জার্মানির সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হচ্ছে আজ

, আন্তর্জাতিক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-06-27 06:29:05

দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রেখে জার্মানির সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি কার্যকর হচ্ছে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন)। এর ফলে আরো বেশি মানুষ জার্মানির নাগরিকত্ব অর্জনের সুযোগ পাবেন। আইনটির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর উপর দৃষ্টি দিয়েছে ইনফোমাইগ্রেন্টস।

জার্মানির বার্তাসংস্থা ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেডারেল সরকারের তথ্য অনুযায়ী, জার্মানিতে নাগরিকত্ব অর্জনের হার ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড়ের অর্ধেক।

জার্মানির মোট জনসংখ্যার অন্তত ১৪ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ মানুষের কাছে দেশটির নাগরিকত্ব নেই৷ অন্তত ৫.৩ শতাংশ মানুষ গত ১০ বছর ধরে জার্মানিতে বসবাস করছে। 

জার্মান পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগে সংস্কার প্রস্তাব পাস হওয়ার প্রায় সাত মাস পর ২৭ জুন থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে আইনটি। এ আইন কার্যকর হলে আট বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর পার হলেই জার্মান নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করতে পারবেন অভিবাসীরা।

জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মূলত পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে আইনটি৷ এগুলোর মধ্যে আছে, নাগরিকত্ব অর্জনের প্রক্রিয়া গতিশীল করা, দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রাখা, বিশেষ যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেয়া, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সহজ করা, ‘অতিথি কর্মীদের’ প্রজন্মকে লাইফটাইম, অ্যাচিভমেন্ট বা আজীবন সম্মাননা দেয়া এবং বেশি সংখ্যক অভিবাসীর জার্মান নাগরিক হওয়ার সুযোগ।

আইনটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে বসবাসরত বিদেশিরা আট বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর পরই নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করতে পারবেন।

জার্মান নাগরিকের সঙ্গে কারো বিয়ে হলে, চার বছর পরই তিনি নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনের সুযোগ পাবেন।

আবেদনকারীদের মধ্যে যারা জার্মান সমাজের মানিয়ে নেয়ার (ইন্টিগ্রেশন) ক্ষেত্রে ‘বিশেষ সাফল্য' দেখাতে পারবেন, তারা তিন বছর পরই নাগরিকত্ব চাইতে পারবেন। বিশেষ সাফল্যের মধ্যে রয়েছে: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো ফল করা, কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করা, ভাষাগত দক্ষতা এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে পারদর্শিতা।

জার্মান ফেডারেল পরিসংখ্যান অফিস জানিয়েছে, ২০২২ সালে জার্মানির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষের অভিবাসন সম্পর্কিত ইতিহাস রয়েছে।

জার্মানির পাসপোর্ট পেতে বা নাগরিক হতে হলে আগের মতো নিজ দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে না কোনো বিদেশিকে। ২৭ জুন থেকে কার্যকর হচ্ছে এই সুবিধাটিও।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জার্মানির নাগরিকত্ব অর্জনের সময় কোনো শর্ত পূরণ ছাড়াই আবেদনকারী তার আগের নাগরিকত্ব ধরে রাখতে পারবেন। ফলে জার্মানির পাসপোর্ট নিতে গিয়ে নিজ দেশের পাসপোর্ট ছাড়ার আক্ষেপও আর থাকবে না।

তবে আবেদনকারীর নিজ দেশ দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখার সুযোগ দেয় কিনা বা এ বিষয়ে জার্মান সরকারের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের কোনো চুক্তি আছে কিনা বিষয়টি তার ওপরও নির্ভর করবে।

নবজাতকদের বিশেষ সুবিধা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে জার্মানিতে বিদেশি পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নেয়া শিশু ‘নিঃশর্তভাবে জার্মান নাগরিকত্ব পাবে।

এমনকি জার্মান বংশোদ্ভূত শিশুরাও এখন তাদের পিতা-মাতার নাগরিকত্ব ধরে রাখতে পারে, যদি তাদের মধ্যে একজন নিয়মিতভাবে অন্তত (আট বছর থেকে কমিয়ে) পাঁচ বছর জার্মানিতে বাস করেন৷

অতিথি কর্মী প্রজন্মের সদস্যরা ভাষাগত দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারলেই জার্মান নাগরিকত্ব পাবেন৷ জার্মান ন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়ার পরীক্ষা দেয়ারও প্রয়োজন হবে না তাদের৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা ‘নিত্যদিনের জীবনে’ জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারেন।

