জমকালো জামদানি
শাড়ির রাণী ‘জামদানি’
নব্বই দশকে খুব জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ছিলো, ‘মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস’। মুখে মুখে এই কথাটা শোনা যেত তখন। সেই একই সুরে যদি বলা হয়, ‘শাড়ির রাণী জামদানি’ তবে একেবারেই বাড়িয়ে বলা হবে না বা ভুল বলাও হবে না।
বাঙালি নারী মাত্রই শাড়ির প্রতি রয়েছে অন্যরকম এক টান, ভালোবাসা। সময়ের হাত ধরে ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পোশাকের ধরনে ভিন্ন মাত্রা যোগ হলেও শাড়ির স্থানটি রয়েছে বরাবরই অটুট। পরিচিত, ছোট-বড় মার্কেট ঘুরলেই খোঁজ মিলবে দেশীয় ও ভিনদেশীর হরেক শাড়ির। সাম্প্রতিক সময়ের কেনাকাটা অধিকাংশ মানুষের জন্য অনলাইন ভিত্তিক হয়ে যাওয়ায় পছন্দের শাড়ির খোঁজ এখন ঘরে বসেই পাওয়া সম্ভব হয়।
দুঃখজনকভাবে হলেও সত্যি, প্রতিবেশী দেশগুলোর হরেক নামের ও ধরনের শাড়ির প্রভাব দেখা যায় অফলাইন ও অনলাইন দুই জায়গাতেই। দেশীয় শাড়ি যেন সেখানে অনেকটাই বর্ণহীন। অথচ চাইলেই সঠিক চর্চার মাধ্যমে নিজেদের দেশের ঐতিহ্য ও শিল্পকে এগিয়ে রাখা যায় সবার আগে। জামদানি শাড়ি, পাঞ্জাবি, অন্যান্য পোশাকসহ জামদানি মোটিফে তৈরি গহনা হতে পারে এ বছরের বিয়ের মৌসুমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক।
জামদানিকে জমকালোভাবে সবার কাছে তুলে ধরতে বার্তা২৪.কমের ধারাবাহিক আয়োজন ‘জমকালো জামদানি’র আজকের পর্বে কথা বলা হবে জামদানি শাড়ি নিয়ে।
কাকলী’স অ্যাটায়ার
দেশীয় বিভিন্ন শাড়ির মাঝে জামদানি শাড়ির কদর ও প্রচলন সবচেয়ে বেশি। সুতার বুননে নজরকাড়া কারুকাজ সহজেই আভিজাত্য এনে দেখ পুরো সাজপোশাকে। জামদানি শাড়ি নিয়ে কথা হয় কাকলী’স অ্যাটায়ারের প্রতিষ্ঠাতা ও জামদানিপ্রেমী কাকলী রাসেল তালুকদারের সাথে।
ছোটবেলা থেকে মায়ের জামদানি পরা দেখে জামদানির প্রতি ভালোবাসা। সে সময়েই দেখতেন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে আসলে তার মায়ের কাছ থেকে জামদানি নিয়ে যেতেন পরিচিতরা। ছেলেবেলা থেকে জামদানির প্রতি এই আকর্ষণ থেকেই ২০১২ সাল থেকে নিয়মিত বিভিন্ন জামদানি হাট ও তাঁতি পল্লী ঘোরা শুরু হয় তার। ব্যবসার উদ্দেশ্যে নয়, বরং জামদানির প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ ও মুগ্ধতা থেকেই এই কাজটি করতেন তিনি।
পাঁচ বছরের চাকরিজীবনের পর সংসারে মনোযোগ দেওয়া। কিন্তু একটা সময়ে এখানেও হাঁপিয়ে ওঠা কাকলি সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা শুরু করবেন। প্রথমে বাধা এসেছিল, তবে আত্মবিশ্বাস তাকে এগিয়ে এনেছে নিজের পছন্দ নিয়ে কাজ করার জন্য।
সম্প্রতি ব্যবসা শুরু করলেও, জামদানি শাড়ি ও জামদানির কাজ নিয়ে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ ভারি হওয়ায় পরিচিতিরা তার মতামত নিয়ে তবেই জামদানি শাড়ি কেনেন। এ কারণে জামদানি শাড়ি কেনার ক্ষেত্রে খুব সহজেই তাকে বিশ্বাস করতে পারছেন ক্রেতারা।
কাকলী জানালেন তার কাকলী’স অ্যাটায়ারে সর্বনিম্ন ১৬৫০ টাকা থেকে পাওয়া যাবে জামদানি শাড়ির সংগ্রহ। সর্বোচ্চর কোন সীমা নেই, কারণ জামদানি শাড়ির বুনন, কাজ, সুতা ও সুতার কাউন্ট যত বেশি হবে, জামদানি শাড়ির দাম ততই উপরের দিকে উঠবে। জানালেন বর্তমানে তার সংগ্রহে সর্বোচ্চ ১২৫০০ টাকার জামদানি রয়েছে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে বউদের জন্য জামদানি শাড়ির মাঝে কোন রঙ ভালো হবে জানতে চাইলে কাকলী জানালেন, ‘লাল রঙটা সবসময়ই বউদের জন্য ঐতিহ্যবাহী একটা লুক এনে দেয়। তবে লালের বাইরে শাড়ির রঙে ভিন্নতা আনতে চাইলে হালকা রঙ বেছে নিতে হবে অবশ্যই। কারণ বিয়ের দিনের ভারি সাজ, গহনা ও লাইটিংয়ের মাঝে হালকা রঙের জামদানি খুব জমকালো একটা লুক তৈরি করবে। হালকা রঙের মাঝে থাকতে পারে হালকা পিচ, বেবি পিংক, মিন্ট, সাদা এমন রঙগুলো।’
