ইফতারের জৌলুস ও পার্থিব আলোচনা সভা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রমজানে সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার করে একজন রোজাদার তার দেহ-মনের পবিত্রতা ও প্রফুল্লতা লাভ করে থাকেন। শুধু খাদ্যসামগ্রী দিয়ে রোজা ভঙ্গ করাই নয়, ইফতারির সময় দোয়া কবুলেরও সময়। এসময় খাঁটি রোজাদাররা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করে পানাহ চেয়ে থাকেন। এতে রোজারদের দেহ-মনে স্বর্গীয় প্রশান্তি আসে।

আমদের দেশে পবিত্র রমজানের রোজাকে সামনে রেখে আলোচনা সভা ও ইফতার একসংগে করার হিড়িক পড়ে যায়। এরকম কোনো কোনো আয়োজনে দীর্ঘ সময়ব্যাপী নানা ধরনের পার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, এমনকি গালাগালি, বিষোদগার, ঝগড়াঝাটি শেষে ইফতার করা হয়। অনেক সময় হাস্যকর বিষয়েও ইফতারে হট্টগোল বাঁধতে দেখা যায়। এতে ইফতারের মতো একটি মহান ধর্মীয় বিষয়ের মাহাত্ম্য, সৌন্দর্য ও স্বর্গীয় আমেজ-অনুভুতি নষ্ট হয়ে পড়ে।

অনেকে আজকাল ইফতারকে নিছক পার্টির আবরণে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ইফতার তো কোনো বিয়ে-জন্মদিন বা রাজনৈতিক-ব্যবসাপাতির কোনো বিষয় নয়। রোজাদারগণ ভুলেই বসেন কোনটা ভালো কোনটা মন্দ অথবা কোনটা গিবত কোনটা রিয়া আর কোনটা শিরক্ কোনটা তাকওয়া ! তাই রিয়া, বেদআত, ও তাক্ওয়া বিষয়গুলো বোঝাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আমার মনে হয়।

কারণ, রিয়া হলো অহেতুক লোক দেখানো বিষয়। ইসলাম অহেতুক জৌলুস করে লোক দেখানো বিষয় সমর্থন করে না। রোজা একটি সাধনার ব্যাপার ও সর্বোপরি এটা আত্মিক ইবাদত। এখানে লৌকিকতার কোনো স্থান নেই। রোজা আল্লাহর প্রদত্ত বিধান। মানুষের অধ্যাত্মিক শিক্ষা ও প্রগতির জন্য রোজা হচ্ছে একটি উপায়। রোজা মানুষকে অশালীন প্রবৃত্তিরোধ করে শৃংখলাবদ্ধ হতে সক্ষম করে। এটা ধনী-গরীব সব মানুষকে একই ক্ষুৎ-পিপাসার অভিজ্ঞতা প্রদান করে থাকে। তাই একজন খাঁটি মুসলমান শুধু মিডিয়ায় প্রচারের জন্য স্বার্থপরের মত ভোগবিলাসী বড়লোকী খানাপিনায় মত্ত হবার মতো ইফতার করতে পারেন না।

বেদআত হলো যেটা মূল বিষয় থেকে বিকৃত করে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। ধর্মকাজে নতুনত্ব সৃষ্টি করা বা পরিবর্তন করাকে বেদআত বলে (ওয়াজ ও খুতবা ১০৯, ২৬০)। শরীয়তের মধ্যে কিছু বৃদ্ধি বা সংমিশ্রণ করে মনগড়া ও বিকৃত জিনিস হলো বেদআত। এর ফলে শয়তানের ধোঁকার মধ্যে পড়ে গুমরাহির পথ প্রশস্থ হয়।

তাক্ওয়া হলো- খোদাভীরু হওয়া, মুত্তাক্কী হওয়া। সবসময় আল্লাহর কথা স্মরণ করা ও তাঁর ভয়ে ভীত থাকা। আল্লাহতায়ালা সবসময় বিরাজমান, সঙ্গে আছেন, সব কাজ দেখছেন-মানুষের অন্তরে এমন বিশ্বাস হওয়াটাই তাক্ওয়া । রোজাদার ব্যক্তির মধ্যে মুত্তাকীর ভাব চলে আসে। তাই সে খারাপ কাজ করতে চায় না।

বলা হয়ে থাকে আমরা বাংলাদেশীরা সংকর বাঙালি। এ জাতির ভাবনা চিন্তাও সংকর ও কিছুটা মিশ্র। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতার একটি মুলনীতি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাই সব ধর্মের মানুষ এদেশে সমান ধর্মীয় সুবিধা ও অধিকারের সুযোগ পেয়ে থাকেন।


প্রায় পঁচাশি ভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের এদেশে রোজা ও ইফতার পালন একটি অন্যতম বৃহৎ ও মহৎ ধর্মীয় অনুষঙ্গ। এদেশের মানুষ আশাবাদী, কর্মঠ ও ভাগ্যে চরম বিশ্বাসী। বার আওলিয়ার এ পূণ্যভূমিতে ধর্মপরায়ণ মানুষের সংখ্যা অবাক করার মত। আমাদের অনেক ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ভালো কিছু করলে বহি:র্বিশ্বের মাঠে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পবিত্র ক্কাবার দিকে সিজদা দিতে দেরি করেন না। ঢাকা মসজিদের শহর হিসেবে খ্যতি পেয়েছে বহু পূর্বেই। একবার এক বিদেশী অতিথিকে হোটেলে ঘুমিয়ে দিয়ে আমি বাসায় এসে ঘুমিয়েছিলাম। পরদিন সকালে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘ঘুম কেমন হয়েছে?’ সে বলল- ‘ভোর বেলা কে যেন লাউড স্পীকারে সুর করে কিছুক্ষণ কিছু বলল। আমি সে সুরেলা আওয়াজে বিমোহিত। চল তার সাথে দেখা করব।’ আমি বললাম, সেটা কোনো মেলোডি নয় ‘আজান- আই মিন মর্নিং প্রেয়ার কল।’ সে বলেছিল, আমরা রোজ সকালবেলা প্রার্থনা করি না, অথচ তোমরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি দৈনিক পাঁচবার নত হও, তোমরা কতো কৃতজ্ঞ। তাই তো তোমরা বিশ্বের সবচে’ সুখী মানুষের কাতারে নাম লিখিয়েছ!


