সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প

কোলাজ মন্তাজ



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের ধনী লেখক হন ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে আর সেরা বই বিবেচিত হয় টাইমের বিবেচনায়। বাংলা সাহিত্যে শুধুমাত্র লেখালেখি করে ধনী হয়েছিলেন মাত্র দুইজন। একজন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অন্যজন হুমায়ূন আহমেদ। বর্তমানে বিশ্বের ধনী লেখক হ্যারি পটারখ্যাত জে কে রাউলিং। তিনি বছরে ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছেন। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড’ বইটির জন্য প্রচুর পরিমাণে টাকা আয় করেন তিনি। বইটি ২০১৬ সালের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছিল। তাছাড়া হ্যারি পটারের জন্য ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস এবং হোয়ার টু ফাইন্ড দেম সিনেমা দুটির জন্যও নগদ অর্থ পেয়েছেন রাউলিং। ১৯৯৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনবার ধনী লেখকের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছেন এই কল্পকাহিনী লেখক।

জে কে রাউলিং

বিশ্বজুড়ে হ্যারি পটারের সিরিজগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। প্রাপ্তবয়স্কদেরও রূপকথার জগতে দিনরাত বিচরণ করতে বাধ্য করেছেন। জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত তাঁকে অনেক কঠিন সময়ের মুখোমুখী হতে হয়েছে। একটি কন্যা সন্তানসহ তাঁকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই তিনি শুধুমাত্র অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে লেখালেখি শুরু করেন। পরপর ১২টি প্রকাশনা সংস্থার ফিরিয়ে দেওয়ার পর অবশেষে ১৩ নম্বর সংস্থাটি বইটি প্রকাশ করতে সম্মত হয়, এরপর শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে রাউলিং ১৯৯০ সালে পর্তুগালে পাড়ি জমান। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় পর্তুগিজ সাংবাদিক জর্জ আর্নেটসের সাথে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা বিয়ে করেন এবং ১৯৯৩ সালে জেসিকা নামে তাঁদের একটি মেয়ের জন্ম হয়। জেসিকার জন্মের অল্পকিছুদিনের মধ্যেই জর্জের সঙ্গে রাউলিংয়ের দাম্পত্য কলহ শুরু হয় এবং তা বিবাহবিচ্ছেদে গড়ায়। জর্জের সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে রাউলিং জেসিকাকে নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবুরোতে ফিরে এসে তাঁর ছোটবোন দাইয়ের সাথে থাকতে শুরু করেন। স্কটল্যান্ডে ফিরে রাউলিং তাঁর মেয়েকে নিয়ে দারুণ আর্থিক অনটনের শিকার হন। মেয়ে এবং নিজের জন্য কোনোভাবেই যথেষ্ট অর্থের যোগাড় করতে না পেরে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যেই তিনি হ্যারি পটারের প্রথম বইটি লিখতে শুরু করেন। ব্রিটিশ লেখক ও সিনেমার চিত্রনাট্যকার জোয়ান রাউলিংয়ের জেকে রাউলিং ছদ্মনাম নেওয়ার পেছনে কিন্তু একটা ইতিহাস আছে। একজন নারীর লেখা বই কম বিক্রি হতে পারে এই কারণে তিনি তাঁর মূল নামের বদলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর দিয়ে তাঁর ছদ্মনামটি তৈরি করেন। তাঁর মূল নামের সাথে কোনো মধ্যবর্তী নাম (middle name) না থাকলেও তিনি ছদ্মনামের সাথে ‘K’ অক্ষরটি যোগ করেন তাঁর দাদী ক্যাথরিনের সম্মানে।

আরো পড়ুন ➥ শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’

তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই। বাবা ছিলেন এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার পিটার জেমস রাউলিং, এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল এ্যান রাউলিং। ১৯৯৭ সালে তাঁর প্রথম বই ‘হ্যারি পটার এ্যান্ড দি ফিলোসফারস্ স্টোন (Harry Potter and the Philosopher’s Stone)’ প্রকাশিত হওয়ার আগে তিনি তাঁর এক সন্তানকে নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবুরোতে অর্থনৈতিকভাবে খুবই বাজে অবস্থায় বসবাস করতেন। কিন্তু শিশুতোষ রূপকথার বইটি প্রকাশ হওয়ার পর রাতারাতি আন্তর্জাতিক বেস্টসেলারে পরিণত হয় এবং রাউলিং পরিণত হন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন বড় লেখক হিসেবে। ১৯৯৯ সালে যখন হ্যারি পটারের প্রথম তিনটি বই নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার তালিকার প্রথম তিনটি জায়গা একসাথে দখল করে নেয় তখন পৃথিবীর সাহিত্যজগৎ আরো একবার নড়েচড়ে বসে। এরপর একে একে হ্যারিপটার সিরিজের আরো চারটি বই বের হয়—এবং প্রতিটি বই আগেরটির থেকে বেশি সাফল্য লাভ করে। হ্যারি পটার সিরিজের মোট সাতটি বই আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৫ কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। হ্যারি পটারের বইগুলো থেকে বানানো প্রতিটি সিনেমাই ব্লকবাস্টার হিট। ছবিগুলো সবগুলো মিলিয়ে আয় করেছিল ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রথম সিরিজের সফলতার পর রাউলিং এরপর একে একে আরো বেশ কয়েকটি বই বের করেন। ২০১২ সালে বের হওয়া তাঁর ‘ক্যাজুয়্যাল ভ্যাকেন্সি (Casual Vacancy)’ বইটি দারুণ প্রশংসা কুড়ায়—যার প্রধান কারণ ছিল হ্যারি পটারের ছায়া থেকে সম্পূর্ণভাবে এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। বইটিতে ফ্যান্টাসির বদলে ছিল নির্মম বাস্তবতার এক অদ্ভুত প্রতিফলন। অনেক পাঠক অবশ্য হ্যারি পটারের মতো কিছু একটা আশা করে বইটি পড়া শুরু করে হতাশও হয়েছিলেন। এরপর ২০১৩ সালে রবার্ট গ্যালব্রেইথ (Robert Galbraith) ছদ্মনাম নিয়ে “Cuckoo’s Calling” নামে আরো একটি বই বের করেন তাঁর বিখ্যাত নামের ছায়া থেকে বের হয়ে এসে। ২০১৬ সালে তিনি আরো একবার হ্যারি পটারের জগতে প্রবেশ করেন মঞ্চনাটক ‘হ্যারি পটার এ্যান্ড দি কার্সড চাইল্ড (Harry Potter and the Cursed Child)’ এবং সিনেমা ‘ফ্যান্টাসটিক বিস্টস্ এ্যান্ড হয়্যার টু ফাইন্ড দেম (Fantastic Beasts and Where to Find Them)’-এর মাধ্যমে। প্রথমটির গল্প গড়ে উঠেছে হ্যারি পটার সিরিজ শেষ হওয়ার ঊনিশ বছর পরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, আর ফ্যান্টাস্টিক বিস্ট-এর কাহিনী গড়ে উঠেছে হ্যারি পটার সিরিজের ঘটনা শুরুর বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

ড্যান ব্রাউন

ড্যান ব্রাউনও ধনী লেখকদের একজন। জনপ্রিয় মার্কিন থ্রিলার লেখক। জন্ম ১৯৬৪ সালের ২২ জুন। তার বেশিরভাগ উপন্যাসই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ওপর নিজের কল্পনা মিশ্রিত। তিনি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠেন দ্য ভিঞ্চি কোড বইটি লিখে। ২০০৩ সালে এই বইটি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। এ পর্যন্ত তাঁর লেখা বই বিশ্বের ৫২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ২০ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে পৃথিবীর প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির অন্যতম তিনি। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বই হলো ডিজিটাল ফোর্টট্রেস, ডিসেপশন পয়েন্ট, দ্য ভিঞ্চি কোড, অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমন্স, দ্য লস্ট সিম্বল ও ইনফার্নো। তার গল্পের গতি এবং বাঁক সত্যিই পাঠককে মুগ্ধ করে। বিস্মিত হয়ে উপভোগ করতে হয় তার বইগুলো। কিন্তু তার জীবনও সুখের ছিল না একসময়। আর্থিক অনটনে ভুগতে হয়েছে তাকেও। আসুন তার মুখেই শুনি তার কথা—

“আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না। তাই আমি যা পেতাম, তা-ই পড়তাম। আমার সবচেয়ে পুরনো স্মৃতি হলো মেডেলিন এল ইঙ্গলসের অ্যা রিঙ্কল ইন টাইম বইটি। এটি নিয়ে আমি বুঁদ হয়ে থাকতাম। আমার মনে পড়ে, আমি যখন বইটি অর্ধেক শেষ করেছি, মা তখন এসে বললেন, এখন ঘুমানোর সময়। কিন্তু আমি বইয়ের চরিত্রগুলো নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলাম যে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন যখন বইটি শেষ করলাম, তখন আমার চোখে পানি। কারণ, সেটা ছিল একটা সুখের সমাপ্তি। বইটির আবেগ আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল, প্রতিটি চরিত্রকে আমি অনুভব করছিলাম। এসব সেই মুহূর্ত, যখন আমি গল্প বলার জাদু এবং ছাপার অক্ষরের শক্তিকে বুঝতে শিখলাম। আমি প্রকৃতপক্ষে অসংখ্য বইয়ের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছি। আমি এবং আমার বোন প্রতি সপ্তাহে এক্সেটার পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম এবং দুই হাত ভর্তি করে আমাদের পছন্দের বই নিয়ে বাসায় ফিরতাম। এগুলোর মধ্যে থাকত ড. সিউস, রিচার্ড স্কারি, কিউরিয়াস জর্জ, মেডেলিন এবং বাবার। আমরা যখন বড় হয়ে উঠছিলাম, আমার মনে পড়ে, প্রতি রাতেই মা-বাবা আমাদের গল্প পড়ে শোনাতেন। তাঁদের মুখেই আমার অনেক গল্প শোনা—‘মেক ওয়ে ফর ডাকলিং’, ‘দ্য ভেলেভটিন র্যাবিট’, ‘চিকেন স্যুপ উইদ রাইস’। কিন্তু যে গল্পটি আমার ছোট্ট মনোজগৎকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি ছিল ‘হোয়ার দ্য ওয়াইল্ড থিংগস আর’। আমার পরিবারে অগডেন ন্যাশের কবিতা খুব পড়া হতো, যেটা আমার লেখার ওপর অনেক প্রভাব ফেলেছে।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে আছেন জন স্টেইনবেক। তাঁর গল্পের স্থানগুলো আমাকে মুগ্ধ করে। আমি বিস্মিত হয়ে উপভোগ করি রবার্ট লুডলামের গল্পের জটিল পটভূমি। শেক্সপিয়ার তাঁর ভাষাশৈলি দিয়ে চিরকালই আমাকে পথ দেখিয়ে এসেছেন। আমি প্রচুর নন-ফিকশন পড়ি। এর কারণ রিসার্চ ও আনন্দ লাভ করা। কিন্তু যখন আমি ফিকশন পড়ি, আমি সব সময়ই থ্রিলার পড়ি। যে থ্রিলারগুলো শুরুর কয়েক অধ্যায়ই আমাকে ধাঁধায় ফেলে দেয়, সেগুলোই আমার সবচেয়ে পছন্দের। আমি মনে করি, একটি ভালো থ্রিলার অবশ্যই আমাকে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে কিছু শেখাবে। কোমা, দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর, দ্য ফার্ম—এই থ্রিলারগুলো আমার মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটেছে, বাস্তব জগৎকে নতুনভাবে বুঝতে শিখিয়েছে; একই সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাবমেরিন প্রযুক্তি ও আইন সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি যখন কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে বের হলাম, আমার হাতে দুটি পথ খোলা ছিল। দুটিই ছিল আমার ভালোবাসার কাজ—গল্প লেখা অথবা গান লেখা। আমি বেশ কিছুদিন হলিউডে ছিলাম, গান লেখার জন্য। কিন্তু গানের জগতে আমি খুব বেশি সাফল্য পাইনি। কলেজ থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে লেখা আধুনিক উপন্যাস পড়িনি, চিরন্তন ক্লাসিক উপন্যাসগুলোই ছিল আমার আকর্ষণের কেন্দ্রে। ১৯৯৪ সালে তাহিতিতে ছুটি কাটানোর সময় আমি সিডনি শেল্ডনের লেখা ডুমসডে কন্সপিরেসি-এর একটি পুরনো কপি সাগরপাড়ের একটি দোকানে পাই। বইটির প্রথম পৃষ্ঠা পড়া শুরু করলাম, এরপর দ্বিতীয় পৃষ্ঠা—এভাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমি বইটি শেষ করি। এটি শেষ করে একটি চিন্তাই আমার মাথায় আসে—আরে, এটা তো আমি লিখতে পারি। এভাবেই গল্প লেখার জগতে আমার প্রবেশ। ডিজিটাল ফোর্টট্রেস (১৯৯৬) ছিল আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম। কারণ, পাঠকেরা বইটি পছন্দ করেছে। যদি তারা না করত, হয়তো আমি আবার গান লেখার জগতে ফিরে যেতাম। আমি একজন শিক্ষক এবং প্রচুর বই পড়েছি। এই বইগুলোর কাহিনী ও চরিত্রবিন্যাস নানাভাবে সজ্জিত হয়েছে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমি এগুলো নিয়ে আলোচনা করি। এতে করে আমি আমার গল্পে নতুন ধারণা পাই এবং এটা আমার গল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে। যারা নতুন লিখছে কিংবা স্বপ্ন দেখছে যে একদিন তাদের লেখাও ছাপা হবে, তাদের জন্য একটাই পরামর্শ থাকবে, আর সেটা হলো বাজারে বিক্রির জন্য বই লেখো। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে তোমাকে গোয়েন্দা গল্পই লিখতে হবে। ব্রিজেস অব মাডিসন কাউন্টি অথবা কোল্ড মাউন্টেইন—বইগুলো কিন্তু ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা ভেবেই লেখা। লেখার ক্ষেত্রে দুটি জিনিস সব সময়ই মেনে চলতে হবে। প্রথমত, চিত্রপটকে কাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, চিত্রপটকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজাতে হবে। তুমি যদি কোনো স্কুলের কাহিনী লেখো, কিন্তু সেই স্কুলের কোনো গোপন ঘটনা কিংবা স্কুলের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য না বলো, তাহলে তোমার কাহিনী অনাকর্ষণীয় হতে বাধ্য। এটা খুবই মজার, যখন আমি সাহিত্যের কোনো আঙিনায় নিজেকে স্থান দেব, সেটা ভাবি। কিন্তু আমি কেবল সে রকম গল্পই লিখি, আমি নিজে যে রকম গল্প পড়তে চাই। সহজ কথায় বলতে গেলে আমি নিজের জন্যই লিখি।’’

