বিশ্বকাপে ইন্টারভিউ নেওয়ার আগে, দিতে হলো!
৬ জুন ২০০৬, মঙ্গলবার।
মিউনিখে পা রেখেই ডয়েস ভাষায় তিনটি শব্দ শিখলাম। রেল স্টেশনকে এরা বলে ‘বানহাফ’। আর প্রধান বা বড় রেল স্টেশন হলো ‘হাফবানহাফ’। ‘ডাঙ্কে’ মানে ধন্যবাদ। উচ্চারণের সময় গলার ভেতর অর্ধেক শব্দ আটকে থাকে, বাকি অর্ধেক বের হয়- বলার ভঙ্গিতে এমন কায়দাটা টের পেলাম!
ডয়েসের এই তিনটি শব্দকে সঙ্গী করেই ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে আমাদের কাজের শুরু। তিন দিন পরে বিশ্বকাপ। অনেক জরুরি কাজ বাকি। সেলফোনের সিম কিনতে হবে। ইন্টারনেটের সংযোগ নিতে হবে। স্টেডিয়ামে যাওয়ার শাটল বাসের সিডিউল জানতে হবে। পরের ম্যাচে অন্য শহরে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট রিজার্ভ করতে হবে। তারচেয়ে বড় কথা- স্টেডিয়ামে যাওয়ার রাস্তা চিনতে হবে। মিউনিখ (এরা বলে মুনসেন) এর বাস ও রেল স্টেশন খুঁজে বের করতে হবে। তাই পরদিন অর্থাৎ ৭ জুনের সকালেই রেল স্টেশনে ছুটলাম চারজন। আমি, এনটিভি’র দোদুল, জনকণ্ঠের মজিবুর ও সমকালের রানা ভাই।
মিউনিখ সিটি সেন্টারে ‘হাফবানহাফ’। চারধারে রেললাইনের অনেক ম্যাপ। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল ভাষা। সবকিছুই লেখা ডয়েস ভাষায়। ইংরেজির কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। অ্যাক্রিডিটেশন সেন্টারে যেতে হলে যে স্টেশনে নামতে হয়- তার নাম কেউ মনে করতে পারলাম না। শেষমেশ হেল্পডেস্কে বসা এক রেল কর্তার সাহায্য নেওয়া হলো। ভদ্রলোক হাতে পুরো মিউনিখ সিটির পাতাল রেলের একটা মানচিত্র ধরিয়ে দিলেন। সেই ম্যাপে একটা রেল স্টেশনের নামের পাশে ফুটবলের ছবি আঁকা। ব্যস ঠিকানা খোঁজার টেনশন শেষ!
হাঁটুর ওপর ম্যাপ বিছিয়ে দোদুল পুরোদস্তুর ট্র্যাকার। ম্যাপে কলম ধরে আঁকিবুকি দিয়ে জানাল- মিউনিখের আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সেন্টার (আইবিসি) যেতে হলে আমাদের ৮টা স্টেশন পরে নামতে হবে।’
সারাদিনের জন্য পাতাল রেলের একটা গ্রুপ টিকিট কিনে আইবিসি’তে পৌঁছে আমরা তো অবাক। চারধারে ভীষণ ভিড়। জানা গেল দুপুরে এখানে সেপ ব্লাটার ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের প্রেস কনফারেন্স আছে। পাসপোর্ট আর ই-মেইলের কনফার্মেশন কপি দেখাতেই ঝটপট অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড হয়ে গেল। দুপুর হতে তখনো অনেক বাকি। বিশাল আইবিসি’র চারপাশ দেখতে হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথার যোগাড়! সেন্টারের ভেতরে সাইকেলের আলাদা লেনও রয়েছে। ভাড়ায় সাইকেলও মিলে।
টি-মোবাইলের শপিং কর্নারে গিয়ে মেজাজ আরেক দফা খারাপ হয়ে গেল। মোবাইল কিনতে বা সিম কিনতে হলে ক্রেডিট কার্ড লাগবে।
-সরি, উই আর নট টেকিং এনিথিং ইন ক্যাশ’-ফিনফিনে সাদা শার্ট ও স্কার্টের জার্মান তরুণী মুখে চমৎকার হাসি ধরে রেখেই আমার দুঃখে যেন গলে গেল!
