বিশ্ব কাঁপুক বিশ্বকাপে
‘মরুর বুকে বিশ্ব কাঁপে’রিচার্ড ডকিন্সের একটা বই আছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। বইটি প্রাণির শরীরের কোষে কোষে লিখিত বিকাশের ইতিহাস, বংশগতি সম্পর্কে লিখিত। বইটি সম্পর্কে আমরা যতটা জানি তারচেয়ে বেশি জানি ফুটবল বিশ্বকাপকে। ফুটবল বিশ্বকাপের আবেদনের সঙ্গে এ বইয়ের নাম যেন মিলে গেছে, যদিও প্রসঙ্গ ভিন্ন স্বাভাবিকভাবেই।
বিশ্বকাপ ফুটবলকে আমরা দেখি ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ কিংবা বিশ্বনাগরিকের মেলবন্ধন হিসেবে। যদিও অলিম্পিক গেমসে এই শব্দেরও ব্যবহার আছে। অলিম্পিক গেমসের পাঁচ রিঙয়ে পাঁচ মহাদেশের এবং লাল, নিল, হলুদ, সবুজ ও কালো এই পাঁচ রঙ এমনভাবে নেওয়া আছে যেখানে বিশ্বের প্রতি দেশের পতাকায় যেন অন্তত কোন একটা রঙের দেখা মেলে।
বিশ্বকাপ ফুটবল যেভাবে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষদের নাড়িয়ে দেয়, আন্দোলিত করে, বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টি কেবল ফুটবলে নিবন্ধ করে সেটা আর কোন খেলায় হয় না। ফুটবলে প্রকৃতই বিশ্ব কাঁপে। নানা প্রান্তের মানুষদের সব চোখ একটা নির্দিষ্ট বস্তুতে নিবদ্ধ করতে বাধ্য করে! নিজেদের দেশের প্রতিনিধিত্ব না থাকা সত্ত্বেও এই সময়ে আমরা প্রত্যেকেই হয়ে যাই বিশ্বনাগরিক। কেবল বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ অন্তত বিশ্বকাপের মাসে হয়ে পড়ে একেকজন বিশ্বনাগরিক। শূন্য থেকে শুরু যে ফুটবলের সে ফুটবল আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অন্যতম প্রধান মাধ্যম বিনোদনের, উৎসবের, উপভোগের।
এশিয়ার দেশ কাতারে বসছে এবার ফিফা বিশ্বকাপের ২২তম আসর। এই ২২ আসরে এশিয়া মাত্র দুইবারই বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়েছে। প্রথমবার ২০০২ সালে এশিয়ার দুই দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল। এরবাইরে বাকি আয়োজনগুলোর সবটাই হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। আফ্রিকার কোন দেশের সে সুযোগ আসেনি এখনও।
ফিফার সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা ২১১। সদস্যসংখ্যার দিক থেকে এটা জাতিসংঘের চাইতেই বেশি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাইতে বেশি তো বটেই। ফিফা শক্তিশালী এক সংস্থা যেখানে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নির্দিষ্ট কোন সদস্যরাষ্ট্র যতই শক্তিশালী হোক না কেন ফুটবলে ফিফার শক্তি তাদের চেয়েও বেশি। এখানে যতই রাজনৈতিক এবং বিবিধ বিরোধ থাকুক না কেন প্রতি দেশকে অংশ নিতে হয়, সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ, ফকল্যান্ড নিয়ে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা যতই বিরোধ থাকুক না কেন মাঠে ও মাঠের বাইরে এর উত্তাপ ছড়ালেও মাঠের প্রকাশে ফুটবলের নিয়মনীতির মধ্যেই থাকতে হয়।
ফুটবলের জন্মস্থান গ্রিস নাকি চীন এই বিতর্ক থামিয়ে শেষমেশ আধুনিক ফুটবলের জন্মস্থান ইংল্যান্ড বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমান ফুটবলের যে নিয়মকানুন এমনকি প্রতি দলে এগারো খেলোয়াড়ের ব্যবস্থা, একজন গোলরক্ষকের সিদ্ধান্ত, গোলপোস্ট, গোলপোস্টে জাল ব্যবহার, গোলপোস্টে ক্রসবার ব্যবহার, জার্সি নম্বর ব্যবহার, খেলার সময় নির্ধারণ, পেনাল্টি কিকের ব্যবহার এগুলো ধাপে ধাপে এসেছে। প্রথম স্বীকৃত ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ফিফা প্রতিষ্ঠার বহু আগে, যদিও প্রতিষ্ঠার পর ফিফা এটাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ফিফা প্রতিষ্ঠার চার বছর আগে ১৯০০ সালের অলিম্পিকে ফুটবলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও ওই খেলার জন্যে কোন পুরস্কারের ব্যবস্থা ছিল না; ছিল প্রদর্শনী ম্যাচ। প্রদর্শনী ম্যাচ আয়োজনের আট বছর পরের অলিম্পিকে ফুটবলকে আনুষ্ঠানিক খেলার স্বীকৃতি দেয় অলিম্পিক। ফিফার বয়স তখন চার বছর; ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপিত রূপ এর ফিফা।