হ্যাঁ, আমরা বাংলাদেশের মুসলমান তথা সবাই খুব সুখী জীবনযাপন করি। যদিও আমরা জাতি হিসেবে এখনও কোনো কোনো দেশের মানুষের চোখে দরিদ্র, হাতপাতা ও মিসকিন মানুষ বলে পরিচিত। সেসব দেশের মানুষও একসময় অভাবী ছিল, খেতে পেতো না। তারা এখন অনেকে সমুদ্রে শততলা বাড়ি বানিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করে। শ্রমজীবি বিদেশিদের তারা বেশি খাঁটিয়ে নিয়ে কম মজুরী দেয়, নির্যাতন করে, ঘৃণা করে। নিজেদের বিলাস-ব্যসনের পাশাপাশি তাদের অনেকের মনে দারিদ্র্য ও হতাশা জন্ম নিয়েছে।

মনে দারিদ্র্য ও হতাশা থাকলে সুখী হওয়া যায় না। আজকাল আমাদের দেশেও অনেকে নব্য ধনবান হয়েছেন, তাদের অনেকের মনে অসুখ ধরেছে। কেউ কেউ দু’চার বছরে এত বেশি ধনবান ও ক্ষমতাশালী বনে গেছেন যে- সবসময় ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলাফেরা করে থাকেন। এরা রাস্তায় রং সাইডে চলেন। কেউ তাদের অন্যায় কাজে বাঁধা দিলে বা প্রতিবাদ করলে তাদেরও টুঁটি চেপে ধরতে উদ্যত হন।

ক’দিন আগে একজন পাতি নেতা রং সাইডে গাড়ি চালিয়ে উল্টো ট্রাফিক পুলিশকে চাকরি খেয়ে নেয়ার ভয় দেখিয়ে গালাগালি করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। এর কোনো বিহিত হতে দেখিনি। এ ধরনের অনেক পাতি নেতা বড় বড় ইফতার ‘পার্টি’ দেন। অনেক পাতি নেতার চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটিতে চালচুলো ছিল না। এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন।

এছাড়া আজকাল অনেক বড় বড় কর্তারাও ইফতার ‘পার্টি’ দেন। সেসব ‘পার্টি’ তাঁদের নিজেদের বেতন বা বাবার টাকায় নয়। তাঁরা আদেশ দেন বড় বড় ঠিকাদার, অবৈধ চোরাচালানী, মাদক ব্যবসায়ীকে এ সব ‘পাটির্র’ খরচ দিতে। এতে উঠতি পাতি নেতা ও অবৈধ মালদারগণ লক্ষ টাকা চাঁদা দিয়ে এসকল ‘পাটির্র’ আয়োজন করে দিয়ে নিজেরা আরো কোটি কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ পান। এরা-ওরা মাসতুতো ভাই। ইফতার বা অন্য যে অবয়বেই হোক না কেন- এই অনৈতিক ‘পার্টি-কালচার’ অচিরেই বন্ধ করতে হবে।

আজকাল এসব ইফতার ‘পার্টিতে’ রঙ-রেজিনী দিয়ে সুদৃশ্য গেট সাজানো হয়, রঙীন আলো দিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়। দেশের হোমড়া-চোমড়া মানুষরাই এখানে দাওয়াত পেয়ে থাকেন। জৌলুসে ভরা, লোক দেখানো এসকল ইফতার পার্টিতে আদৌ কোনো ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য থাকে না। পাক-নাপাক, পর্দা-বেপর্দার সমন্বয়ে আজকাল ব্যবসা অথবা রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ইফতারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আজ অমুকের সম্মানে ইফতার-তা হবে কেন? এসব ইফতার ‘পার্টিতে’ দামী রেস্টুরেন্ট বা পাঁচতারা হোটেলের বহু পদের বাহারী খাবার আনানো হয়। ইফতার ‘পার্টি’-র সুস্বাদু বহুপদের স্বাদ নিতে গিয়ে মাগরিবের নামাজের কথা অনেকেরই খেয়াল থাকে না। অনেকে অশালীনভাবে সেজেগুজে ইফতার করতে বসেন। প্রতিদিন টিভিতে এসব দেখানোও হয়ে থাকে। এগুলো রোজার সংযম, আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা নয়। বরং এগুলো দ্বারা রমজান মাস, রোজা ও ইফতারের মর্যাদাকে প্রহসনে রুপান্তরিত করা হয় মাত্র। লৌকিক, ভোগবাদী এসকল ইফতার ‘পাটির্র’ বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বর্তমানে আমরা আসল ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি।

কেউ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে উচ্চস্বরে মাইক বজিয়ে শতপদের ইফতারীর পসরা নিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে উল্লাস করে ইফতার করবেন-আর প্যান্ডেলের পাশের অভাবী মানুষের খোঁজ নেবেন না অথবা কেউ একটু ছোলা-মুড়ি পাবার আশায় থালা হাত বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াবে- এটা রোজার শিক্ষা নয়। পাশাপাশি আলোচনা সভার নামে ইফতার করতে এসে ‘পার্টিতে’ বসে রোজার আহকাম-আরকান ভুলে গিয়ে আমরা কোনটা গিবত, কোনটা রিয়া আর কোনটা বেদআত গুলিয়ে ফেলছি।

এসকল ইফতার ‘পাটির্র’ আয়োজন ধর্মীয় কাজের মোড়কে আমাদের ধর্মে নব্য অপচয় সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। আজকাল মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই বোন নিয়ে পরিবারের সংগে বসার ফুরসৎ হয় না। সবাই একত্রে ইফতার করার সময় যেন একবারেই উধাও হয়ে গেছে। এতে চিরায়ত পারবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। মা-বাবারা তাদের উঠতি বয়সের সন্তানদের সাথে ভালো করে কথা বলার সময় পান না। একটি ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে থাকলে নৈতিকতা শাণিত হয়। সাথে বাবা মায়ের স্বেহের বচন, উপদেশ পরামর্শ ইত্যাদি থেকে সুসন্তান তৈরি হয়। এভাবে একটি ইতিবাচক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়ে থাকে। নব্য ইফতার পার্টি সংস্কৃতির আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক নেতাদের একে অপরের মুখের বিষোদ্গার শুনে নবীনরা নেতিবাচক মানসিকতা অর্জন করছে।

ইসলামে মানুষ মানুষে ভেদাভেদের কোন স্থান নেই। সকল মানুষের সম-সুযোগের ভিত্তিতে সামাজিক সহ-অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারলে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হবে। সামাজিক বৈষম্য প্রকট হলে সামাজিক বঞ্চনা থেকে নানামুখি সংকট তৈরি হতে থাকবে। সামাজিক এসব সংকট আজকাল অপরাধ বৃদ্ধি করে চলেছে। বর্তমানে সুবিধাভোগী রং সাইডে চলা পাতি নেতারা এবং তাদেরকে অবৈধ মদদদাতা একশ্রেণির নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকর্তা ও সংগঠকরা চরম অনৈতিক কাজে ভীষণভাবে সক্রিয়। এসব লুটেরা এখন দেশের নিম্ন ও মধ্যমশ্রেণির কর্মজীবি, সৎ, ধর্মভীরু মানুষের ঝুলি ও হাঁড়ির ওপর নজর দিয়েছে।


রমজান মাসে আলোচনা সভা ও ইফতার ‘পার্টির’ নামে এখন বিকৃত ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের সুমহান ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বিতর্কিত করে চলেছে। কারণ, লৌকিকতা, জৌলুসে ভরা বে-হিসেবী তথা অবৈধ উৎসের অর্থে কেনা বা সংগৃহীত খাবার মু’মিনদের ইফতারের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। তাই এখনই সতর্ক হয়ে সেসকল পথ পরিহার করা আমাদের আশু করণীয়।


আসুন আমরা সবাই পবিত্র রমজানের সুযোগকে কাজ লাগিয়ে সংযমী হই, কল্যাণ, ক্ষমা, মুক্তি তথা মাগফেরাত ও নাজাতের এই ভরা মৌসুমকে কাজে লাগিয়ে নেতিবাচক ইফতার সংস্কৃতি পরিহার করে খাঁটি রোজাদার ও পূণ্যবান হয়ে উভয় জগতের সাফল্য খোঁজার চেষ্টা করি।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

   