স্টিভেন কিং

মার্কিন লেখক স্টিভেন কিংয়ের বই বিক্রি হয় বিশ্বজুড়ে। তার মোট বিক্রিত বইয়ের পরিমাণ ৩৫ কোটি কপির বেশি। তিনি ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশন মেডেল পান। এছাড়াও তিনি ব্রাম স্টোকার অ্যাওয়ার্ডস, ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ডস, ব্রিটিশ ফ্যান্টাসি সোসাইটি অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেন। তার অনেক বই থেকে চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ, মিনি সিরিজ, কমিকস নির্মিত হয়েছে। তার লেখা বিখ্যাত দুটি ছোটগল্প হচ্ছে ১৯৮২ প্রকাশিত অ্যাপ্ট পিউপিল, ২০০২ সালে প্রকাশিত ১৪০৮ অল দ্যাট ইউ লাভ উইল বি ক্যারিড অ্যাওয়ে। আর বিখ্যাত উপন্যাসগুলো হলো—ক্যারি, দ্য শাইনিং ইট, দ্য ডার্ক টাওয়ার, রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাঙ্ক রিডেম্পশন, আন্ডার দ্য ডোম, দ্য বডি। তিনিও বিলিওনার। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের সম্পর্কে এভাবে বলেন, “আমি কখনো ভাবতে পারতাম না গল্প লেখেই ধনী হওয়া যায়! তাও আবার হরর মুভি। এখন বিজ্ঞানের যুগ। মানুষ তো জানে হররের যুগ নেই আর। তবু কেন পড়ে হরর গল্প বা দেখে মুভি? আমার ধারণা মানুষের অবচেতনে এমন কিছু কাজ করে যে সে একটু রহস্য পছন্দ করে। আমি পাঠকের কাছে এ রহস্যই বিক্রি করে ধনী হয়েছি। আমার কৈশোর সুখের ছিল না। যে এলাকায় থাকতাম সেটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিষণ্ণ। আমাদের পরিবারে অনেক সময় বিকালে নাস্তা করার অবস্থাও ছিল না। তাই রাতের খাবার এমন এক সময় খাওয়া হতো যে না সন্ধ্যা না রাত। সেসব দিনকে এখন খুব মিস করি।’’

