ইগো সরিয়ে দায়িত্ববান হন- পাপনকে পরামর্শ সাবের চৌধুরীর
ক্রিকেটারদের ধর্মঘটক্রিকেটাররা ধর্মঘটে। এখন পর্যন্ত অচলাবস্থা কাটেনি। ২১ অক্টোবর, সোমবার দুপুর থেকে দেশের ক্রিকেটাররা তাদের ১১ দফা পূরণের দাবি জানিয়ে সবধরনের ক্রিকেট থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) শক্ত অবস্থানে। অচলাবস্থা কবে কাটবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সামনেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভারত সফর। সার্বিক পরিস্থিতিতে ক্রিকেটীয় এই সঙ্কটে দেশ ও আর্ন্তজাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আশু সমাধান কি? বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এই বিষয়ে সহযোগী একটি টিভি চ্যানেলে বিস্তারিত বলেছেন। দেশের ক্রিকেটের এই অচলাবস্থার জন্য সাবের হোসেন চৌধুরী মূলত বর্তমান বোর্ডের শীর্ষ কর্তা নাজমুল হাসান পাপনের ‘ইগো’কে দায়ী করেছেন।
বোর্ড সভাপতি নাজমুল হোসেন বলেছেন ক্রিকেটারদের দাবিগুলো তিনি দেখেছেন। কিন্তু তারা তো দাবিগুলো নিয়ে আমাদের কাছেই আসেইনি। এলে তো সব দাবি মেনেই নেয়া হত। মিডিয়ার কাছে তারা দাবি উপস্থাপন করেছে। এই প্রসঙ্গে সাবের হোসেন চৌধুরী বলছিলেন-‘ এটাই কি তাহলে এই বিষয়ে একমাত্র পদ্ধতিগত সমস্যা। আমরা কি বৃহত্তর ক্রিকেটীয় স্বার্থটা দেখবো না? ধরেই নিলাম খেলোয়াড়রা একটা ভুল করলো। কিন্তু তাই বলে আমি বসে থাকবো। তাহলে তো সেক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা একটা ইগোর সমস্যা। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এমন-আমার কাছে আসোনি, আমি হলাম ক্রিকেট বোর্ডের সম্রাট (যদিও সম্রাট বিষয়টা এখন অন্য এবং বড় একটা প্রেক্ষাপটে চলে আসে!)। আমার কাছেই সবাইকে আসতে হবে, যদি না আসে তাহলে আমি ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থ দেখবো না! এই ধরনের আচরণ খুবই অপরিণত একটা অ্যাপ্রোচ। আপনার কাছে একজন সরাসরি এসে দাবিগুলো করল না কেন, এজন্য পুরো ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যাবে? এসব ইগো নিয়ে থাকলে তো ক্রিকেটের অচলাবস্থা কাটবে কিভাবে?’
দেশের ক্রিকেটের বর্তমান সঙ্কটকে ছোট পরিসরে দেখার উপায় নেই জানিয়ে সাবের চৌধুরী বলছিলেন-‘আমার কাছে মনে হয় পুরো বিষয়টা এখন স্বার্থের জালে আটকা পড়েছে। ২০১৩ সালের বিসিবির গঠনতন্ত্রে যে বদল আনা হয়েছে সেটা দুনিয়ার আর কোন দেশের ক্রিকেটে নেই। এই গঠনতন্ত্রে ক্লাবগুলোতে অনেক বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু ক্লাবকে এই নির্বাচনে দুটো করে ভোট দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। যা ইতিহাসে আর কোথাও নেই! এভাবে নির্বাচিত হয়ে যারা বোর্ডে এসেছেন তারা সবাই ক্লাবের স্বার্থটাকেই দেখছেন। এখানে জাতীয় স্বার্থ বলে কোনকিছু আর নেই। ঢাকার যে ক্রিকেট খেলুড়ে ক্লাবগুলো আছে তার সবগুলোরই নিয়ন্ত্রণ দেশের দুটো বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে কাউন্সিলারদেরকে তারা নিজেদের করে নিয়েছে। একটা উদাহরণ দেই। বোর্ডের পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক ব্রার্দাস ইউনিয়ন ক্লাবের কাউন্সিলর। মল্লিক সাহেব বেক্সিমকোতে চাকরি করেন। পাপন সাহেবের খুবই ঘনিষ্ঠ তিনি। সেজন্য তাকে ব্রার্দাস থেকে কাউন্সিলার বানানো হয়েছে। এভাবে করে সব ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ এবং কাউন্সিলশিপ নিয়ে নেয়া হয়েছে। এমন পদ্ধতিতে নির্বাচন যখনই হোক, যেভাবেই হোক উনারা যাকে চাইবেন শুধু সেই বোর্ডে আসতে পারবে। এটাই তো স্বার্থের সংঘাতের বিষয়। নিয়ম হলো বোর্ডের পরিচালকরা ক্রিকেট বোর্ডের কোন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। কিন্তু এখন খোঁজ নিয়ে দেখেন টিভি সম্প্রচার থেকে শুরু করে ক্রিকেট বোর্ডের প্রায় সবকিছুতেই বোর্ডের পরিচালকরা জড়িয়ে আছেন। বোর্ডের বিভিন্ন কাজের জন্য ঠিকাদারদের ডেকে বলা হয়-অমুক কাজের জন্য খরচের শতকরা হার তুমি বাড়িয়ে দাও। সুতরাং বোর্ডের প্রভাবশালী পরিচালকদের মধ্যে (সবাই না, কিছু কিছু) যখন বানিজ্যের বিষয়টা চলে আসে তখন এখানে ক্রিকেটের স্বার্থ বলতে আর কিছু থাকে না।’