মুক্তিপণের প্রতিষ্ঠা বনাম দায়িত্বশীলতা



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছে সুখবর দিয়ে। বাংলা বর্ষের প্রথম সকালে দেশবাসী জেনেছে সাগরে জিম্মি ২৩ বাংলাদেশি নাবিক মুক্ত হয়েছেন। তাদেরকে রেখে সরে যেতে হয়েছে সোমালিয়ান জলদস্যুদের। বাংলাদেশিরা এখন সাগরপথে আরব আমিরাত অভিমুখে এবং সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে ফিরবেন দেশে।

এই ২৩ বাংলাদেশি নাগরিকের মুক্তিতে একটা বড় ফাঁড়া কাটল। বাঁচল মানুষের প্রাণ, বাঁচল দেশের ইজ্জত। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, দূরদর্শিতার সব জয় হয়েছে। তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশ শক্তি প্রয়োগের পথে না গিয়ে মানুষের জীবনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার পথ বেছে নিয়েছে। এখানে শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল মুক্তিপণের। এই ঘটনার সুন্দর সমাধানের পর আদৌ কি মুক্তিপণের কিছু ঘটেছে, ঘটলে টাকার অঙ্কে সেটা কত এ নিয়ে আলোচনা চলছে, যদিও এই আলোচনাকে অবান্তর বলে মনে করছি। কারণ এখানে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন নেই, নেই ইজ্জত বাড়ার মতো কিছু। আছে কেবল বিশাল এক শ্রেণির শ্রোতা-দর্শক-পাঠকের তুমুল আগ্রহ; তবে এই আগ্রহ জাতীয় স্বার্থ কিংবা অপরাপর ক্ষেত্রে অগুরুত্বপূর্ণই।

বাংলাদেশিদের মুক্তি প্রক্রিয়ায় যদি আক্রান্ত নাবিকদের পরিবার যদি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তবে এটা নিয়ে আলোচনা হতো যৌক্তিক। এখানে যদি পাবলিক ফান্ডিংয়ের বিষয় জড়িত থাকত তবে সেটা নিয়েও আলোচনা জরুরি ছিল, কিন্তু এর কিছুই নেই এই প্রক্রিয়ায়। তাহলে কী কারণে এই আলোচনা, এত আলোচনা?

এটা সাধারণ বোধজ্ঞানের বিষয় যে, এইধরনের পরিবহন কিংবা যাত্রায় বীমা কোম্পানির বিবিধ অংশগ্রহণ থাকে। এখানেও এর ব্যতিক্রম থাকার কথা নয়। মুক্তিতে যদি বীমা কোম্পানির অংশগ্রহণ থাকে, তবে সেটার ব্যবসায়িক দিক তাদের। এই ব্যবসায়িক দিক নিয়ে মুখরোচক গল্প ফাঁদার প্রয়োজনীয়তা দেখি না।

২৩ বাংলাদেশি মুক্তিতে ৫০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। দুই জলদস্যুর বরাত দিয়ে রয়টার্সের সূত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের একাধিক গণমাধ্যম। রয়টার্সের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এক জলদস্যু তাদের জানিয়েছে, দু’দিন আগেই হাতে পৌঁছে মুক্তিপণের অর্থ। তারপর তারা সেগুলো নকল কিনা যাচাই করে দেখেছে। আসল মুদ্রা নিশ্চিত হওয়ার পর নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। কিছু গণমাধ্যম জানিয়েছে, হেলিকপ্টার করে তিন বস্তা টাকা পানিতে ফেলা হয়। বিষয়টি অনেকটাই সিনেম্যাটিক। প্রতিবেদনে ভ্রম হয় সিনেমার দৃশ্যের বর্ণনা কিনা! অবশ্য সোমালিয়ান জলদস্যুদের নিয়ে একাধিক সিনেমা এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। হতে পারে সে সব সিনেমার কোন একটা দৃশ্যের সঙ্গে মিল রেখে এমনভাবে বলছেন কেউ কেউ। কারণ জাহাজের মালিকপক্ষ কেএসআরএম নিজ থেকে বলেনি তারা মুক্তিপণ পরিশোধ করেছে।

বাংলাদেশের নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মুক্তিপণ পরিশোধের বিষয় অস্বীকার করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর অবস্থান যৌক্তিক। তার অবস্থানে থেকে মুক্তিপণের বিষয় নিয়ে স্বীকার-অস্বীকার করা যায় না। তিনি বলেছেন, ‘জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে মুক্তিপণ দেয়ার বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই।’

নাবিকদের মুক্তির পর রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বলেছেন, ‘নাবিকদের মুক্ত করতে সোমালিয়া, কেনিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র- এই চার দেশের নিয়মকানুন মেনেই সমঝোতা হয়েছে। সবকিছুই বৈধভাবেই শেষ হয়েছে। তবে সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী অনেক কিছু আমরা প্রকাশ করতে পারছি না।’ সমঝোতার সব শর্ত প্রকাশের কিছু নেই। এখানে এমন কিছু থাকতে পারে যা ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। এটা নিয়ে টানাটানিও তাই অযৌক্তিক।

প্রতিমন্ত্রী বলেননি, কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ বলেনি তারা ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়েছে। সুতরাং কথিত মুক্তিপণের এই অঙ্ক প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা থেকে সরে যাওয়া উচিত আমাদের। কারণ মুক্তিপণের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করা হলে সাগরপথে এইধরনের একটা অঙ্কের খরচ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। গভীর সাগরে জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এবং টাকা দিয়ে উদ্ধার পাওয়ার বিষয়টি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। ভবিষ্যতে এখানে কেউ নতুনভাবে সুযোগ নিতে চাইবে। এখান থেকে বেরুনো যাবে না।

উদাহরণ দিতে গেলে এখানে আসতে পারে, কয়েক বছর আগে একই কোম্পানির আরেকটি জাহাজ সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিল। একশ দিন পর উদ্ধার হয়েছিল সে জাহাজ ও নাবিকেরা। তখনো নাকি এমন মুক্তিপণের বিষয় ছিল। এবারের জিম্মির ঘটনার পর আগের সেই ঘটনার অতি-আলোচনা হয়েছে, এবং সেই অতি-আলোচনা এখানে প্রভাবক হয়ে পড়েছিল কিনা সন্দেহ।

একজন প্রতিমন্ত্রী, একটা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা বলতে পারেন না মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে এনেছি জিম্মি বাংলাদেশিদের। যে অবস্থানে তারা সেটা দায়িত্বশীল অবস্থান, যে বক্তব্য তাদের সেটা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বশীল বক্তব্য; সেটা যদি আমরা বুঝে থাকি, তারা মুক্তিপণের বিষয় যদি স্বীকার করতেন কী প্রভাব পড়তে পারে, সেটা যদি আমরা বুঝে থাকি তবে এও বুঝা উচিত মুক্তিপণকে প্রতিষ্ঠা করা অনুচিত। এর চেষ্টা করা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিষয়টি নিয়ে অযথা টানাটানি না করে অন্যের কাছ থেকে আমরা যেমন দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করি তেমনি নিজেই যেন সেটা অনুশীলনের চেষ্টা করি।