জন গ্রিশাম লিগ্যাল

জন গ্রিশাম লিগ্যালকে বলা হয় থ্রিলার ফিকশনের রাজা। নব্বই দশক থেকে প্রতি বছরই একটি করে প্রকাশিত হওয়া গ্রিশামের বই নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার লিস্টে স্থান পেয়েছে। তাও আবার ১ বা ২ নম্বর অবস্থানে থেকেই। নব্বইয়ের দশকে লেখক জন গ্রিশাম ক্যারিয়ারের চরম ফর্মে ছিলেন। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বিশটিরও বেশি থ্রিলারের সব বই ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। নব্বই দশকের থ্রিলার লেখক বলতেই সবার আগে চলে আসে এই লেখকের নাম। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত টানটান উত্তেজনার একটি অবিশ্বাস্য লেভেলের থ্রিলার জন গ্রিশামের ‘দ্য পার্টনার’। এটির মতো আরো অসাধারণ থ্রিলার রয়েছে এই লেখকের। দ্য পার্টনারের চমত্কার কাহিনী ছাপিয়ে উঠে এসেছে কিভাবে অতি সূক্ষ্মভাবে একটি ক্রাইম করতে হয় এবং সেই ক্রাইম থেকে কিভাবে নিজেকে মুক্ত করতে হয়। তার বয়স যখন সাত তখন তিনি পরিবারের সঙ্গে মিসিসিপিতে বসবাস শুরু করেন। তিনি একটা সময় হতাশা তেকে ড্রাগস নেওয়া শুরু করেছিলেন। সেসময়ই অপরাধজগতের কিছু বন্ধু জুটে যায়। যদিও তিনি নিজে কোনো অপরাধ করেননি কিন্তু অপরাধী বন্ধুদের গল্প শুনতেন এবং যতটুকু যেভাবে পারেন সাহায্য করতেন। এ জন্যই অপরাধ জগৎটা তার মুখস্থ। এগুলোই পরবর্তী সময়ে তাঁকে থ্রিলারে নিয়ে আসে। এখন সুখী মানুষ। বিলিওনার। ড্রাগস তো তরুণ বয়সেই রিহ্যাবে গিয়ে ছেড়েছিলেন। এখন সানসেটের পর বেলকনিতে বসে সমুদ্রের জোয়ার দেখতে দেখতে মাত্র ছয় আউন্স হুইস্কি খান।

জেমস পেটারসন

জেমস পেটারসন নামের সঙ্গে অনেকেই খুব বেশি পরিচিত নিশ্চয়ই। বিখ্যাত সাহিত্যিক জেমস পেটারসন রচিত অ্যালেক্স ক্রস সিরিজের বইগুলো প্রায় ২৫ বছর ধরে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। এর প্রত্যেকটি বই সব সময় বেস্ট সেলার হয়ে এসেছে। তবে এর মধ্যে অ্যালং কেম এ স্পাইডার-এর কথা না বললেই নয়। এর কাহিনীতে দেখা যায়, এক নিখোঁজ মেয়ে, নাম ম্যাগি রোজি। যার বাবা-মা নৃশংসভাবে খুন হন। কিন্তু খুনি থাকেন প্রাথমিক স্কুলের এক সাধারণ শিক্ষক, যে কিনা নিজেকে অতি বুদ্ধিমান মনে করেন। তিনি একের পর এক খুন করেই যান। এই খুনিকে খুঁজতে বের হন বিখ্যাত গোয়েন্দা অ্যালেক্স ক্রস। এরপরই ঘটতে থাকে নানা রোমহর্ষক ঘটনা। ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ জেমস পেটারসন জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৭১ বছর। তিনি প্রতিদিন ভোরে উঠে লিখতে পছন্দ করেন। তার লেখনীর শক্তি অসাধারণ এ কথা বলাই বাহুল্য। থ্রিলার, রহস্য উপন্যাস, রোমান্স ইত্যাদি নানা রকম লেখায় তিনি ইতোমধ্যে কিংবদন্তি। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সিরিজ হলো ‘উইমেন্স মার্ডার ক্লাব’। এই সিরিজের সর্বশেষ বই ১৬ সডোকশন এবারে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

আরো পড়ুন ➥ সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা

এর কাহিনী অনেকটা এ রকম—পনেরো মাস আগেও আদরের ছেলে আর চৌকস স্বামীকে নিয়ে ডিটেকটিভ লিনসে বক্সারের জীবন ছিল ছবির মতো। সানফ্রানসিসকোতে এক বোমা হামলায় নিহত হলো ১৫ জন। লিনসে তার স্বামীর সহায়তার বোমা হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। কিন্তু এই মামলা যখন কোর্টে ওঠে, তখন সরকারি উকিল গাফিলতি থাকার ইঙ্গিত করে আঙুল তোলেন লিনসে ও তার স্বামীর বিরুদ্ধ। লিনসে নিজেকে ও তার স্বামীকে নির্দোষ প্রমাণে কিভাবে ষড়যন্ত্রের জাল খুলল, এই নিয়েই কাহিনী। বর্তমানে শিশুদের বই পড়তে উৎসাহিত করতে এবং অভিভাবক ও শিক্ষকদের শিশু-কিশোরেরা কী বই পড়তে পারে, তা জানাতে তিনি রিডজকিডোরিড (readzkiddoRead.com) নামের একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন।