প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন হয় ১৯৩০ সালে। স্বাগতিক ছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে। পরের বিশ্বকাপগুলোর আয়োজন যথাক্রমে ইতালি (১৯৩৪), ফ্রান্স (১৯৩৮), ব্রাজিল (১৯৫০), সুইজারল্যান্ড (১৯৫৪), সুইডেন (১৯৫৮), চিলি (১৯৬২), ইংল্যান্ড (১৯৬৬), মেক্সিকো (১৯৭০), জার্মানি (১৯৭৪), আর্জেন্টিনা (১৯৭৮), স্পেন (১৯৮২), মেক্সিকো (১৯৮৬), ইতালি (১৯৯০), যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৪), ফ্রান্স (১৯৯৮), দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান (২০০২), জার্মানি (২০০৬), দক্ষিণ আফ্রিকা (২০১০), ব্রাজিল (২০১৪), রাশিয়া ২০১৮; এবং এবার কাতারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার বাইরে কেবল মেক্সিকো একাধিকবার বিশ্বকাপের আয়োজন করে।
নভেম্বরের ২০ তারিখে কাতার ও ইকুয়েডরের ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপের। ১৮ ডিসেম্বরের ফাইনালের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটবে ২২তম আসরের। এত কাছে বিশ্বকাপ ফুটবল কিন্তু এখন পর্যন্ত নেই তেমন হাঁকডাক, উৎসব, আয়োজন। কী কারণ এর? আয়োজক দেশ কাতারের ব্যর্থতা, ফিফার উদাসিনতা, নাকি অন্য কিছু? ফিফা ফুটবলের বৃহৎ এই আয়োজন নিয়ে কখনই উদাসিন হয় না ফিফা, স্বাগতিক দেশ হিসেবে কাতারের উদাসিনতাও এখানে নেই। তবে কারণ অন্য, এবং এটা স্বাগতিকদেরই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হিসেবে কাতার এমনিতেই রক্ষণশীল, কিন্তু বিশ্বকাপের মতো বহুজাতিক এই ফুটবল টুর্নামেন্টে যেখানে সারাবিশ্বের মানুষের চোখ থাকে সেখানে বিশ্বনাগরিকের চাওয়া মেটাতে পারছে না স্বাগতিক দেশ। এটা মূলত আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা। সংকীর্ণতা, সংকীর্ণতা থেকে উদ্ভূত সীমাবদ্ধতা।
ফিফার সাবেক প্রেসিডেন্ট সেফ ব্লাটার বলছেন, কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্তই ছিল ভুল। কখনও বিশ্বকাপ না খেলতে পারা ‘ছোট দেশ’ কাতারের ম্যাড়ম্যাড়ে আয়োজন দেখে হতাশার মন্তব্য তার। অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু ও তাদের প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আছে কাতারের বিরুদ্ধে। ডেনমার্ক প্রতিবাদস্বরূপ জার্সিতে প্রতিবাদ আঁকতে চেয়েছিল, নেদারল্যান্ডস দল অভিবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার কথাও শুনছি আমরা। অংশগ্রহণকারী কয়েক দেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কাতারের মানবতাবিরোধী নানা আচরণের। বিশ্বকাপের আয়োজনে ফুটবলকে ছাপিয়ে এই আলোচনায় আসছে। এখানে ব্যর্থতা ভাসছে কাতারের। এগুলো উৎসবে রঙ ফিকে করে দিচ্ছে ক্রমশ।
বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্যে অঢেল অর্থের ব্যবহার করেছে কাতার। কিন্তু অর্থ ব্যয় ফুটবল অনুরাগীদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলছে না। টাকা দিয়ে কি সব হয়? ফুটবল যেখানে শিল্পবোধের সেখানে বেশ পিছিয়ে এখনও কাতার। অর্থ ব্যয় নন্দনের বিকল্প হয় না। এখানে শিল্পবোধের যে ব্যাপার জড়িত তার অভাব প্রকট হয়ে ওঠেছে। ফলে দুয়ারে বিশ্বকাপ, কিন্তু সেভাবে ঝড় এখনও ওঠছে না বিশ্বে।
তবে আমাদের প্রত্যাশা মাঠে বল মাঠে গড়ানোর ঠিক আগে এবং অথবা বল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে দৃশ্যপট, মরুর বুকে শিল্পী ছুটে রেখে যাবে চিহ্নের পর চিহ্ন; শিল্পচিহ্ন। মাতবে বিশ্ব ফুটবলে, কাঁপবে বিশ্ব ফুটবলে; বিশ্বকাপ ফুটবলে!