জামদানি ভিলা
তাঁতিদের সাথে নিজে বসে থেকে নকশা দেখিয়ে দেওয়া, সুতা নর্বাচন করা, বুনন পর্যবেক্ষন করা- সবকিছুই তদারকি করে একদম নিখুঁতভাবে তৈরি করা জামদানি শাড়ির পশরা নিয়ে গড়ে তুলেছেন ইফাত শারমিন তার জামদানি ভিলাকে। প্রতিটি শাড়ির ডিজাইন কীভাবে ব্যতিক্রম করা যায় তার জন্য চেষ্টায় কোন কমতি রাখেন না তিনি।
ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ি রঙ ও নকশার উপর ভিত্তি করে এবং তাঁতিদের সাথে আলোচনা করে তৈরি করা হয় এক একটি জামদানি। তার জামদানি শাড়ি তৈরির জন্য নির্ধারিত তাঁতিদের সাথেই কাজ করেন তিনি। ফলে জামদানি ভিলার প্রতিটি জামদানিই হয় অনন্য। ফলে ২০১৪ সালে এক্কেবারে শূন্য থেকে শুরু করা জামদানি ভিলা পেইজ পৌঁছে গেছে ২ লাখ ৪৫ হাজার মানুষের কাছে। ইফাত জানালেন সর্বনিম্ন ৬,৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫,০০০ বা তারও বেশি মূল্যের জামদানি পাওয়া যাবে তার জামদানি ভিলায়।
বিয়ের আয়োজনে জামদানি শাড়ির পরার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জামদানি হলো একেবারে হ্যান্ড ক্রাফট পণ্য, যার সাথে মেশিনের কোন সম্পর্ক নেই। এ কারণে জামদানি পরলে এর সাথে ঐতিহ্যগত দিকটা যেমন ফুটে ওঠে তেমন প্রশান্তির ভাবও কাজ করে। কনে বাইরের দেশের শাড়ির বদলে ১২-১৫ হাজার টাকার সাধারণ জামদানি পরলে তার মাঝে যে স্নিগ্ধতা ফুটে উঠবে সেটা কিন্তু লাখ টাকার শাড়িতেও আসবে না।’
ফারাহ’স ওয়ার্ল্ড
এক্সক্লুসিভ শাড়ি ও পোশাক নিয়ে কাজ করেন ফারাহ’র ওয়ার্ল্ডের সামিয়া ফারাহ। রুচিশীল, মার্জিত ও ভারি নকশার শাড়ি ও পোশাকে যাদের আগ্রহ, ফারাহ’স ওয়ার্ল্ডের কালেকশন হতে পারে তাদের প্রথম পছন্দ। বিভিন্ন ধরনের তন্তুর উপর নিজস্ব নকশায় তৈরি হয় করা প্রতিটি শাড়ি ও পোশাকই হয় অনবদ্য।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের নবম ‘সিল্ক কার্নিভাল’ অনুষ্ঠানে থাই সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে এসেছেন 'তাতাল কন্যা' হিসেবে সুপরিচিত ফারাহ। মঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা ও নিজের কাজকে ৭৪টি দেশের কয়েক হাজার মানুষের সামনে উপস্থাপন করার অনুভূতি জানাতে তিনি বলেন, ‘এই অনুভূতি আসলে কয়েক কথা বা কোন ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।’
জামদানি নিয়ে ফারাহর কাজ শুরু হয় নিজের জামদানি শাড়ি দিয়েই। একই জামদানি শাড়ি ঘুরেফিরে কয়েকবার পরার পর জামদানিতে কিছুটা নতুনত্ব আনতে এতে এমব্রয়ডারি, কারচুপি ও কাটওয়ার্কের (তাতাল) কাজ জুড়ে দেন। সে শাড়িগুলো জনপ্রিয়তা পেলে সবার আগ্রহে জামদানি শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি।
বিয়ের মতো জমকালো অনুষ্ঠানে পরার জন্য জামদানি শাড়ি যাদের কাছে সাদামাটা মনে হয়, ফারাহ’স ওয়ার্ল্ডের এক্সক্লুসিভ জামদানি শাড়ির সংগ্রহ তাদের সেই ধারণাকে ভেঙে দেবে। চমৎকার জামদানি শাড়ির উপর বিভিন্ন ধরনের কাজের সমন্বয়ে তৈরি করা প্রতিটি শাড়িই দারুণ আকর্ষণীয়।
জানালেন তাঁতিদের কাছ থেকে সরাসরি জামদানি শাড়ি কিনে এরপর সম্পূর্ণ নিজস্ব নকশায় তার উপরে কাজ করেন তিনি। এমন এক একটি শাড়ির মূল্য সর্বনিম্ন ৫০০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০০ বা তার চেয়ে বেশি হতে পারে কাজের ধরণ অনুযায়ি।
ইফাত ও ফারাহ দুজনেই কাজের প্রসঙ্গে জানালেন, দেশের মানুষের চাইতে প্রবাসীদের কাছে জামদানির চাহিদা ও কদর দুটোই বেশি। এমনকি তাদের কাছে দেশের বাইরে থেকেই জামদানি শাড়ির অর্ডার আসে বেশি। সকলে দেশীয় ঐতিহ্য ও অনন্য এই শিল্পকে সমাদর করবে এমনটাই আশা করেন তারা।