করোনার বিরুদ্ধে লড়তে চীনকে অনুসরণ করবে বাংলাদেশ!
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসমাস দুয়েক আগেও চীনে আতঙ্কের নাম ছিল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। প্রতিদিন হাজারো মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। দেশটি বিরূপ এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কা ছিল। কিন্তু মাত্র দুই মাসের মধ্যেই চীন করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে। কমে এসেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।
বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক ছাড়াই এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম হয়েছে চীন। কিন্তু কীভাবে চীন এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সেটি খুঁজতে গেলে যা আসে সেটি হলো— ব্যাপক সচেতনতা, সামাজিক দূরত্ব তৈরি ও ইতিবাচক খবর প্রকাশ করা।
চীনের বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম ধাপ হলো— ইতিবাচক খবর পরিবেশন করা। মাস দুয়েক আগেও চীনের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো করোনা থেকে কত বেশি মানুষ সুস্থ হচ্ছেন তার খবর ফলাও করে প্রকাশ করেছেন। মোটকথা মানুষের মনোবল ভেঙে না ফেলা। এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর সমালোচনা করে চীনের বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছেন সংবাদমাধ্যমগুলো। কী উপায়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় কিংবা কীভাবে ব্যাপক জনসচেনতা তৈরি করা যায় সেটি নিয়ে সংবাদমাধ্যম ফলাও করছে না। বরং মানুষের মধ্যে মৃত্যুভয়ের জন্ম দিচ্ছেন তারা।
বিশ্বের ভীষণ সংকটকালীন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে গণমাধ্যম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যমের দায়িত্ব মানুষকে এ ভাইরাস মোকাবিলায় সচেতনতামূলক খবর পরিবেশন করা। একইসঙ্গে প্রশ্ন আসে জনবহুল দেশগুলো কীভাবে এ ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে। এর ধারাবাহিকতায় চীনের হুবেই প্রদেশের উহান, বেইজিং, সাংহাই, সেনজেন শহরের নাম উঠে এসেছে। শীর্ষ বাণিজ্যিক এ শহরগুলোতে রাতারাতি এ ভাইরাস মোকাবিলা করা কঠিন ছিল। এজন্য চীন সরকার সকল প্রকার অফিস কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তার পরিবর্তে বাড়ি থেকে অফিস করার কথা বলেন। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য অনলাইনভিত্তিক শপের কথা বলা হয়। পাশাপাশি সকল প্রকার বিয়ে, পার্টিসহ জনসমাগমস্থল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ কার্যক্রমের শেষ ধাপ ছিল— গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া। এর মাধ্যমে এ ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।
চীনের বিশ্লেষকরা যেটির ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি হলো— ব্যক্তি সচেতনতা তৈরি করা। নিজেকে ও কাছের মানুষকে বোঝানো। জ্বর, সর্দি-কাশি হলে নিজে থেকে সঙ্গরোধে থাকা বা আইসোলেশনে চলে যাওয়া। এজন্য প্রতিটি মানুষকে দায়িত্ব পালন করার কথা বলা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ছোঁয়াচে রোগ মোকাবিলায় ধর্মীয় স্বার্থে হলেও জনসমাগমস্থল পরিহার করতে হবে। সভা-সমাবেশ থেকে এ ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যা স্বল্পউন্নত দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে মসজিদে নামাজ আদায় ছাড়াও চার্চ ও মন্দির প্রার্থনার জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এর পরের ধাপে চীনের বেশকয়েকটি শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। অর্থাৎ হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবা ছাড়া মোটামুটি সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা। এর মধ্যে যৌক্তিক কারণ ছাড়া ঘরের বাইরে গেলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গরোধে পাঠানো হয়। এ ভাইরাস নির্মূলে এখন একটি মাত্র পথ খোলা আছে বলেই জানাচ্ছেন গবেষকরা। যা চীনা সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে— প্রতিটি মানুষকে যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। প্রতিকারের উপায় হিসেবে এখনই আইসোলেশনে চলে যেতে হবে। যাতে নিজের মধ্যে এ ভাইরাস থাকলে যেন অন্যস্থানে না ছড়াতে পারে এবং অন্য কারো থেকে নিজে না সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে বাঁচা যায়।
হাসপাতালের প্রতিটি ডাক্তার-নার্স ও কর্মীরা এমন অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করতে সক্ষম বলেও জানায় সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট। এমনকি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। এজন্য এ ভাইরাস মোকাবিলায় ডাক্তার ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করে প্রশাসনকে এগিয়ে আশার আহ্বান জানানো হয়।
বিশ্বের স্বল্পউন্নত জনবহুল দেশগুলো এ ভাইরাস মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়—এমনটিই বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তাই এখনই সেসব দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপকহারে প্রচার-প্রচারণা চালানোর ওপর জোর দিচ্ছে ডব্লিউএইচও। এ ভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করার আগেই সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আশার আহ্বান জানানো হয়।
‘প্রতিষেধক আবিষ্কার একমাত্র বাঁচার পথ নয়’— উল্লেখ করে গবেষকরা বলছেন, সবার আগে জরুরি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ সীমিত আকারে নিয়ে আসা। সবচেয়ে উপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে বাড়ি থেকে অফিস কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। নিজে বেঁচে থাকা নয়, বরং দেশের অনভিজ্ঞ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সরকারের উচিত জনগণকে সঠিক তথ্য দেওয়া। যেটি সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলেও জানিয়েছেন তারা। তথ্য গোপন না করে এর ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরা এবং মানুষকে যত দ্রুত সম্ভব জানানো সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। এতে ভুল সংবাদের প্রচার কমবে এবং দ্রুত মানুষ সচেতন হবে। প্রয়োজনে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মানুষকে এর ভয়াবহ চিত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার কথাও বলেন তারা।
মোটকথা দেশের প্রতিটি ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। আইনের আশ্রয় নিয়ে হলেও সাবধানতা অবলম্বনে বাধ্য করতে বলা হয়েছে। নিজে আক্রান্ত হলে গোপন না করে প্রকাশ করতেও জানানো হয়। এতে বৃহৎ সম্প্রদায়কে বাঁচানো সম্ভব এবং দুর্ভোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনে সরকারকে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। যার প্রকৃত উদাহরণ চীন বহন করছে। সরকারের কঠোরতায় বিশ্বে সমালোচিত হলেও কোনোদিকে দৃষ্টিগোচর না করে মাত্র দুই মাসের মাথায় বিশ্বব্যাপী প্রশংসার দৃষ্টান্ত রেখেছে চীন।