-কিন্তু আমাকে যে সিম কিনতেই হবে। মোবাইল ছাড়া আমি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ কিভাবে করব? কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবে।’
নীল নয়নার হাসি মুখে হাসি, কিন্তু সমাধান নেই- সরি স্যার। নো অপসন।’
ভালোই টেনশনে পড়ে গেলাম দেখি! দুঃশ্চিন্তা দূর করল বুদ্ধিমান দোদুল। টি-মোবাইলেরই এক কর্মকর্তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তার ক্রেডিট কার্ডে নিজের ও আমার জন্য টেলিফোনের দুটো সিম যোগাড় করে ফেলল। আমরা ওই ভদ্রলোককে নগদ ইউরোর সঙ্গে অনেকগুলো থ্যাঙ্ক ইউ (ডাঙ্কে) দিলাম।
টেলিফোনের সিম তো মিলল। এখন ইন্টারনেটের কি হবে? ওতে যে ম্যালা খরচ। স্টেডিয়ামের ভেতরে ও মিডিয়া সেন্টার- দু’জায়গার জন্য আলাদা ইন্টারনেটের সংযোগ কিনতে হবে। একেকটার জন্য খরচ প্রায় চারশ’ ইউরো। বাংলাদেশি টাকায় ৩৬ হাজার করে!
নিলে নেন, নইলে লাইন ছাড়েন। দামাদামি করার কোনো উপায় নেই। দ্বিতীয় কোনো প্রোভাইডার নেই। ডাচেস টেলিকম বিশ্বকাপের অফিসিয়াল পার্টনার। ইন্টারনেট লাইন ছাড়া বিশ্বকাপ কাভার করা অসম্ভব। কিন্তু ইন্টারনেট লাইন কিনতেও সেই ক্রেডিট কার্ড সমস্যা। যে ভদ্রলোকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টেলিফোন লাইন কিনেছিলাম, ফের তার কাছে দৌড়ানো। আমাদের অবাক করে ভদ্রলোক আরেকবার তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে দিলেন। কিন্তু সমস্যা যেন পিছু ছাড়ছে না। তার কার্ডে চারশ’ ইউরোর ব্যালান্স নেই!
মিউনিখ স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টার থেকে ইন্টারনেট লাইন পরদিন কেনার কোনোএকটা উপায় বের করা যাবে- এই চিন্তা করে সেদিনের মতো আইবিসি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ দেখি ভিডিও ক্যামেরা হাতে দোদুল মোটাসোটা এক লোকের পেছনে দৌড়াতে শুরু করল।
-কি জানি কাকে পেল?
আরে এ তো চিলাভার্ট! প্যারাগুয়ের বহুল আলোচিত সেই গোলকিপার। অনেক মুটিয়ে গেছেন। দোদুল ক্যামেরা চালু করে। আমাদের প্রশ্ন শুনে দু’পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে দুর্বোধ্য (সম্ভবত স্প্যানিশ) ভাষায় হড়বড় করে কি যেন বললেন প্যারাগুয়ের সাবেক অধিনায়ক। দাঁড়িয়ে থাকলে ভীষণ বিপদ হবে; বড় রকমের আর্থিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে- এমনই ভঙ্গি করে প্রায় দৌড়ে আমাদের টপকে চলে গেলেন চিলাভার্ট। পরে জেনেছিলাম লাতিন আমেরিকার একটি টিভি চ্যানেলে ধারাভাষ্য দিতেই বিশ্বকাপে এসেছেন এই তারকা। প্যারাগুয়ে এবারের বিশ্বকাপে নেই। তাই চিলাভার্টের সাক্ষাৎকার তেমন জমত না- এই সান্ত্বনা নিয়েই হোটেলে ফেরার জন্য ট্রেন ধরতে ছুটলাম আইবিসি থেকে।
দুপুর শুরুর সময় বলেই হয়তো তেমন ভিড় নেই ট্রেন স্টেশনে। গলার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের দিকে আশপাশের অনেকেই উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে।
‘এক্সকিউজ মি’-শুনে ঘাড় ঘুরালাম। গোল ফ্রেমের চশমা চোখে দাঁড়ানো এক জার্মান তরুণী। এক কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। অন্য কাঁধে ক্যামেরা।
-আমি রিপোর্টার। জার্মানির একটি পত্রিকায় কাজ করি। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
-আরে আমিও যে কাউকেই খুঁজছিলাম, এখানে।
ততক্ষণে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
-তুমি কোথায় যাবে?
