কেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা যিলযালে বলেছেন, ‘যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে, যখন সে তার বোঝা বের করে দেবে এবং বলবে, তার কি হলো? সেদিন সে তার বৃত্তান্ত বর্ননা করবে, কারণ আপনার পালনকর্তা তাকে আদেশ করবেন। সেদিন যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হয়। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎ কর্ম করলে দেখতে পারবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে তাও দেখতে পাবে।’
আলেমরা বর্ণনা করেছেন, প্রত্যেক মানুষের প্রতিটি মুহূর্তের কাজকর্ম, কথাবার্তা কমপক্ষে পাঁচ জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়। সেগুলো হলো স্বয়ং আল্লাহর কাছে একটি, আসমান ও জমিনে একটি করে এবং ফেরেশেতা (কেরামান-কাতেবিন) মানুষের কাজকর্ম রের্কড করছেন। এগুলো কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা মানুষকে সচিত্র দেখাবেন। এসব রের্কডে যদি পাপের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে দোজখে যেতে হবে আর যদি পূণ্যের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে বেহেশতে স্থান হবে। অর্থ্যাৎ গোপনে বা আল্লাহর রের্কডের বাইরে কোনো পাপ কাজ করা সম্ভব নয়। তাই শয়তানের প্রলোভনে কোনো পাপ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক তওবা করে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা নিতে হবে। সুতরাং আমাদের সব কাজের সময় আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করতে হবে। ফলে আমরা পাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারবো এবং পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাব।
পবিত্র আশুরার দিনে ফেরাউন লোহিত সাগরে ডুবে মরেছিল। ফেরাউনের মৃত্যু সর্ম্পকে কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আজ আমি তোমার (ফেরাউন) দেহ রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্পর্কে উদাসীন।’ -সুরা ইউনুস : ৯২
তাফসিরবিদরা বলেছেন, আল্লাহতায়ালার আজাব দেখে ফেরাউন তওবা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার তওবা গৃহীত হয়নি। আল্লাহতায়ালা তাকে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছেন। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, পরবর্তীদের জন্য ফেরাউনের লাশ সংরক্ষিত রাখা হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহর এই ঘোষণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে আসমানি ধর্মগ্রন্থ বিশেষজ্ঞ ড. মরিস বুকাইলি লিখেছেন, সব সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে লোরেট ১৮৯৮ সালে রাজাদের উপত্যকায় (কিংস ভ্যালি) থিবিসে দ্বিতীয় রামাসিসের পুত্র ও মহাযাত্রাকালীন ফেরাউন মারনেপতাহর (মিনফাতাহ) মমি করা লাশ আবিষ্কার করেন। সেখান থেকে তা কায়রোয় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯০৭ সালের ৮ জুলাই এলিয়ট স্মিথ এ মমির আবরণ অপসারণ করেন। তিনি তার ‘দ্য রয়্যাল মমিজ’ নামক গ্রন্থে (১৯১২) এর প্রক্রিয়া ও লাশ পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
কয়েক জায়গায় কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও মমিটি তখন সন্তোষজনকভাবেই সংরক্ষিত ছিল। তখন থেকেই তার মাথা ও গলা খোলা। অবশিষ্ট দেহ কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় দর্শকদের দেখার জন্য কায়রো জাদুঘরে রাখা আছে। সম্ভবত ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় লাশের ঢাকনা আর খুলতে দেওয়া হয় না। ১৯১২ সালে এলিয়ট স্মিথের তোলা ছবি ছাড়া পুরো লাশের আর কোনো ছবিও জাদুঘরে নেই।
আবিষ্কৃত হওয়ার আগে মমিটি তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে থিবিসের কবরস্থানে ছিল। বর্তমানে মমিটি একটি সাধারণ কাচের আবরণে রাখা আছে। প্রাচীনকালে গুপ্তধন সন্ধানী তস্কররা হয়তো এর কিছুটা ক্ষতি করে থাকতে পারে, কীটের আক্রমণও হয়ে থাকতে পারে। তবে অবস্থা দেখে মনে হয়, বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সে তুলনায় মমিটি তখন অনেক অনুকূল পরিবেশে ছিল।
ঐতিহাসিক চিহ্ন-দ্রব্য সংরক্ষণ করা মানুষের স্বাভাবিক কর্তব্য। কিন্তু এ মমির ক্ষেত্রে সেই কর্তব্য অনেক বেশি বড় ও ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ এ মমি হচ্ছে এমন একজনের লাশের বাস্তব উপস্থিতি, যে হজরত মুসা (আ.)-কে চিনত। তার পরও সে তার হেদায়েত প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার পলায়নকালে তার পশ্চাদ্ধাবন করেছিল এবং সেই প্রক্রিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে। আর কোআন মাজিদের বর্ণনা অনুযায়ী তার লাশ পরবর্তী মানুষের জন্য নিদর্শনস্বরূপ। আল্লাহর হুকুমে তা ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম সাগরতীরে যেখানে ফেরাউনের লাশ সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, আজও জায়গায়টি অপরিবর্তিত আছে। বর্তমানে এ জায়গার নাম জাবালে ফেরাউন বা ফেরাউন পর্বত। এরই কাছাকাছি আছে একটি গরম পানির ঝরনা। স্থানীয় লোকেরা এর নাম দিয়েছে হাম্মামে ফেরাউন। এর অবস্থানস্থল হচ্ছে- আবু জানিমের কয়েক মাইল ওপরে উত্তরের দিকে। স্থানীয় লোকেরা জায়গাটি চিহ্নিত করে বলে, ফেরাউনের লাশ এখানে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
১৯০৭ সালে স্যার গ্রাফটিন এলিট স্মিথ তার মমির ওপর থেকে যখন পট্টি খুলেছিলেন তখন লাশের ওপর লবণের একটি স্তর জমাট বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এটি লবণাক্ত পানিতে তার ডুবে যাওয়ার একটি সুস্পষ্ট আলামত ছিল।
স্মরণ রাখতে হবে, ফেরাউন কেবল একজন ব্যক্তির নাম নয়, সে যুগে মিসরের সব বাদশাহকে ফেরাউন উপাধি দেওয়া হতো। হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে যে ফেরাউনের মোকাবেলা হয়েছিল, কেউ কেউ তার বলেছেন দ্বিতীয় রামাসিস। আর কেউ কেউ বলেন, সে ছিল দ্বিতীয় রামাসিসের পুত্র মারনেপতাহ বা মিনফাতাহ।