যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি চায়? পশ্চিমাদের যতো দ্বিচারিতা

  • আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, অর্থাৎ ঢাকা ওয়াশিংটনের জবরদস্তিতে সম্মতি দেবে না-এর ফলে কি ধরণের সংকটের মুখে পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে?

জবাবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আবদুর রশীদ বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশকে চাপ প্রয়োগ করার যে সীমাবদ্ধতা সেটিও যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যে অনেক পথ খোলা আছে বাংলাদেশকে নিজের আওতায় নেওয়ার জন্য তাও না। সেই পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এখানে মার্কিন উপস্থিতির বিষয়টি আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতায় আছে, ভারতেরও এটি পছন্দের তালিকায় থাকবে না। স্বভাবতোই এখানে মার্কিন উপস্থিতি না হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন চীন আগ্রহ প্রকাশ করবে, রাশিয়া আগ্রহ প্রকাশ করবে তেমনি ভারতও আগ্রহ প্রকাশ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের সঙ্গে যে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে বিশ্বে আমরা দেখেছি এক পরাশক্তি চাপ দিলে অন্য পরাশক্তি পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশের বন্ধুও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক দৌরাত্ম্য সফল হবে না।

বিজ্ঞাপন

পূর্বাপর ইতিহাস টেনে এই সামরিক বিশ্লেষক বলেন, একাত্তর সালে আমরা দেখেছি, প্রেক্ষিতটা প্রায় একই ছিল। মার্কিনদের সঙ্গে তখন চায়না ছিল। এখন চায়না নেই। মার্কিন ইচ্ছার বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধ হয়েছিল। সামরিক শক্তির মহড়াও আমরা দেখেছি। সেই দিক দিয়েও যদি আপনি চিন্তা করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে এই ধরণের চাপ অগ্রহণযোগ্য বর্তমানে। যে বিষয়টি তাদের হাতে রয়েছে, সেটি হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে কিছু মোচড় দেওয়া যায় কিনা। ক্রমান্নয়ে তাই তারা ব্যবহার করছে। এই ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও বেশি বিস্তার…একটি বহুমুখী সম্পর্কে থাকতে হবে যাতে একপক্ষ চাপ দিলে অন্য পক্ষ পাশে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, চীনের ও পশ্চিমা বিশ্বের নতুন ভূমিকার ফলে বিশ্বের ভূ-রাজনীতির জায়গাটাতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটা সামনে চলে এসেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভেতরে বলতে পারি যে, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এই তিনটি অঞ্চল একেবারেই বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করছে এবং এই প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি যে যদি এই আঞ্চলিক শক্তিগুলি এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে যে শক্তিগুলি তাদের স্বার্থের যে জায়গাটা..তাদের জাতীয় স্বার্থ, কৌশলগত স্বার্থ, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ, অর্থনৈতিক স্বার্থ এইগুলির সঙ্গে এই অঞ্চলের যে ঘটনাগুলো সরাসরি কানেক্টেড এবং সেখানে ভারতের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ভারত যেহেতু এই অঞ্চলের উদীয়মান পরাশক্তি, ভারতের সঙ্গে চীনের এক ধরণের বৈরিতা আছে সে কারণে সেটারও একটা মাত্রা আমরা দেখতে পাই..ফলে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যে সম্পর্কের যে পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনের বিষয়টা যেমন তাদের নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী মোকাবিলা করছে এবং এক্ষেত্রে কখনো তাদের মধ্যে বৈরিতা আবার কখনো সহযোগিতাও দেখি। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার চীনে গিয়েছেন এবং চীনের সঙ্গে বৈরিতার পাশাপাশি এক ধরণের এনগেজমেন্টও দেখি। ফলে বৃহৎশক্তিগুলো তারা তাদের নিজেদের মতো করে এনগেজড হচ্ছে আবার বৈরিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘তাদের মধ্যকার এই যে দোলাচল সেখানে বাংলাদেশেল মতো দেশগুলো, এই অঞ্চলের মাঝারি যে শক্তিগুলোর ওপরে একটা প্রচন্ড চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে বলা যায় যে তাদের এই পোলারাইজেশন..এই অঞ্চলের দেশগুলো পররাষ্ট্রনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। কূটনৈতিক সম্পর্ককে দাবার গুটির মতো ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বারা। সেখানে বিদ্যমান যে সম্পর্ক সেটাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ যেমন একটা ভারসাম্যপূর্ণ জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে বিশেষ করে বর্তমান সরকার। সেই নীতির আলোকে ভারতের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে, আবার গত ১৫ বছর চীনের সঙ্গেও একটি সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলো একটি চাপের মধ্যে পড়ছে।