ই এল জেমস

ব্রিটেনে যৌনতানির্ভর উপন্যাস লিখে ধনী হয়েছেন এক নারী, যার নাম ই এল জেমস। এ বইয়ের মাধ্যমেই ই এল জেমস বিশ্বের সেরা ধনীর তালিকায় প্রবেশ করেন। বইটির বিষয়বস্তু যৌনতা। ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’ বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে টানটান উত্তেজনা। ব্যবসায়ী ক্রিস্টিয়ানো গ্রের সঙ্গে সাহিত্যের ছাত্রী অ্যানাস্টাসিয়া স্টিলের প্রেমের গল্প নিয়ে রচিত হয়েছে এই উপন্যাসটি। বহুল বিক্রিত এই উপন্যাসটির অপর দুটি সিকুয়েন্স হচ্ছে ‘ফিফটি শেডস ডার্কার’ আর ‘ফিফটি শেডস ফ্রিড’। এই তিনটি বই মিলে একটি রেকর্ড করেছে তা হলো, তিনসপ্তাহে এই সিরিজের তিনটি বইয়ের মোট দেড় কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এই সিরিজ নিয়ে চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে। এটি বানিয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

ইএল জেমসের ইরোটিক এই উপন্যাসটির কাহিনী গড়ে উঠেছে কলেজ শিক্ষার্থী আনাস্তাসিয়া স্টিলির দিকে থেকে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগে তিনি রহস্যময় এবং বিয়ের উপযুক্ত শতকোটিপতি ক্রিস্টিয়ান গ্রের ইন্টারভিউ নেন তার স্কুল পেপারের জন্য। তিনি সাংবাদিকতায় পড়ছিলেন না। ইন্টারভিউটি নেওয়ার কথা ছিল সাংবাদিকতায় পড়ে তার এমন এক রুমমেটের। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আনাস্তাসিয়া তার হয়ে ইন্টারভিউ করতে যান। প্রথম দেখার পর থেকেই আনা ক্রিস্টিয়ান গ্রেতে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। ক্রিস্টিয়ান যখন আনার টেপ রেকর্ডার নিয়ে উসখুস করেছিলেন তখন স্নায়বিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় আনা চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল এবং ঘাম ঝরতে শুরু করে। তার সামনে কথা বলতে গিয়েও আনা তোতলাতে শুরু করেন। আর ক্রিস্টিয়ানের শান্ত কিন্তু কঠোর মেজাজ আনার হার্টবিটও বাড়িয়ে দিচ্ছিল কয়েকগুণ। স্বাভাবিকভাবে ক্রিস্টিয়ানও আনার প্রতি ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু ঠিক কী কারণে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। আনা ছিল অস্থির প্রকৃতির। কলেজের পড়া শেষ করার পর কী করবে সে ব্যপারেও তার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আর আনা কিছুটা অগোছালোও ছিল। কিন্তু কথা বলার ফাঁকে আনা যখনই তার নিচের ঠোঁটটি কামড়ে ধরতেন তা দেখে কী এক অজানা কারণে যেন ক্রিস্টিয়ান নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারতেন না। এরপর একদিন ক্রিস্টিয়ান আনার কর্মস্থলে গিয়ে হাজির হন। প্রায়ই দামি সব উপহার কিনে পাঠান। ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে করে ঘুরতে নিয়ে যান। এতে আনার আশেপাশের অন্যান্য পুরুষরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। রোমান্টিক মনে হচ্ছে কি এতটুকু জেনে আপনাদের? মোটেই কিন্তু তা না। এখানে এসেই রয়েছে আখ্যানের বড় মোচড়।

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

একটা সময়ে ক্রিস্টিয়ানের অবিবাহিত থাকার কারণ জানা যায়। তিনি আসলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাসত্ব ও আধিপত্য চান। তিনি ধর্ষকামী ও মর্ষকামী লোক। আনাকেও ক্রিস্টিয়ান তার নিজের প্রতি আনুগত্যশীল বানাতে চায়। আনার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দিয়ে একটি গোপন চুক্তির খসড়া তৈরি করেন ক্রিস্টিয়ান। এতে নিরাপদ শব্দ এবং সীমা আছে। আর দুজনকে যেসব বিচিত্র ধরনের যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া আছে। আনা ওই চুক্তিতে সাক্ষর করবেন কি করবেন না তা নিয়ে আনার সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়।

