দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান
প্রকৃত বিস্ময়ের তখনও কিছু বাকি। কাদামাটি-লাগা হাত ডোবায় ধুয়ে নিতে গিয়ে খায়ের দেখলো ডোবার পানি দেখতে কেমন অস্বাভাবিক দেখায়। কিন্তু কয়েকদিন আগেও ব্যাপারটা ছিল না। তাহলে কী ডোবার পানি দূষিত হয়ে পড়লো এরিমধ্যে। আঁজলা ভরে জল নিয়ে চোখের কাছে ধরতেই সে লক্ষ্য করলো একটা তেলতেলে ভারি ধরনের তরল জল সে ধারণ করে রয়েছে। পানিতে তৈলাক্ত কিছু মিশে আছে। জিভে পরখ করে দেখলে কষা আর বিস্বাদ লাগে। তারপর খায়ের কৌতূহল পরিপূর্ণরূপে মেটানোর জন্যে মগ ভরে পানি নেয় ডোবা থেকে। দেখে মনে হয় কেউ যেন তেল মিশিয়ে দিয়েছে ডোবার পানিতে। ভোজবাজি নয়তো-ভাবলো খায়ের। আগুনের প্রসঙ্গে জান্নাত বেশ খুশিই হয় যখন তার হাতেনাতে ফল হিসেবে পাওয়া যায় স্বামীর হাতে বানানো গরম চা। কিন্তু তৈলাক্ত জলের কথা ভেবে সে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে আগুন আবার তার সঙ্গে-সঙ্গে পানির তৈলাক্ত হয়ে যাওয়া সবই তার একটা অশুভ বার্তার আভাস বলে মনে হতে থাকে। খায়ের তাকে চিন্তামুক্ত করে। প্রথমত আগুন আর তৈলাক্ত পানির কথা যতটা সম্ভব গোপন রাখা চাই। তাদের ঘরটা এক প্রান্তে এবং সুপুরি গাছের পাতা দিয়ে সেটির চারদিক ঘেরা থাকায় কারও পক্ষে সে-সংবাদ পাওয়া সম্ভব নয়ও তবু যে-কেউই এসমস্ত আবিষ্কারের খবর জেনে ফেলতে পারে। হঠাৎ করে কেউ হাঁটতে-হাঁটতে এদিকটায় এসে পড়লে তাকে ঠেকানো সম্ভব না-ও হতে পারে। খায়ের বোঝাতে থাকে জান্নাতকে। তার কণ্ঠে আশ্বাস-বার্তা। নিশ্চয়ই তাদের এই ঘর যেখানটায় তার নিচে প্রচুর পরিমাণে মজুদ রয়েছে গ্যাস। আবার, গ্যাসের পাশাপাশি তেলের মজুদও থাকা সম্ভব। কিন্তু জান্নাতের দুর্ভাবনা তাতে কমে না। তার জিজ্ঞাসা, তেল-গ্যাস দিয়ে তারা করবে কী! খায়ের বলে,
: হোনো, গ্যাস দিয়া কী করন যায় হেইডা তো তুমি নিজের চোহেই দেখলা। আর সত্য-সত্য যদি তেল থাইক্যাই থাহে তাইলে এই পানি এই যে আগুন দেখতাছো হেই আগুনে জাল দিয়া আমরা তেল করমু। তারপর সেই তেল দেখবা কত কী কাজে লাগতাছে। তেল দিয়া আবার রান্না করন যায়, বাত্তি জালান্ যায়, ভাগ্য ভাল হইলে হেই তেল দিয়া গাড়িও চালান যায়। আমাগো অবশ্য গাড়ি নাই কিন্তু তেল বেচলে হেই তেলের ট্যাহা দিয়া গাড়ি কিনন কোনো ব্যাপারই না!
আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-১)
মোটামুটি ব্যাপারটা এতদূর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। সেটা ছিল, ধরা যাক সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত। আবুল খায়েরের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ছিল দিনের আলোতেই। ফলে, রাতের বাস্তবতা তার ভাবনাতে কী করে যেন অনুপস্থিত থেকে যায়। আর রাত নামতেই দ্রুত পটপরিবর্তনের ফলে সবকিছু এলোমেলো হওয়ার লক্ষণ প্রকট হতে থাকে এবং পুরো ব্যাপারটার নিয়ন্ত্রণও আর আবুল খায়েরের হাতে থাকলো না। দিনের আলো উদ্ভূত অগ্নিশিখাকে শোষণ করে নিলে সেই আগুন দূর থেকে আর তত দর্শনযোগ্য হয় না। কিন্তু যখন সন্ধ্যা হয়, ভাল করে রাত হয়, গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় অন্ধকার তখন এক ফুটের মত উঁচু শিখাকেও তীব্র আর ভীতিকর দেখায়। ঘরের ভেতর থেকে সেই শিখা দেখে অবাক হয়ে যায় জান্নাত। ঐটুকু শিখার আলো অনেকটা জায়গা আলোকিত করে দেয়। এমন অনিঃশেষ আলোকশিখা হঠাৎ ভয়ও ধরিয়ে দেয়। জান্নাত ভাবে, এমন যদি হয়, এই শিখা ধীরে-ধীরে তার সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে অকস্মাৎ প্রবল বেগে বিপুল ধাবমানতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে, তাহলে! তাহলে কী সে এবং তার স্বামী পারবে সেই বিস্তৃতিকে থামাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে। ঐটুকু শিখাকে মগের পানি ঢেলেও নেভানো যায় নি। বিস্তৃত শিখাকে তারা সামলাবে কী করে। আরেক ভয় চেপে ধরে তাকে। এমন যদি হয়, তারা গভীর নিদ্রার জগতে বিভোর হয়ে রয়েছে আর তখন আগুনের শিখা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ ও বৃহত্তর হতে-হতে নিদ্রিত তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল, তাহলে! মনের ভয়টাকে স্বামীর নিকটে প্রকাশ না করে পারে না জান্নাত-
: আইচ্ছা, আমারে কও তো, আগুন যদি নাকি বাইড়্যা যায়, বাইড়্যা গিয়া যদি নাকি আমাগো ইদিকে আউগাইয়া আহে তাইলে তো আমাগো ঘর-টর সব পুইড়্যা ছাই অইয়া যাইবো! তহন কী অইবো?
: হ, তোমারে কইছে! বাড়লে এতক্ষণে বাইড়্যা যাইতো, বুঝছো? আগুন বাড়বো না। তুমি নাক ডাইক্যা ঘুমাইতে পারবা। আর সহালবেলা ঘুম থেইক্যা উইঠ্যা দেখবা আগুন যেমন ছিল তেমনই জ্বলতাছে। আর রাইতের মধ্যে যদি জইম্যা থাকা গ্যাস শেষ অইয়া যায় তাইলে আর আগুন জ্বালাবো না।
যেটুকু ঘুমের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল খায়েরের আশ^স্তিমূলক কথায় সেটাও উবে গেল রাত না-বাড়ার আগেই। কৌতূহলী দ্বীপবাসীদের কয়েকজনের নজরে আসে খায়েরের বাড়ির ডোবার জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা। তারা দূর থেকে আলোকময় আভা লক্ষ করে কেবল কৌতূহলের বশেই এগোয়। অনেকেই রাতে ডোবা-পুকুরের কিনারায় হ্যারিকেন হাতে নিয়ে কোঁচ দিয়ে মাছ মারে। সুস্বাদ বেলে মাছগুলো তখন কিনারার মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। উৎসাহীরা আগুয়ান হয়, পরিচিত হলে বলে, কী, কেমন পাইল্যা মাছ? আর অপরিচিত হলেও মাছ সম্পর্কেই আলাপ আরম্ভ করে। জনাতিনেক লোক জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছিল খানিকটা দূর দিয়েই। কিন্তু আগুন দেখে তারা এগোয়। প্রথমে ভাবে, ভূতের আগুন জ্বলে। খালে-বিলে-মাঠে-প্রান্তরে অনেক সময় এমন