ড. হোসেন উল্লেখ করেন, ‘এটি কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি করা কোন বিষয় না। বাংলাদেশ যে তার পররাষ্ট্রনীতির মূল ফোকাস, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই শান্তিপূর্ণ বন্ধুত্ব বজায় রাখার কাজটিই করছে। বাংলাদেশ এক ধরণের উদীয়মান অর্থনীতি, বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য-বিনিয়োগ দরকার। বৈদেশিক বাণিজ্য দরকার। পুরো বিশ্বকে বাংলাদেশ মনে করছে, অর্থনীতির জন্য নিরাপত্তার জন্য ভাবমূর্তির জন্য সকলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে।

বাংলাদেশের কিন্তু কোন ভূ-রাজনৈতিক অভিলাষ নাই। বাংলাদেশ কোনো দেশের সঙ্গে থেকে অন্য দেশকে চ্যালেঞ্জ করবে ক্ষতি সাধন করবে তা নয়। বাংলাদেশই নয়, অনেক দেশই এই চাপের মধ্যে পড়েছে। এই অঞ্চলটার গুরুত্ব যেহেতু সবচেয়ে বেশি আর বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় উন্নতি হয়েছে বিগত ১০-১৫ বছরে, বাংলাদেশের সক্ষমতা বেড়েছে সামরিক ক্ষেত্রেও। ফলে বাংলাদেশের ভূমিকাকে পক্ষে নেওয়ার জন্য চেষ্টা থাকবেই। বিশ্ব রাজনীতিতে যেটা অতীতেও হয়েছে কিন্তু এর একটা সীমা থাকা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে ভূ-রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে টেনশন এবং মধ্যকার যে আচরণ সেটাই ওই সীমাকে অতিক্রম করছে। যে কারণে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশগুলো অযাচিত চাপের মধ্যে পড়ছে।’

শেখ হাসিনার এই চাপের কাছে নতি স্বীকার না করা প্রসঙ্গে অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, ‘বাংলাদেশ চাপের কাছে নতিস্বীকার করে না এবং বাংলাদেশ এই চাপকে কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট সফল এবং বাংলাদেশ তার যে স্বকীয়তা এবং তার যে আদর্শ ও পররাষ্ট্রনীতি সেটা অংশগ্রহণ করে আসছে..আমি মনেকরি উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশ অনেকটাই ব্যতিক্রম। যারা আসলে এ রকম একটি পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখতে পারছে।’

বৃহৎ শক্তিগুলির দ্বিচারিতার সমালোচনা করে এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেরা নিজেদের মধ্যে সম্পর্কগুলো ম্যানেজ করে নিচ্ছে, বৈরিতার মধ্যে তারা একে নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা শত শত বিলিয়নের বাণিজ্য করছে। যেই বাংলাদেশের মতো দেশগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন বাণিজ্য করে, অর্থনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ করে তখন সেটাকে আবার অন্যায়ের চোখে দেখা হয়। এটা একটা দ্বিচারিতা বা দ্বিমুখিতা।’ (সমাপ্ত)

আরও পড়ুন- যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি চায়? বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি চায়? রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রাখার হেতু কি তবে…