিকে তারা বলেছিল, সব সময় মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই। পরে নিজেরাই সমস্ত দেশের সরকারকে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে জোর দিতে থাকে।
একটি মার্কিন দৈনিকে লেখা হয়েছে: ‘সংক্রমণ রুখতে মুখে মাস্ক পরা উচিত না অনুচিত, এ নিয়ে স্পষ্ট করে বার্তা দিতে পারেনি হু। তারা এক সময়ে বলেছিল, অসুস্থ হলে তবেই মাস্ক পরুন। হু-এর এ ধরনের বার্তাতেই এত ধন্দ ছড়িয়েছে বিশ্ব জুড়ে।’
তবে শুধু হু নয়, জনসাধারণকে সন্দিহান করার পিছনে রাষ্ট্রনেতাদের ভূমিকাও কম নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই মাস্ক-বিরোধী। পারস্পরিক দূরত্বের প্রয়োজনীতাও মানতে বাধ্য নন তিনি।
হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো, যার দেশ চরমভাবে আক্রান্ত। সাংবাদিক বৈঠকে এসে মাস্ক খুলে জানিয়েছিলেন, তিনি কোভিড-পজ়িটিভ। সংবাদ সংস্থাগুলি তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে। তারপর ফের পরীক্ষা হয় ৬৫ বছর বয়সি বোলসোনারোর। আবার পজ়িটিভ রিপোর্ট। চিকিৎসকেরা তাঁকে ঝুঁকির তালিকায় রেখেছেন। ব্রাসিলিয়ায় সরকারি বাসভবনে কোয়রান্টিন আছেন তিনি অবশেষে।
অথচ সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে। আক্রান্তের সংখ্যা অনুযায়ী দ্বিতীয় স্থানে ব্রাজিল, পাঁচে পেরু, ছয়ে চিলি, সাতে মেক্সিকো। ব্রাজিল মৃত্যুতেও দ্বিতীয়। সাড়ে ৭৫ হাজার ব্রাজিলীয় মারা গিয়েছেন ইতিমধ্যেই। মৃতের সংখ্যায় ইটালিকে ছাপিয়ে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে মেক্সিকো। ৩৭ হাজার ছুঁইছুঁই মারা গিয়েছেন এ দেশে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে সম্প্রতি বলতে শোনা গিয়েছে, ‘বাড়িতেই থাকতেই হবে এমন নয়, বরং সতর্ক থাকুন।’ তবে, মৃতের সংখ্যার নিরিখে ব্রিটেন তৃতীয়, যেখানে ৪৫ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে। এখন অবশ্য খোদ ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক মাস্ক-পরার গুরুত্ব বোঝাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।
ইউরোপের কোথাও কোথাও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী দোকান-বাজারে গেলে মাস্ক পরতে হবে। তবে পাব কিংবা অফিসে মাস্ক পরার দরকার নেই। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে য , এই ফারাকের কারণ কী? বাজারের জন্য এক নিয়ম আর অফিসের জন্য অন্য নিয়ম কেন, জবাব দিতে পারেননি কর্তৃপক্ষ।
নানা দেশের সরকার প্রধানদের হটকারিতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে হু অবশ্য বলেছে, সব দায়িত্ব তাদের নয়। তাদের একার পক্ষে সারা বিশ্বের মহামারি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। স্ব স্ব দেশগুলোকে পরিস্থিতি অনুযায়ী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনে যখন প্রতিনিয়ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যকার মুখোমুখি-সমালোচনামূলক অবস্থান চরম সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত বহন করছে। একাধিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি চিহ্নিত করেছে 'দুঃখজনক' ও 'ক্ষতিকর' তৎপরতা হিসেবে। তারা মনে করে, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সমন্বয়হীনতা বৈশ্বিক মহামারির বিপদ আরো বাড়াবে।
বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে যখন প্রয়োজন বৈশ্বিক ঐক্য ও সমন্বয়, তখন বৈশ্বিক সমন্বয়হীনতার ঘটনা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতার প্রমাণবহ। তাদের অপরিণামদর্শিতা বিশ্ববাসীকে প্রাণঘাতী ভাইরাসের আক্রমণের মুখে আরো বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত করবে।