অতিথি কর্মীদের প্রতি বিশেষ সম্মান জানাতেই তাদের জন্য এই সহজ ব্যবস্থা নিয়েছে জার্মানি৷

১৯৫০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জার্মানিকে পুনর্গঠনে সহায়তা দিতে অনেক তুর্কি নাগরিক আসেন জার্মানিতে৷ তাদেরকে জার্মান ভাষায় ‘গাস্টআরবাইটার' বা ‘অতিথি কর্মী' বলা হয়৷ এতদিন তাদের কেউ জার্মান নাগরিক হতে চাইলে ছাড়তে হতো তুরস্কের নাগরিকত্ব৷

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, জার্মান নাগরিকত্বের জন্য আবেদনকারী কোনো বিদেশির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার রেকর্ড থাকলে তার আবেদন গৃহীত হবে না। তবে ছোটখাটো অপরাধ আমলে নেবে না কর্তৃপক্ষ। কোনো অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় কেউ যদি সর্বোচ্চ ৯০ দিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকেন, তবে সাজাভোগের পর তিনি বা তারা নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনের যোগ্য হবেন।

তবে একটি ব্যতিক্রম থাকছে। যদি একজন অভিবাসী ‘ইহুদিবিদ্বেষী, বর্ণবাদী বা অন্যান্য অমানবিক কাজের' জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়, সাজার মেয়াদ যা-ই হোক না কেন, তাকে আর নাগরিকত্ব দেয়া হবে না।

নাগরিকত্ব পেতে হলে বিদেশিদের অবশ্যই নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের সামর্থ্য থাকতে হবে। কারণ, জার্মান সোশ্যাল কোডের দ্বিতীয় ও দ্বাদশ ধারা (এসজি টু ও টুয়েলভ) অনুযায়ী, তাদের সরকারি কল্যাণ ভাতায় যুক্ত করা হবে না।

আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে যাদের আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, অর্থাৎ ডুলডুং প্রক্রিয়ায় জার্মানিতে দীর্ঘসময় থাকতে পারছেন, তারা নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য হবেন না।

মাইগ্রেশন মিডিয়া সার্ভিসের একটি সমীক্ষা বলছে, জার্মানির ৫০টি বড় শহরে বর্তমানে অন্তত দুই লাখ চার হাজার আবেদন প্রক্রিয়াধীন আছে। সংখ্যাটি ২০২৩ সালে জার্মানিতে মোট নাগরিকত্ব অর্জনের চেয়েও বেশি৷ জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হামবুর্গে ২৫ হাজার ৬০০ মানুষ নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করেছেন।

গত বছর নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনের সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় অন্তত ১৯ ভাগ বেড়েছিল। আর সংখ্যাটি ২০২০ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

ক্ষমতাসীন জোট সরকারের এমন উদ্যোগের কারণে আগামীতে নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনের সংখ্যা আরো বাড়বে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জার্মান বার্তা সংস্থা ডিপিএ জানিয়েছে, নাগরিকত্বের আবেদন বেড়ে যাওয়ার কারণে চাপের মুখে পড়তে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো৷ তাই পুরো প্রক্রিয়াটিকে ডিজিটালাইজড করার বিষয়ে মনোযোগী হয়েছে সরকার৷

মাইগ্রেশন মিডিয়া সার্ভিসের সমীক্ষা বলছে, জার্মানির প্রায় প্রতিটি শহরে নাগরিকত্বের আবেদনে এগিয়ে আছে সিরীয়রা। এরপর আছে ইরাকি ও তুরস্কের নাগরিকেরা। গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই দৌড়ে ইরানি ও আফগানিদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

উল্লেখ্য, চলতি জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো ফল করেছে জার্মানির রক্ষণশীল বিরোধী দল সিডিইউ/সিএসইউ। দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে কট্টর ডানপন্থি এএফডি। কিন্তু জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারভুক্ত দলগুলোর অবস্থানি তলানিতে। ফলে এই আইনি সংস্কারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এই গ্রীষ্মের শেষে কিংবা আগামী বছরের শরতে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ নির্বাচন৷ বর্তমানে জার্মান রাজনীতিতে বেশ চাঙা রয়েছে বিরোধী দল সিডিইউ/সিএসইউ৷ তারা যদি আগামীতে ক্ষমতায় আসে তাহলে নাগরিকত্বের আইনের এসব সংস্কার বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে৷

এ সম্পর্কিত আরও খবর