পরিযায়ী পাখি: এদেশের প্রজনন পরিযায়ী কোকিলেরা



আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
ঢাকার মিরপুরস্থ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে অস্থির লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল। ছবি- লেখক।

ঢাকার মিরপুরস্থ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে অস্থির লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল। ছবি- লেখক।

  • Font increase
  • Font Decrease

 

সাতাশ কি আটাশ বছর আগে সর্বপ্রথম লাল-ডানার ঝুঁটিয়াল পাখিটির ছবি দেখেছিলাম। পরবর্তী বছর দু’য়েক বিভিন্ন স্থানে বেশ ক’বার পাখিটির সন্ধান করেছিলাম। কিন্তু, দেখা পাইনি। এরপর বহু বছর গড়িয়ে গেছে; বহু জায়গায় ওকে খুঁজেছি, কিন্তু ফলাফল একই।

বর্ষায় সুন্দরবনের রূপ দেখতে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই ‘অভিযাত্রিক সুন্দরবন’-এর ব্যানারে দশজনের টিমে সুন্দরবন গেলাম। পরদিন সকালে লঞ্চের সঙ্গে থাকা কোসা নৌকায় জামতলী খালে ঢুকলাম। আধঘন্টার মতো খালে ঘুরে কিছু পাখির ছবি তুলে যখন খয়েরি-মাথা সুইচোরার ছানার ছবি তুলছি ঠিক তখন লাল-ডানায় পাখিটিকে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। পাখিটি উড়ে গিয়ে খালপাড়ের কেওড়া গাছে বসল। দ্রুত ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ক্লিক করলাম। কিন্তু, সে দ্রুত উড়ে যাওয়ায় দলের একজন ছাড়া বাকিরা ছবি তুলতে ব্যর্থ হলো। দুপুরে দ্বিতীয়বারের মতো জামতলী গেলাম। সমুদ্র সৈকত থেকে ফেরার পথে আরও দু’বার ওকে কয়েক সেকে-ের জন্য দেখলাম। কিন্তু, দু’বারই ও গাছের ঘন পাতার আড়ালে হারিয়ে গেল। বাঘের ভয়ে ওখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। কাজেই ছবিও তোলা হলো না। এরপর টানা তিনবছর ওর খোঁজ নেই। 

 শূককীট মুখে লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল। ছবি- লেখক

বিরল একটি কোকিলের ছবি তোলার জন্য এ বছরের ২০ মে মিরপুরস্থ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গেলাম। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম লাল-ডানার ঝুঁটিয়াল পাখিটিকে গত দু’দিন ধরে অনেকেই দেখেছে। আমরা যখন বেলা এগারটায় পল্লবীর গেটের কাছে লেকের পাশে পাখির ছবি তুলছি সে সময় এক সুহৃদ ফোনে জানাল তারা পাখিটিকে দেখেছে। প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছলাম। কিন্তু ততক্ষণে পাখিটি ঝোপের আড়ালে চলে গেছে। এমনিতেই দূরন্ত পাখিটি গাছের আড়ালে-আবডালে থেকে প্রজাপতি ও মথের শুঁয়াপোকা ধরে খায়। বেলা ১১:৩৫ মিনিটে একযোগে ৭-৮ জনের ক্যামেরার শাটার গর্জে ওঠতেই একটি গাছের পাতার আড়ালে ওকে লাফালাফি করতে দেখলাম। তবে অনেক চেষ্টার পরও অস্থির পাখিটির পরিষ্কার ছবি তুলতে পারলাম না। মিনিট বিশেক চেষ্টার পর অবশেষে অধরা পাখিটির ছবি তুলতে সক্ষম হলাম। এত বছর খোঁজাখুঁজি ও চেষ্টার পর যার ছবি তুললাম সে হলো এদেশের দুর্লভ প্রজনন পরিযায়ী পাখি লাল-ডানা বা লাল-পাখা কোকিল। আজকে এই পাখিসহ কোকিল গোত্রের সকল পরিযায়ী তথা গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী সদস্যদের নিয়ে গল্প সাজিয়েছি।