ড্যানিয়েল স্টিল

আমেরিকান লেখক ড্যানিয়েল স্টিলের আসল নাম ড্যানিয়েল ফার্নান্দেজ ডমিনিকিউ স্টুয়েলিয়েন স্টিল। তিনি বিশ্বের আরেক নারী ধনী লেখক। তার জন্ম আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। তার বাবা জার্মান, মা পর্তুগিজ। ড্যানিয়েলের শৈশব কেটেছে ফ্রান্সে। কিশোরী বয়স থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত এই লেখক। তখন থেকেই কবিতা লেখার হাতেখড়ি। তিনি সাহিত্য ডিজাইন ও ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর পড়াশোনা করেন। পারসন স্কুল অব ডিজাইনে ১৯৬৩ সালে এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। সম্প্রতি তিনি বেস্ট সেলিং লেখকের তালিকায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর লেখা বই ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। এই বই থেকে তার আয় ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গোয়িং হোম’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৯৫। বিশ্বের ৪৭টি দেশে ২৮টি ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে। নারী লেখকদের মধ্যে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ভেরোনিকা রথ ফোর্বসের শীর্ষ তালিকায় ধনী লেখক হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। তিনি জার্মান এবং পোলিশ বংশোদ্ভূত। বর্তমানে তাঁর বয়স ২৯। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এ লেখকের বর্তমান আয় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৯৪ কোটি টাকা প্রায়। তাঁর জনপ্রিয় বই ‘ট্রিলোজি ডিভারজেন্ট’ থেকে তিনি আয় করেন ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর তাঁর লেখা থেকে তৈরি ইনসারজেন্ট চলচ্চিত্রটি সারা বিশ্ব থেকে আয় করে ২৯৫ মিলিয়ন ডলার।

পলা হকিন্স

ব্রিটিশ লেখক পলা হকিন্স সৌভাগ্যবানদের একজন। বিশ্বের সেরা ধনী লেখকদের তালিকায় রয়েছে পলা হকিন্সের নাম। ফোর্বস সাময়িকীতে প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী লেখকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক পলার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বর্তমান জিম্বাবুয়ের হারারেতে। তিনি লন্ডন ও অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে বসবাস করছেন সাউথ লন্ডনে। ফোর্বস-এর তথ্যানুযায়ী পলা হকিন্সের ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ উপন্যাসটি এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ২০ লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়েছে। তাঁর নতুন উপন্যাস ‘ইনটু দ্য ওয়াটার’ বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। উপন্যাস দুটি প্রসঙ্গে এই লেখক বলেন, “দুটি উপন্যাসই মনস্তাত্ত্বিক সাসপেন্স উপন্যাস। তারপরও একটি অপরটি থেকে খুব ভিন্ন, কারণ ইনটু দ্য ওয়াটার অনেক বেশি মৌলিক। গল্পটি একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, তারপরও আমার এ গল্পে অনেক বেশি চরিত্র আছে।”

জ্যাকি কলিন্স

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জ্যাকি কলিন্স। তিনিও বিশ্বের ধনী লেখকদের মধ্যে অন্যতম। ২০১৫ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এখনো তার বইগুলো বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। মৃত্যুর আগে দীর্ঘ সাত বছর স্তন ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। কিংবদন্তি এই লেখক জীবনের শেষ কয়েকটি দিন লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসভবনেই ছিলেন। তার বোন জোয়ান কলিন্স একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী। জোয়ান কলিন্স বলেন, “জ্যাকির মৃত্যুর খবরে আমি একদম ভেঙে পড়েছি। ও আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল। জ্যাকি স্কুলে পড়ার সময়ই লিখতে শুরু করেন। তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফুল অব ম্যারেড ম্যান’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। প্রথম বই দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন এই লেখক। বইটি বেস্ট সেলার হয়েছিল তখন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুই হাত ভরে লিখে গেছেন জ্যাকি।

রিচার্ড চার্লস নিকোলাস ব্রানসন

এদের যাদের কথা বললাম তাঁরা সবাই কিন্তু লেখালেখি করেই ধনী হয়েছেন। কিন্তু ধনী হওয়ার আগে লেখেননি এক অক্ষরও অথচ ধনী হওয়ার পর লিখে লেখকখ্যাতি পেয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যেমন ‘লুজিং মাই ভার্জিনিটি’ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী রিচার্ড চার্লস নিকোলাস ব্রানসনের লেখা আত্মজীবনীমূলক একটি বই। রিচার্ড ব্রানসন ভার্জিন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৪০০টি কোম্পানি রয়েছে। এয়ারলাইন্সের ব্যবসার জন্য তিনি অধিক বেশি বিখ্যাত। তার এই বইটি বেশ আনন্দদায়ক ও অনুপ্রেরণামূলক। তিনি তার প্রাথমিক জীবনের প্রায় ৪৩ বছরের বিভিন্ন ঘটনা, এই বইটিতে তুলে ধরেছেন। তিনি এই বইটিতে এমনভাবে বর্ণনা তুলে ধরেছেন, একজন পাঠকের এই বইটি পড়ার সময় মনে হবে, তিনি যেন রিচার্ড ব্রানসনের সঙ্গে গল্প করছেন। একজন বন্ধু অন্য বন্ধুর সঙ্গে যেমনভাবে কথোপকথন করে থাকে, অনেকটা প্রায় তেমন ভঙ্গিতেই ব্রানসন বইটিতে আলোচনা তুলে ধরেছেন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। মূলত রিচার্ড ব্রানসনের প্রাত্যহিক নোটবুক থেকে লেখাগুলোকে একত্রিত করে, লুজিং মাই ভার্জিনিটি বইটির রূপ দেওয়া হয়েছে।