জিম্মি বাংলাদেশিদের ছেড়ে যাওয়ার পর আট জলদস্যু গ্রেফতার হয়েছে- ঠিক এই সংবাদে বুঝার চেষ্টা করুন ছেড়ে কথা বলেনি বাংলাদেশ। নিজেদের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল জলদস্যুদের গ্রেপ্তার। জিম্মি বাংলাদেশিদের জীবন আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারার বাংলাদেশের এই সফল প্রচেষ্টা অভিনন্দনযোগ্য।

জাহানমণি উদ্ধারে লেগেছিল ১০০ দিন; এমভি আব্দুল্লাহকে মুক্ত করতে লেগেছে মাত্র ৩২ দিন। মুক্ত বাংলাদেশিদের অভিনন্দন, ধন্যবাদ সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে।



;

জীবনে সুখী হওয়া



ড. হাসিন মাহবুব চেরী, সিনিয়র স্পেশালিস্ট সায়েন্টিস্ট, ইউকে
জীবনে সুখী হওয়া

জীবনে সুখী হওয়া

  • Font increase
  • Font Decrease

মানুষের বয়স বৃদ্ধির কোনো এক পর্যায়ে জীবনবোধের বিষয়গুলো তীক্ষ্ণ হয়। সে সময় সবার মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসে: কীভাবে জীবনটাকে আরও সুন্দর আর উপভোগ্য করা যায়? কীভাবে দীর্ঘদিন জীবনে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকা যায়?

প্রশ্নটা খুব সহজ হলেও এর উত্তর পাওয়া কিন্তু এতোটা সহজ নয়। এমনকি, সারাটা জীবন সুখ নামের মরীচিকার খোঁজে পাগলের মতো ঘুরেও বেশিরভাগ মানুষই তার দেখা পায় না! আশায় আশায় জীবন কেটে যায়। সুখী হওয়ার আশা পূরণ হয় না।

আসল সমস্যা হলো, জীবনে সুখী হওয়ার জন্যে ছোটোবেলা থেকে আমাদের মস্তিষ্কে চাপ তৈরি করে দেওয়া হয়। মাথার মধ্যে সুখী হওয়ার যে ফরমুলা ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তা হলো নিজেকে সমাজে অনেক সাকসেসফুল করতে হবে। রাত দিন কাজে ডুবে গিয়ে প্রচুর টাকার মালিক হতে হবে, ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, অথবা অনেক ফেমাস কোনো ব্যক্তি হতে হবে। যাতে করে সবাই আপনাকে চেনে, জানে এবং এভাবেই আপনার খ্যাতি অথবা পয়সা আপনাকে সুখ এনে দেবে অটোমেটিক।

কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন! চলুন দেখি এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কি বলছেন। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বিজ্ঞানীরা গত ৭৫ বছর যাবৎ এক গবেষণা চালিয়ে খুঁজে বের করেছেন মানুষের জীবনে সুখী হওয়ার রহস্য। গবেষণাটি শুরু হয় ১৯৩৮ সাল থেকে। গবেষণাটিতে বিজ্ঞানীরা ৭২৪ জন মানুষের জীবনকে গত ৭৫ বছর যাবৎ ফলো করে এসেছেন। এই গবেষণায় তারা ৭৫ বছর ধরে এই প্রত্যেকটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে তাদের শারীরিক ও মানসিক সব রকম পরীক্ষা, ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত করেন।

গবেষণাকালীন দীর্ঘ ৭৫ বছরে এই মানুষদের অনেকেই মারা যায়, কেউবা মদ্যপ হয়, আবার অনেকে নানা রকম মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মানসিক রোগী হয়। অনেকেই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হন, আবার একজন আমেরিকার প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন! অর্থাৎ, বিচিত্র তাদের জীবনের ফলাফল পরিণতি।

শেষ পর্যন্ত এদের সবার জীবন থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে, একমাত্র জীবনে ভালো রিলেশনশিপের উপস্থিতি মানুষকে সুখী এবং দীর্ঘজীবী করে! আর কিছু পাসিং স্যাডো: ভাসমান মেঘের মতো ক্ষণস্থায়ী, হালকা ও অস্থায়ী।

এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা প্রথমেই জোর দিয়েছেন খুব কাছের সম্পর্কের মানুষের সাথে সম্পর্কের কোয়ালিটি নিয়ে। তারা দেখেছেন যেসব মানুষের জীবনে খুব ভালোবাসার এবং নির্ভর করার মতো একজন মানুষও থাকে তারা অনেক সুখী এবং দীর্ঘজীবী হয়।

এই গবেষণায় আরো দেখা যায়, যেসব ব্যক্তি অন্যের সাথে নিজের কোনো কিছু শেয়ার করতে পারে না, খুব ক্লোজ রিলেশনশিপ মেনটেন করতে চায় না বা পারে না, তারা অতি দ্রুত শারীরিক এবং মানসিক অবক্ষয়ের দিকে চলে যায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বারবার জোর দিয়েছেন এমন কাছের মানুষের সাথে সম্পর্ক মেনটেন করতে, যার ওপর আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা রাখা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সারাজীবন বিবাহিত থেকে অশান্তিকর ভালোবাসাহীন জীবন-যাপন করা মানুষের চেয়ে যারা সেই অশান্তি থেকে বের হয়ে এসেছে ডিভোর্সের মাধ্যমে, তারা পরবর্তীতে সুখী এবং দীর্ঘজীবনের অধিকারী হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা যায় যে, ৫০ বছরের পর যেই কাপলদের মধ্যে গভীর ভালোবাসা বজায় ছিল তারা ৯০ বছরের অধিক সময় ধরে বেঁচে আছে।

ভালোবাসার সম্পর্ক বলতে বিজ্ঞানীরা এমনটা বোঝেননি যে ঝগড়া বা ইমোশনাল ups এন্ড downs থাকবে না, বরং বুঝিয়েছেন সব কিছুর পরেও যদি দিনশেষে একে অপরের উপর এই বিশ্বাসটা রাখার মতো সম্পর্কটা হয় যে, আমার এমন একজন আছে, যে আমার বিপদে আমার পাশে আছে, সেটাই পরবর্তীতে সুখী এবং দীর্ঘজীবন যাপনে মূল ভূমিকা পালন করে।

এই গবেষণায় আরেকটি চমকপ্রদ পয়েন্ট উঠে আসে আর সেটি হলো: যাদের জীবনে আস্থা এবং গভীর ভালোবাসার মানুষের উপস্থিতি থাকে, তারা তুলনামূলকভাবে যেকোনো তীব্র ব্যথা অনেক কম অনুভব করেন। যখন ব্যথার তীব্রতা তুলনা করা হয় সেসব মানুষের সাথে, যাদের জীবনে ভালোবাসার সম্পর্ক অনুপস্থিত!

বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় যে বিষয়টার ওপর জোর দিয়েছেন সেটি হলো, ভালো সামাজিক সম্পর্ক তৈরির ওপর। কারণ, দেখা গেছে যেসব মানুষ ভালো সামাজিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে বন্ধু বান্ধবের সাথে, তারা অনেক বেশি সুখী ও স্বাস্থ্যবান জীবন-যাপন করে, যখন তুলনা করা হয় সেসব মানুষের সাথে, যারা অপেক্ষাকৃত একাকী জীবন যাপন করে।

বাস্তবেও একাকিত্ব মানুষকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে, তাদের ব্রেইনের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং তারা অপেক্ষাকৃতভাবে কম দিন বাঁচে। নিঃসঙ্গ ও একাকী মানুষের তীব্র যন্ত্রণার বিষয়গুলোও গবেষণায় উত্থাপিত হয়েছে।

এই গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, মানুষের কতগুলো বন্ধু আছে অথবা সে বিবাহিত কিনা সেটার চেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো তার কয়জন বিশ্বস্ত বন্ধু আছে অথবা তার স্বামী স্ত্রী অথবা প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে তার সম্পর্কের কোয়ালিটিটা কেমন। ৫০ বছর বয়সে যেসব মানুষ তাদের সম্পর্ক নিয়ে satisfied ছিল তারা high cholesterol থাকার পরেও কোলেস্টেরল না থাকা মানুষদের চেয়ে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপন করে।

আরেকটি বিষয় যা গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন তা হলো, যদি কোনো মানুষ একটি securely attached caring রিলেশনশিপে থাকে এবং বিশ্বাস করে যে, সে তার সবচেয়ে কাছের একজনের ওপর নির্ভর করতে পারে, তাহলে এটি তাদের ব্রেইনকে রক্ষা করে এবং তাদের মেমোরি শার্প থাকে ৮০ বছরের পরেও! এই মানুষগুলোর সম্পর্ক যে খুব স্মুথ ছিল তা কিন্তু নয়। বরং প্রতিদিন ঝগড়া করেও যদি দিনশেষে তারা একে অপরের ওপর নির্ভর করতে পারে তাহলে তাদের মেমোরি ও স্বাস্থ্য দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

মোট কথা, গভীর ভালোবাসায় থাকা সম্পর্কের মানুষের জীবন অনেক সুখের এবং তাদের মন, মেজাজ, ব্রেন ও স্বাস্থ্য অনেক ভালো থাকে বলে তারা দীর্ঘজীবী হয়। কেননা গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরযোগ্যতা মানুষকে sense অফ protectovity দেয় এবং সুখী রাখে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- এতো কিছুর পরেও কেন আমরা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে অবহেলা করি? এর উত্তর হলো, মানুষ সহজে যা পেয়ে যায় তার মূল্য দেয় না, আর ভালো রিলেশনশিপ বজায় রাখতে হলে যে মূল্য দিতে হয়, সেটাও মানুষ সহজে দিতে চায় না। ভালো রিলেশনশিপ মেনটেন করা সহজ কাজ নয় এবং এজন্যে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, যা মানুষ সচরাচর করতে চায় না। কারণ তারা সব কিছু রেডিমেড উপভোগ করতে চায়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে: ‘When we love, we always strive to become better than we are. When we strive to become better than we are, everything around us becomes better too.’ — Paulo Coehlo

তাই আসুন ভালোবাসার সম্পর্কগুলোকে যত্ন করি এবং একটি আনন্দময় সুখী সার্থক দীর্ঘজীবনের অধিকারী হই।

;

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দুবাই বৈঠক: বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তাৎপর্য ও করণীয়



ড. মোস্তাফিজুর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

একটি উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সদ্য সম্প্রতি সময়ে সংযুক্ত আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ত্রয়োদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন (২৬ ফেব্রুয়ারি-১ মার্চ ২০২৪) ছিল আলাদাভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সুবিদিত যে, বাংলাদেশ নভেম্বর ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে স্বল্পোন্নত-বহির্ভূত উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। ত্রয়োদশ বৈঠকে (এম. সি. ১৩) বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল ত্রিমাত্রিক পরিচয়কে ধারণ করে: স্বল্পোন্নত দেশ, উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে।

বাংলাদেশকে একদিকে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সাথে সংহতি রাখতে হয়েছে; একই সাথে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে নিজস্ব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে, আবার অন্যদিকে নিকট ভবিষ্যতের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় ও ইস্যু সমূহকেও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। সম্মেলনে নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, এবারের এম.সি. ১৩ তে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দলের প্রস্তুতি ছিল বেশ ভাল। এ ধরণের সম্মেলনের ক্ষেত্রে প্রস্তুতিমূলক আলোচনা সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশের জেনেভাস্থ মিশন জেনেভাতে এম.সি ১২ ও এম. সি. ১৩ এর মধ্যবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে এবং তার সুফল আবুধাবিতে দেখা গেছে। এম. সি. ১৩-তে মাননীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জনাব আহসানুল ইসলাম এম. পি.’র নেতৃত্বে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান ও অন্যান্য সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারি ডেলিগেশন আবুধাবিতে গ্রিনরুম (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাভূক্ত সীমিত সংখ্যক দেশের অংশগ্রহণমূলক আলোচনা) ও সাধারণ আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং দ্বিপাক্ষিক মতবিনিময়ের বিভিন্ন সুযোগকেও কাজে লাগিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে, সর্বক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তসমূহ বাংলাদেশের অনুকূলে এসেছে, যা সম্মেলন শেষে এম. সি. ১৩ এর মন্ত্রীপর্যায়ের ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়েছে।

এবারের মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় ছিল বেশ কয়েকটি: ক) শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত বাজার সুবিধার প্রসারণ; খ) স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে প্রদেয় অন্যান্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রমের সময়-নির্দিষ্ট প্রসারণ, গ) মৎস্যখাতের ভর্তুকির আলোচনায় উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য সময়-নির্দিষ্ট বিশেষ সুবিধা; ঘ) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কার বিষয়ক আলোচনায় বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের স্বার্থের নিশ্চয়তা বিধান। এর বাইরে সরকারি খাদ্য সংগ্রহে প্রদত্ত কৃষি ভর্তুকিকে কৃষিখাতে প্রদত্ত ভর্তুকির সর্বোচ্চ হিসাবের (যা কৃষি জিডিপির ১০% এর সমপরিমাণ) বাইরে রাখা, ই-কমার্সের ওপর ১৯৯৮ সাল থেকে প্রচলিত শুল্ক নিষেধাজ্ঞার সমাপ্তি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রাতিষ্ঠনিক প্ল্যাটফর্মের বাইরে অনুষ্ঠিত বহুপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করার বিষয়ে অবস্থান নির্ধারণ ইত্যাদি।

উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধার প্রসারণ। এ বিষয়ে অবশ্য ইতিপূর্বে, ২৩ অক্টোবর ২০২৩-এ বিশ^ বাণিজ্য সংস্থার সাধারণ অধিবেশনে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যা এম. সি. ১৩-তে অনুমোদিত হয়। এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় প্রণিধানযোগ্যঃ প্রথমত, সিদ্ধান্তটি ‘বেস্ট এনডিয়েভার’ (সেরা প্রচেষ্টা) আকারে গৃহীত হয়েছে, অর্থাৎ এটা মেন্ডেটরি বা বাধ্যতামূলক নয়, বরং সদস্যদের সদিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট সময়ের কথা বলা হয়নি, যদিও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের এ সংক্রান্ত প্রথম প্রস্তাবে ১২ বছরের কথা বলা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ৬-৯ বছরে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। তৃতীয়ত প্রস্তাবটি কেবলমাত্র সেসব দেশের জন্য প্রযোজ্য যাদের স্বল্পোন্নত দেশ-নির্দিষ্ট বাজার সুবিধা স্কিম আছে। উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এধরণের কোন স্কিম নেই, সিদ্ধান্তটি সে দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না।