ক্রিকেটাররা যে ১১ দফা দাবি জানিয়েছে সেখানে তাদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধির বিষয়টিও রয়েছে। শুধু নিজেদেরই পারিশ্রমিক বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে তা কিন্তু নয়। তারা স্থানীয় কোচ, কিউরেটর, আম্পায়ার এমনকি গ্রাউন্ডসম্যানদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধির দাবি তুলে ধরেছে।
এই প্রসঙ্গে সাবের চৌধুরীর বিশ্লেষণ হলো-‘ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের বিষয়টি অবশ্যই আমাদের এখন আর্ন্তজাতিক মান অনুযায়ীই ভাবতে হবে। আমরা তো এখন আর আইসিসির এসোসিয়েট সদস্য নই। পূর্ণ সদস্য। একটা তালিকায় দেখলাম টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সম্পদের বিবরণ অনুযায়ী পঞ্চম ধনী। শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ারও উপরে বাংলাদেশের স্থান! তাহলে আমরা তো ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের ব্যাপারেও একটা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড আশা করতেই পারি। আমি বলছি না ক্রিকেটারদের সব দাবি এখনই মেনে নিতে, কিন্তু একটা আলাপ-আলোচনা যদি তাহলে মাঝখানে থাকার মতো একটা অবস্থান তৈরি হতে পারে। এখন তো যা হচ্ছে তা শুধু পক্ষ-বিপক্ষ। ইগোর সমস্যা দেখা দিয়েছে। তুমি আমার ইগোতে আঘাত করেছো। অসন্মান করেছো। সুতরাং তোমার সঙ্গে আমি কথা বলবো না। এটা তো স্কুল বা কিন্ডারগার্ডেনে নার্সারি পর্যায়ের ছাত্রের মতো আচরণ হয়ে গেল! কিন্তু এটা তো ক্রিকেট বোর্ডের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারো কাছ থেকে এমন আচরণ তো আশা করা যায় না।’
ক্রিকেটাররা যে সমস্যার কথা তুলে ধরেছে সেটা নতুন কিছু নয়। এই সমস্যার বিষয়টি ক্রিকেট বোর্ডও জানতো। ক্রিকেটারদের সংগঠন ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) ও জানতো। কিন্তু তারপরও ক্রিকেটাররা তাদের দাবি দাওয়া ভিন্ন মেজাজে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। এই প্রসঙ্গে সাবের চৌধুরীর ব্যাখ্যাটা এমন- ‘খেলোয়াড়রা হয়তো মনে করেছে ওনাদের কাছে গিয়ে কোন লাভ নেই। সমাধান হবে না। তারপরও আমি মনে করি তাদের যাওয়া উচিত ছিল, ক্রিকেট বোর্ডের কাছে। আমি ক্রিকেটারদের দাবির স্পিরিটের সঙ্গে একমত। তবে হ্যাঁ এটার উপস্থাপনটা ভিন্নভাবে হতে পারতো। কিন্তু ক্রিকেটারদের এই একটা ভুলের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কোন ভুক্তভোগী হতে হবে? বাংলাদেশ ক্রিকেট কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে?’
-তাহলে এখন চটজলদি সমাধান কিসে?
বিসিবির সাবেক সভাপতি হিসেবে সাবের চৌধুরী তার অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন-‘সভাপতি সাহেবকে আমি বলবো, ক্রিকেটারদের চায়ের দাওয়াত দেন। তাদের সঙ্গে বসুন। কথা বলুন। ইগো বাদ দেন। ও আমার দিকে তাকায়নি কেন-ওর সঙ্গে কথা বলবো না, এমন চিন্তাভাবনা নিয়ে বোর্ডের দায়িত্ব পালন করার কোন অর্থ হয় না। বোর্ড হচ্ছে দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক। তারাই তো এগিয়ে এসে সমস্যার সমাধান করবে। সংসারে সন্তান যদি কোন দোষ করে আর বাবা যদি বলে তুমি দোষ করেছো তোমার সঙ্গে আর কোন কথা বলবো না, এটা কি কোন দায়িত্বপূর্ণ কথা হবে? দায়িত্বের ভার তো অভিভাবকের ওপরই বেশি।’
আরও পড়ুন-