-সিটি সেন্টার।
-গুড, আমিও সেখানেই নামব। চলো ট্রেনে বসে আলাপ করা যাবে।
ট্রেন ছাড়ার পর টি জেডের রিপোর্টার আন্দ্রেই ওভারমেইয়ার আমাকে চমকে দিল- আমি আসলে তোমার ইন্টারভিউ নেব।
-বলো কি, এতদিন তো আমি ইন্টারভিউ নিতাম। আজ দেখি উল্টো। বিশ্বকাপে এসে এখনো কারো ইন্টারভিউ নিলামই না, বরং দিতে হচ্ছে! পাশের সিটে বসা দোদুল আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে।
ওভারমেইয়ার তার নোটবুক খুলে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করার আগে ক্ষমা চেয়ে নিল- আমার ইংরেজি জ্ঞান অত ভালো নয়।
তাকে আশ্বস্ত করলাম- নো প্রবলেম, ইংরেজি আমারও মাতৃভাষা না।
বিশ্বকাপের শহর মিউনিখ কেমন লাগছে? লোকজনের মধ্যে উৎসাহ কেমন দেখলাম? এই শহরের কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে? ফেভারিট দল কোনটি? জার্মানির কেমন সম্ভাবনা এবার- এ ধরনের সাদামাটা প্রশ্ন দিয়ে ঝটপট শেষ ইন্টারভিউ পর্ব।
মিউনিখ হাফবানহাফে ট্রেন থামতেই মনে হলো- ১০ জুনের রাতে হামবুর্গ যাওয়ার ট্রেনের টিকিট রিজার্ভ করতে হবে। ওভারমেইয়ার ভরসা দিল- কোনো সমস্যা নেই, ৪৮ ঘণ্টা আগে নিশ্চয়ই টিকিট রিজার্ভ করা যাবে।
রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে ওভারমেইয়ার কাঁধের পেনট্যাক্স ক্যামেরা নামিয়ে আমাকে স্টেশনের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে ছবি তুলল।
-তুমি কাল বিকালের কাগজেই পাবে ইন্টারভিউটা। সান্ধ্য দৈনিক টি জেড, বিকাল পাঁচটার দিকে পেপারস্ট্যান্ডে খোঁজ নিও। কব্জি উল্টে ঘড়ির দিকে তাকাল ওভারমেইয়ার।
-আমাকে যেতে হবে। আমার নিউজ ছাড়ার ডেডলাইন মিস করব নইলে। ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে অফিসের পথে হাঁটা ধরল ওভারমেইয়ার।
উদ্বোধনী ম্যাচের পরে মিউনিখে আরো তিনবার এসেছি। কিন্তু কোনোবারই ওভারমেইয়ারের সঙ্গে দেখা করার সময় বের করা যায়নি। বিশ্বকাপের ব্যস্ততা সেই সুযোগ হতে দেয়নি।
তবে ৮ জুনের মিউনিখের বিকাল ঠিক চমকে দেয় আমাকে। সিটি সেন্টারের পাশেই পেপারস্ট্যান্ড। ৪০ সেন্ট বক্সে ফেলে ভাঁজে মোড়া টি জেড পত্রিকা হাতে নিলাম। ভেতরের চার নম্বর পৃষ্ঠার পুরোটা জুড়েই বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার। মাঝের বক্সে আমার ছবি। ডয়েস ভাষায় ছাপা হয়েছে সাক্ষাৎকার। বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বুঝতে-পড়তে পারিনি। তবে ছবির এককোণে থাকা বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাটা বুকের ভেতর অনেক আবেগের স্ফুরণ তৈরি করে।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারার সুতীব্র একটা আনন্দ ছুঁয়ে গেল পুরো সত্ত্বা জুড়ে। মনে হলো আমিও যে এই বিশ্বকাপের একজন অংশীদার!
পরের গল্প: বার্লিন হোটেলের রহস্যময় ল্যাপটপ!
আর পড়ুন-
শচীন’স সসেজ, গাঙ্গুলি’স গ্রিল, মিয়াঁদাদ ম্যাজিক ম্যাঙ্গো জুস...