এতদসত্ত্বেও এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এম. সি. ১৩-এর সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ ও অন্যান্য উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বাজার সুবিধা সম্প্রসারণের একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইউরোপিয় ইউনিয়ন (এভরিথিং বাট আর্মস বা ই. বি. এ.) ও যুক্তরাজ্য (ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ট্রেডিং স্কিম বা ডি. সি. টি. এস) তাদের স্ব-স্ব এলডিসি স্কিম এর মেয়াদকাল উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য উত্তরণ-পরবর্তী আরো তিন বছর বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। অন্য দেশসমূহের সাথে বাজার সুবিধা সম্পর্কিত আলোচনায় এটা একটা মানবিন্দু (রেফারেন্স পয়েন্ট) হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশকে এখন দ্বিপাক্ষিকভাবে কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারতসহ অন্যান্য দেশসমূহের সাথে এম. সি. ১৩ এর সিদ্ধান্তের আলোকে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এম. সি. ১৩-তে এ সিদ্ধান্তও হয়েছে যে, উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে কারিগরি সহায়তা ও সক্ষমতাবৃদ্ধিমূলক সাহায্য উত্তরণ পরবর্তীতে আরো তিন বছরের জন্য প্রদান করা হবে।

গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি সিদ্ধান্ত হল-উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহ স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অনুরূপ ডিউ রেসট্রেইন্ট (যথাযথ সংযম) সুবিধা উত্তরণ-পরবর্তী আরও তিন বছরের জন্য ভোগ করতে পারবে। এর অর্থ হল-স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর তিন বছর পর্যন্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যভূক্ত কোন দেশ এসব দেশের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিরোধ নিষ্পত্তি বডি (ডিসপিউট সেটেলম্যান্ট বডি)-তে নালিশ করতে পারবে না।

স্বল্পোন্নত দেশগুলি এর বাইরে যেসব সুবিধা ভোগ করে সেসবগুলিও যাতে উত্তরণ-পরবর্তীতে তারা বাড়তি সময়ের জন্য ভোগ করতে পারে এমন একটি প্রস্তাবও রাখা হয়েছিল উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থসমূহ বিচেনায় রেখে। তবে এ সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত এম. সি. ১৩-এ গৃহীত হয়নি। মেধাসত্ব অধিকার, ওষুধ ও মেধাসত্ব অধিকার, রপ্তানিতে ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি ইস্যুতে বাড়তি সময় সুবিধা ভোগ করতে সমর্থ হলে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহ, বিশেষ করে বাংলাদেশ, উপকৃত হত। এম. সি. ১৩ এর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, এ সম্বন্ধীয় আলাপ-আলাচেনা জেনেভাতে অব্যাহত থাকবে এবং এম. সি. ১৪-তে এ বিষয়ে আলোচনার ফলাফল উপস্থাপন করা হবে। জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশন নিশ্চয়ই এম. সি. ১৩ পরবর্তী আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব (তথাকথিত এনেক্স ২ প্রস্তাব) এর প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। বিশেষত বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের বিকাশে মেধাসত্ব অধিকার বিষয়ক নমনীয়তার যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে তা সুবিদিত।

মৎস্য খাতে ভর্তুকি বিষয়ক আলোচনায় কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়নি, যদিও নিয়মবহির্ভূত, অনথিভূক্ত, অপ্রতিবেদিত মৎস্য শিকারের ক্ষেত্রে প্রদেয় ভর্তুকির প্রেক্ষিতে একটি সিদ্ধান্ত এম. সি. ১২-তে গৃহীত হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে প্রদেয় ভর্তুকি হ্রাস ছিল মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে যাতে মৎস্য খাতে ভর্তুকী প্রদানের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অনুরূপ সুবিধা দেয়া হয়; বাংলাদেশ সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিল, জেনেভাতে এ বিষয়ে যে টেক্সট নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে মতৈক্যে পৌছান সম্ভব হয়নি (এ সংক্রান্ত টেক্সট-এ অনেক ব্র্যাকেট থেকে গিয়েছিল)। আবুধাবিতে বিশেষতঃ ভারতের সাথে উন্নত ও ধনী দেশসমূহের ভর্তুকি বিষয়ে বিরাজমান বড় পার্থক্যের নিরসন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের যুক্তি ছিল ছোট ও আর্টিসানাল মৎস্য শিকারের ক্ষেত্রে প্রদেয় ভর্তুকির ক্ষেত্রে কোন ধরণের সীমা আরোপ করা যাবে না (অন্ততঃ ২৫ বছরের জন্য)। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ ছিল ভারতের অনুরূপ, বিশেষতঃ আগামীর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে।

সামুদ্রিক মৎস্য শিকারে ভর্তুকির ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রাপ্তির জন্য বিশ^ সামুদ্রিক মৎস্য শিকারের ০.৮% এর একটি সীমারেখা আলোচ্য টেক্সটে ছিল, যে সীমারেখাটি বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ সচেষ্ট ছিল (যেহেতু ইলিশকে সামুদ্রিক মাছ হিসেবে গণ্য করলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য শিকার ০.৮% এর সীমারেখা অতিক্রম করে)। আলোচ্য টেক্সটে বৃহৎ মৎস্যশিকারী দেশসমূহের বড় বড় সামুদ্রিক মৎস্যশিকারী কোম্পানিসমূহের জন্য প্রদত্ত ভর্তুকির বিষয়ে যেসব ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, সে বিষয়েও অনেক উন্নয়নশীল দেশের জোরাল আপত্তি ছিল। অবশ্য এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়া ও স্থিতাবস্থা বিরাজমান থাকায় বাংলাদেশের সংক্ষুব্ধ হবার তেমন কোন কারণ নেই। তবে এম. সি. ১৩ ও এম. সি. ১৪ এর অন্তবর্তীকালীন আলোচনায় বাংলাদেশকে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ-এ দ্বিবিধ স্বার্থ বিবেচনায় রেখে অংশগ্রহণ করতে হবে।

কৃষিখাত সংক্রান্ত ‘পিস ক্লজ’ এর আলোচনায় বেশ বড় ধরণের মতপার্থক্য থেকে যায় যার কারণে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রদেয় কৃষি খাতের ভর্তুকি ১০% সীমা অতিক্রম করে যদি সরকারি খাদ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রদত্ত ভর্তুকি এ হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়; ভারতের যুক্তি ছিল এ ভর্তুকি ‘গ্রিন সাবসিডি’র অনুরূপ যেহেতু এর লক্ষ্য হল প্রান্তিক মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা। বেশ কিছু দেশ এর বিরোধিতা করে এই যুক্তি দিয়ে যে, এই খাদ্যের একটি অংশ ভারত আবার রপ্তানিও করে। ভারতের দাবি ছিল ‘পিস ক্লজ’-কে চিরস্থায়ী করা। অন্য বেশ কয়েকটি দেশের অবস্থান ছিল, এ সংক্রান্ত আলোচনা কৃষি খাত বিষয়ক বৃহত্তর পরিসরের আলোচনার অংশ হতে হবে। শেষ অবধি দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে এ বিষয়ে কোন ঐক্যমতে পৌছান সম্ভব হয়নি।