বিল গেটস

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বিখ্যাত একটি বই হচ্ছে ‘বিজনেস অ্যাট দ্য স্পিড অব থট।’ এই বইটি ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ হওয়ার পরই বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৯৫ শতাংশ পাঠক এই বইটি পড়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছে।

হলেন ওয়ারেন বাফেট

‘দ্য এসেস অব ওয়ারেন বাফেট’ নামের বইটি লিখেন বিশ্বের আরেক শীর্ষ ধনকুবের হলেন ওয়ারেন বাফেট। যিনি বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিবছর বার্ষিক চিঠি লিখে থাকেন। এই চিঠিতে তিনি তার ব্যবসায়িক চিন্তাচেতনা এবং বিনিয়োগ ও বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে তার মতামত ও চিন্তা-ভাবনাগুলো তুলে ধরেন। আর এই চিঠিগুলোই একত্রিত করে ১৯৯৭ সালে দ্য এসেস অব ওয়ারেন বাফেট বইটি প্রকাশ করা।

মাইকেল ডেল

বর্তমানে ডেলকে অন্যতম শীর্ষ কম্পিউটার ও প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই ডেল কোম্পানিরই প্রতিষ্ঠাতা হলেন মাইকেল ডেল। যিনি মাত্র ১ হাজার ডলার দিয়ে ব্যবসা শুরু করে, বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় একটি কম্পিউটার ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। তাঁর জীবনের লড়াইয়ের বিভিন্ন ঘটনা এবং তাঁর সফলতা অর্জনের কৌশল নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ডিরেক্ট ফ্রম ডেল’ বইটি। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক জীবন শুরু করার আগে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।

সাম ওয়াল্টন

‘মেড ইন আমেরিকা’ হচ্ছে সাম ওয়াল্টনের আত্মজীবনীমূলক বই। ১৯৯২ সালে তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। সাম ওয়াল্টন খুবই ছোট একটি দোকানের মাধ্যমে তার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তারপর তিনি হয়েছিলেন ওয়াল-মার্টের মতো বিখ্যাত সাম্রাজ্যের মালিক। ওয়াল-মার্টকে বিশ্বের অন্যতম বড় রিটেইল স্টোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি কিভাবে ছোট একটি দোকান থেকে এরকম বিশাল প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন; এই সাফল্যময় গল্পেরই বর্ণনা তুলে ধরেছেন এই বইটিতে। এ পাঁচ ধনকুবেরের এ পাঁচটি বইয়ের সাহিত্যমূল্য যদিও নেই তবু পাঠকের কাছে সমাদৃত মোটিভেশনাল চরিত্রের জন্যে।

সর্বকালের সেরা ১০ বিক্রিত বই

এবার সর্বকালের সেরা ১০ বই হিসেবে বেশি বিক্রিত বইয়ের একটা তালিকা দিয়ে শেষ করা যায়। তবে এসব বইয়ের লেখকরা লিখে ধনী হতে পারেননি, সাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত। যেমন, লিও তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ ও ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, গুস্তাভে ফ্লবার্টের ‘মাদাম বোভারি’।


আরো পড়ুন দেবদুলাল মুন্নার দুটি গল্প
জবাফুলের দুনিয়া
ধুসাইলা


ভ্লাদিমির নাবোকভের ‘ললিতা’, মার্ক টোয়েনের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’, স্কট ফিজেরাল্ডের ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই’, মারসেল প্রোস্টের ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’, অ্যানটন শেকভের ‘দ্য স্টোরিজ অব অ্যানটন শেকভ’, জর্জ ইলিয়টের ‘মিডলমার্চ’। যে বইগুলোর নাম নিলাম এগুলো টাইম ম্যাগাজিনের সর্বশেষ সেরা বই।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;