আগুন জ্বলতে তারা শুনেছে এবং দেখেছেও। ভয়-উৎকণ্ঠা আর কৌতূহলে তিনজনের সাহস একজোট করে তারা সন্নিকটে আসে। এসে দেখে শুধু আগুনই জ্বলে না, জ্বলতে থাকা আগুনকে আসলে জ্বালানোও হচ্ছে। খায়ের-নির্মিত চিহ্নিত ব্যূহ এবং চুল্লির কাঠামো তাদের সামনে উদ্ঘাটিত হলে তারা নিশ্চিত বুঝতে পারে, সন্নিহিত গৃহবাসীরা প্রাকৃতিকভাবে লব্ধ গ্যাসে রান্নাবান্নার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তাদের পারস্পরিক আলাপ আর কথকতায় সাড়া পেয়ে খায়ের আঙ্গিনায় এসে দেখে পশ্চিম পাড়ার কাসেম, লতিফ আর হাশেম জটলা করে আগুন এবং গ্যাস বিষয়ে আলাপরত।
আবুল খায়ের তাদের একবিন্দু মিথ্যে বলে না। তার সদ্য বিয়ে করা সৌভাগ্যের চিহ্ন জান্নাতের বুদ্বুদ দেখা থেকে শুরু করে তার আগুন জ্বালিয়ে চা বানিয়ে খাওয়া সবটাই সে উপস্থাপন করে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। যদিও ডোবার তৈলাক্ত জলের ব্যাপারটা সে গোপন রাখে। তারপর, উৎসাহী সেই দ্বীপবাসীদের প্রস্থানের পর খায়ের আর জান্নাত আগুনকে সাক্ষী রেখে ঘুমাতে যায়। মাঝে-মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে তারা দু’জনেই শয্যা ছেড়ে উঁকি মেরে দেখে, আগুন জ¦লেই চলেছে। এভাবে তাদের রাত শেষ হয়, তখনও শেষ হয়ে যায় না আগুন। ভোর হতে না হতেই শুরু হয় প্রকৃত ঘটনা বা ঘটনার প্রতিক্রিয়া। আগুনের ফলও তাকে বলা যেতে পারে। একে-একে লোকেরা আসতে থাকে দ্বীপের নানা দিক হতে। লোক থেকে লোকান্তর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আগুন প্রায় সারা দ্বীপে। পঁচিশ বর্গমাইলের দ্বীপে আগুনের খবর ছড়াতে পঁচিশ মিনিটও লাগে না। আগুন দেখতে আসে পরিচিত অপরিচিত লোকেরা। অধিকাংশ লোকই খায়েরদের অচেনা। কিন্তু তারা এসে পরিচিত হয় খায়েরদের সঙ্গে। তারা বলে, আগুন যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে বলতে হবে খায়ের যথার্থই ভাগ্যবান। এখন আগুন যেহেতু খায়েরের আঙ্গিনার ধারে, তার বউ জান্নাত আগুনের স্বকীয় অধিকারে আপনমনে নির্দ্বিধায় তার রান্নার কাজ সেরে নিতে থাকে। তাতে কারও আপত্তিও থাকে না। তবে, জান্নাতের রান্নার কাজ শেষ হলে অদূরের পশ্চিম পাড়ার সেই লোকেদের বাড়ির সদস্যরা হাড়িপাতিল সঙ্গে এনে নিজ-নিজ রান্নার কাজ সেরে নেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে খায়ের এবং জান্নাত দেখল, আগুনের প্রকৃত মালিক তো প্রকৃতিই। আগুন তো নিজেই জ¦লে যেতে থাকবে। কেউ যদি সেই জ্বলতে থাকা আগুনকে কাজে লাগিয়ে একটু উপকৃত হয় হোক না, ক্ষতি কী! খায়ের বলে, তোমরা তোমগো রান্না করবা, আমাগো আপত্তি কিসের! আমাগো রান্না তো আমরা সাইর্যা ফেলছি। ব্যাপারটা একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিণতির মধ্য দিয়ে মীমাংসিত হয়ে যায়। এর মধ্যে জটিলতার কোন ইঙ্গিত থাকবার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, খায়ের বলে লোকেদেরকে, দোয়া করো যাতে এই আগুন না নিভ্যা যায়। নিভ্যা গেলে তো সব শেষ। যে-ক’দিন কপালে থাহে আগুনরে লাগান যাইবো কাজে।
আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-২)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-৩)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৪)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৫)
চলবে...
৭তম পর্ব পড়ুন আগামী শুক্রবার