ই-কমার্সের ওপর শুল্ক আরোপে যে নিষেধাজ্ঞা ১৯৯৮ সাল থেকে বর্তমান, সে বিষয়ে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের অবস্থান ছিল, এতে ই-পণ্য ও সেবা রপ্তানিকারক উন্নত দেশগুলিই লাভবান হচ্ছে; আর আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশসমূহ শুল্ক আহোরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এক অর্থে এই যুক্তি প্রযোজ্য। সিপিডি-র গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকার এ নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য কিছুটা মিশ্র। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রক্ষণাত্মক স্বার্থ (ডিফেন্সিভ ইন্টারেস্ট) যেমন আছে, তেমনি আছে আক্রমণাত্মক স্বার্থ (অফেন্সিভ ইন্টারেস্ট)। তার কারণ বাংলাদেশ সেবাখাতে রপ্তানিও করে থাকে এবং নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে গন্তব্য দেশসমূহে রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপিত হবে যা এসব রপ্তানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আবুধাবিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যদি পরবর্তী আলোচনায় অগ্রগতি না হয় তাহলে ৩১ মার্চ ২০২৬ বা এম. সি. ১৪ এ দুটোর মধ্যে যেটিই আগে আসবে সে তারিখ থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রপ্তানির ওপর কোনো শুল্ক বসবে না (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য), এমন একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে বাংলাদেশের জন্য তা ইতিবাচক হবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কার বিষয়ক আলোচনা জেনেভা ও পরবর্তীতে আবুধাবি এম. সি. ১৩-তে বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্মর্তব্য যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ডি. এস. বি. বর্তমানে অনেকাংশে অকেজো হয়ে আছে কারণ সংস্কার আলোচনার পরিসমাপ্তি ব্যতিরেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডি. এস. বি.’র আপিল বডিতে কোন নিয়োগ প্রদান করতে বাধা দিচ্ছে। অথচ ডি. এস. বি.’-কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘জুয়েল ইন দি ক্রাউন’ বলা হয় যা এ সংস্থাকে ব্যতিক্রমী বিশিষ্টতা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশকিছু উন্নত রাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে ব্যাপক সংস্কারের অনুপস্থিতিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও চলমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দুটোরই বিরোধিতা করে আসছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ঐকমতভিত্তিক সিদ্ধান্ত ‘সব কিছুতে সহমত না হলে কোন কিছুতেই সিদ্ধান্ত নয়’ (নাথিং ইজ এগ্রিড আনলেস এভরিথিং ইজ এগ্রিড) এবং ‘একক অঙ্গীকার’ (সিঙ্গল আন্ডারটেকিং) -এসব পদ্ধতিগত বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বেশ কিছু উন্নত দেশের পক্ষ থেকে। বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এসব ক্ষেত্রে অনেকটাই অনড়। এসব বিষয়ে আবুধাবিতে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। উন্নয়নশীল দেশসমূহের অবস্থান হল সংস্কারের নামে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাতে যেন শক্তিশালী ও উন্নত দেশসমূহের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা না করা হয় এবং যে কোন সংস্কার কর্মসূচির নামে এ সংস্থার ‘উন্নয়ন মাত্রা’ (ডেভেলপমেন্ট ডাইমেনশন) যেন দুর্বল না হয়।

আবুধাবিতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারত, বাংলাদেশের মত দেশসমূহ অংশগ্রহণ না করলেও ‘বহুপাক্ষিক আলোচনা’ (প্লুরিলেটারেল ডিসকাশন) ক্রমান্নয়ে অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। বিনিয়োগ (ইনভেস্টমেন্ট ফেসিলেটেশন ফর ডেভেলপমেন্ট), পরিবেশ (ট্রেড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সাসটেইনেবিলিটি, স্ট্রাকচারড ডিসকাশন), ই-কমার্স (জয়েন্ট ইনিশেয়েটিভ অন ই-কমার্স) ও অন্যান্য ইস্যুর ওপর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম সমূহের বাইরে অনেক সদস্য দেশ শুল্ক হার, রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন সংক্রান্ত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

উদ্দেশ্য হল, ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে এসব আলোচনাকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মূলধারাতে নিয়ে আসা। আবুধাবিতে এভাবেই সেবা সংক্রান্ত অভ্যন্তরীন রেগুলেশন্সকে প্লুরিলেটারেল থেকে বহুপাক্ষিক রূপ দেওয়া হয়েছে, যা পরবর্তীতে সবার জন্য ‘মোস্ট ফেবারড নেশানন্স বা এম. এফ. এন.’ ভিত্তিতে প্রয়োগ হবে। পূর্বেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো কোন প্লুরিলেটারেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি যদিও বেশ কিছু সংখ্যক স্বল্পোন্নত দেশ বেশ ক’টিতে সক্রিয় আছেঃ যেমন-বিনিয়োগ সংক্রান্ত আলোচনায় ২৫টি স্বল্পোন্নত দেশ অংশগ্রহণ করছে। এসব আলোচনায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ করা সমীচীন হবে। তাহলে রুলস নির্ধারণে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ প্রভাব রাখতে পারবে এবং উন্নয়নশীল দেশ সমূহের স্বার্থরক্ষায় অবদান রাখতে পারবে।

স্বল্পোন্নত দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন আলোচনায় ধারাবাহিতভাবে উদ্যোগী ও অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। আগামীতে এ ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে, একই সাথে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের স্বার্থও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ সরকার টেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে, যার অধীনে সাতটি উপ-কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ‘স্মুথ গ্রেজুয়েশন’ এর লক্ষ্যে এসব সাব-কমিটি অনেকগুলি সুনির্দিষ্ট পরামর্শও প্রণয়ন করেছে। লক্ষ্য ও সময় নির্দিষ্টভাবে এগুলি বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সাথে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীনে উন্নয়নশীল সদস্য দেশসমূহকে যেসব বিশেষ ও বিভাজিত (স্পেশাল অ্যান্ড ডিফারেনসিয়াল) সুবিধা দেওয়া হয়েছে এবং উত্তরণশীল স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ক্ষেত্রে যেসব বিদ্যমান সুবিধা আছে (যেমন টেকনোলজি ব্যাংক এবং বাণিজ্যের জন্য সহায়তা ফান্ড থেকে উত্তরণ-পরবর্তী আরো পাঁচ বছরের জন্য সহায়তা প্রাপ্তি, এল. ডি. সি. ক্লাইমেট ফান্ড, লিগ্যাল সাপোর্ট) সেগুলিরও সুযোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের জন্যও টেকসই এল. ডি. সি. উত্তরণ-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি মূল করণীয় হতে হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এম. সি. ১৩ পরবর্তী আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ইস্যুতে নিজস্ব অবস্থান নির্ধারণ, এসব আলোচনার অভিঘাত বিচার-বিশ্লেষণ ও তার প্রেক্ষিতে কৌশল নির্ধারণ। স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে উত্তরণের পূর্বে কেমেরুনে ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য এম. সি. ১৪-ই হবে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শেষ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। এসবের প্রেক্ষিতে এম. সি. ১৩ এর পরবর্তীতে জেনেভায় পরিচালিত বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।

লেখক: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

;

সময়ের পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



সায়েম খান
সময়ের পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ

সময়ের পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ

  • Font increase
  • Font Decrease

সপ্তম শতাব্দীতে গৌড় সাম্রাজ্যের সার্বভৌম নৃপতি ও বাংলা অঞ্চলে একীভূত রাষ্ট্রের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা ছিলেন রাজা শশাঙ্ক। রাজা শশাঙ্ক ছিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ভূবনেশ্বর পর্যন্ত একচ্ছত্র অধিপতি। তাকে অনেক ইতিহাসবিদ 'গৌড়াধিপতি'ও বলে থাকেন। আজ থেকে একহাজার ৪শ বছর আগে রাজা শশাঙ্কের শাষণামলে তার রাজ্যাভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে সৌরপঞ্জিকার ভিত্তিতে তিনি বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে এই রাজ্যাভিষেককে ঘিরে নানা উৎসব ও আয়োজনের মাধ্যমে প্রজাদের নিয়ে এই দিনটি উদযাপন করতেন বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্ক। এজন্য বাংলা নববর্ষের ১২ মাসের নাম নক্ষত্রের নামানুসারে রাখা হয়। 'বিশাখা' নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, 'জায়ীস্থা' থেকে জ্যৈষ্ঠ, 'শার' থেকে আষাঢ়, 'শ্রাবণী' থেকে শ্রাবণ, 'ভদ্রপদ' থেকে ভাদ্র, 'আশ্বায়িনী' থেকে আশ্বিন, 'কার্তিকা' থেকে কার্তিক, 'আগ্রায়হণ' থেকে অগ্রহায়ণ, 'পউস্যা' থেকে পৌষ, 'ফাল্গুনী' থেকে ফাল্গুন এবং 'চিত্রা' নক্ষত্র থেকে চৈত্র, এমন করেই নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়।

কালের বিবর্তনে সেই বঙ্গাব্দ হয়ে যায় ইতিহাস। ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে শুরু হয় মোগলদের শাসনামল। মোগলদের শাসনামলে চন্দ্রপঞ্জিকার ভিত্তিতে আরবি মাস গণনার মাধ্যমে "তারিখ-এ-এলাহী" হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রচলন ঘটানো হয়। "তারিখ-এ-এলাহীর" ১২ মাসের নাম ছিল 'কার্বাদিন', 'আর্দি', 'বিসুয়া', 'কোর্দাদ', 'তীর', 'আমার্দাদ', 'শাহরিয়ার', 'আবান', 'আজুর', 'বাহাম' ও 'ইস্কান্দার মিজ'।

মাসের এই শব্দগুলো আসলে আরবি ও ফার্সি শব্দ থেকে উদ্ভুত। কিন্তু মোগলদের ও প্রজাদের সমস্যা তৈরি হয় কর আদায়ের ক্ষেত্রে। মোগলদের শাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতবর্ষের ভূমি ও কৃষি কর আদায়ের ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষ বা 'হিজরি' সালকে অনুসরণ করা হতো। কৃষকেরা চাষাবাদ করতেন সৌরবর্ষের ভিত্তিতে আর মোগলদের শাসন ব্যবস্থা ভূমি ও কৃষিকর আদায় করতেন চন্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে।

চন্দ্রবর্ষ অনুসরণ করলে কর আদায়ের সময় কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করা যেতো না। কারণ, হিজরি বর্ষের শুরুতে প্রজা সাধারণের কাছে অর্থের অভাব থাকতো। কিন্তু কৃষকেরা নবান্নে ফসল ঘরে তোলার পর বঙ্গাব্দের শুরুতে তাদের কাছে অর্থের জোগান থাকে। সেই ক্ষেত্রে তারা ন্যায্য কর প্রদানে বাধাগ্রস্ত হয় না। এহেন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সম্রাট আকবরের দরবারে ডাক পড়ে মোগল সাম্রাজ্যের সেই সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি'র।

সম্রাটের আদেশে তাকে এই সমস্যার সমাধান করতে বলা হয়। ফতেহউল্লাহ সিরাজি তখন সৌরবর্ষ (বঙ্গাব্দ) ও হিজরি বর্ষকে একীভূত করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই বছরের নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ থেকে বাংলা সন করা হয়। বাংলা সনের শুরুর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিনে জনসাধারণ কর প্রদান করতে আসতেন রাজ দরবারে। সম্রাট আকবরের পক্ষ থেকে তাদের মিষ্টি বিতরণ করা হতো ও প্রজাদের চিত্ত বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

মোগল সম্রাট আকবরের প্রজাকর আদায়ের এই দিবস সময়ের পরিক্রমায় বাংলা সনের প্রথম দিন 'পহেলা বৈশাখ' হিসেবে রূপান্তরিত হয় বাঙালি সভ্যতার ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাগরিত হয় এই উৎসব। বাংলা বর্ষবরণের এই মহোৎসব উদযাপিত হয়, গোটা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। যদিও পহেলা বৈশাখ পালন নিয়ে এখনও কিছু বিভেদ আমরা লক্ষ করি। হিন্দু সম্প্রদায়ের তিথি পঞ্জিকা অনুসারে, পহেলা বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গে পালিত হয় ১৫ এপ্রিল। আর বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির নির্দেশনা অনুযায়ী, গ্রেগরিয় পঞ্জিকা অনুসারে পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ১৪ এপ্রিল।

পহেলা বৈশাখ মূল: প্রাচীন হিন্দু নববর্ষ উৎসবের সাথে সম্পর্কযুক্ত যা সনাতন ধর্মের বিক্রমী দিনপঞ্জির সাথে মিল আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে রাজা বিক্রমাদিত্য বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাব করেন বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। যদিও বিক্রমাদিত্যের বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাব নিয়ে অনেক ইতিহাসবিদ দ্বিমত পোষণ করেন।

প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মাঝে বাংলা নববর্ষ পালনের রীতি পরিলক্ষিত হয়। ভারতের আসাম রাজ্যে অসমীয়রা "রঙালি বিহু "উৎসবে মেতে ওঠেন বর্ষবরণের শুরুর এই দিনে। 'বিহু' অসমীয়দের ফসল কেটে ঘরে তোলার পর আনন্দে মেতে ওঠার একটি উৎসব যা বাংলা নববর্ষেরই অনুরূপ। ঠিক তেমনইভাবে ভারতের শিখধর্মের লোকেরাও "বৈশাখী" নামে পহেলা বৈশাখের দিনে উৎসব উদযাপন করেন। একইভাবে থাইল্যান্ডেও "ফ্যাসটিভাল অব ওয়াটার" বা পানি উৎসব নামে বর্ষবরণ উদযাপিত হয়, যাকে থাই ভাষায় বলা হয়ে থাকে 'সংক্রান'। পানি উৎসব দিয়ে বছর শুরুর দিনটি উদযাপনের চিত্র আমরা দেখতে পাই, আমাদের দেশের কিছু প্রাচীন নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের মাঝে।

আধুনিককালে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়, ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পূজা অর্চনার মাধ্যমে। একবিংশ শতাব্দীতে নববর্ষ উদযাপনে আমরা দেখতে পাই, এক বাণিজ্যিক ধারার রূপ। বহু প্রাচীন এই উৎসবের ধারায় নেই আগের মতো কোনো স্বকীয়তা। কর্পোরেট কালচার ও পুঁজিবাদের চাপে জৌলুসময় পহেলা বৈশাখ যেন ব্যবসায়িক ফায়দার একটি পন্থা বৈ আর কিছুই নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একত্রে মিলে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মাধ্যমে নতুন দিনের ও নতুন বছরের সূচনা হোক এক সুখময় আবেশে।

সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট

;