কোকিল পরভৃত অর্থাৎ কুকুলিফরমেস (Cuculiformes) বর্গের পাখি। এই বর্গের কমবেশি ৪০ ভাগ পাখি, যাদের বেশির ভাগই পুরনো বিশ্ব অর্থাৎ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় বাস করে, তারা বাসা তৈরি করে না; তাই বংশবৃদ্ধির জন্য ওরা অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে ও নিজেদের বংশবৃদ্ধির কাজটি অন্য পাখিকে দিয়ে করিয়ে নেয়। এজন্য ওদেরকে শাবক পরজীবীও (Brood Parasite) বলে। এই বর্গে মোট ১৪৭ থেকে ১৫১ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এই বর্গের একমাত্র গোত্রের নাম পরভৃত বা কুকুলিডি (Cuculidae)। এদেশে এই গোত্রের মাত্র বিশ প্রজাতির পাখির বাস, যার বেশিরভাগই কোকিল (Cuckoo)। এই বিশ প্রজাতির বেশিরভাগ পাখিই বাসা বানায় না। তবে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম হলো বনকোকিল বা মালকোহা (Malkoha) এবং কানাকুক্কা বা কুকাল (Coucal), কারণ তারা অন্যান্য পাখির মতো বাসা বানায়, ডিম পাড়ে ও ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটায়। এই গোত্রের অনেক প্রজাতির পাখির ক্ষেত্রেই স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বেশকিছু প্রজাতি বংশবৃদ্ধি করার জন্য গ্রীষ্মকালে এদেশে আসে যাদেরকে গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী (Summer Breeder) বলে। এদেশে প্রাপ্ত এই গোত্রের ২০টি প্রজাতির মধ্যে দুটি বনকোকিল ও দুটি কানাকুক্কা এবং বাকি ১৬টি প্রজাতি কোকিল। এই কোকিলগুলোর মধ্যে যারা গ্রীষ্মকালে এদেশে প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করতে আসে তাদের সম্পর্কেই এখানে আলোচনা করব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাছের ডালে চাতক পাখি। ছবি- লেখক।  

তবে প্রজনন পরিযায়ী কোকিলদের নিয়ে আলোচনার আগে আবাসিক, পরিযায়ী ও প্রজনন পরিযায়ী পাখি বলতে কি বোঝানো হয় তা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। এদেশের পক্ষীতালিকায় এখন পর্যন্ত ৭২২ প্রজাতির পাখি নথিভুক্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কমবেশি ৩৪০টি প্রজাতি আবাসিক; অর্থাৎ ওরা সারাবছর এদেশে থাকে, ডিম পাড়ে ও ছানা তোলে। এছাড়াও ৩৭০ প্রজাতিরও বেশি পাখি পরিযায়ী অর্থাৎ বছরের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় এদেশে আসে, বসবাস করে ও সময়মতো মূল আবাসে ফিরে যায়। এসব পাখি এদেশের মানুষের কাছে আগে, এমনকি এখনও, ‘অতিথি পাখি’ নামেই পরিচিত। এদেরই এক বিরাট অংশ আসে শীতে, যারা শীতের পরিযায়ী নামেও পরিচিত। এসব পাখি মূল দেশে আবাসস্থল বসবাস অনুপযোগী হওয়া, খাদ্যের অভাব ও শীতের কবল থেকে বাঁচার জন্যই বাংলাদেশসহ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে পরিযায়ন করে। এটা ওদের জীবনচক্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ওরা সচরাচর শীতের আবাসে বংশবিস্তার করে না; অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে, যেমন- কুড়া বা পালাসেস ফিশ ঈগল এদেশে আসে শীতকালে, ডিম-ছানা তোলে ও ছানাদের বড় করে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়।

রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার বিজয়নগরে শুককীট খাচ্ছে চাতক পাখি। ছবি- লেখক

এছাড়াও বেশকিছু পরিযায়ী পাখি এদেশে অনিয়মিত। ওরা অন্যদের মতো প্রতিবছর আসে না, বরং ৫ বা ১০ বছর পর পর আসে। তাই ওরা যাযাবর, ভবঘুরে বা অনিয়মিত পরিযায়ী হিসেবে পরিচিত। ওদের সংখ্যাও নেহাত কম না, এদেশের মোট পরিযায়ী পাখির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়াও কোনো কোনো পাখি অন্য দেশে পরিযায়নের এক পর্যায়ে এদেশে স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে আসে, যেমন- বাদামি চটক, বন খঞ্জন, লাল-পা তুরমতি ইত্যাদি। ওরা পন্থ-পরিযায়ী (Passage-migrant) নামে পরিচিত। এই পাখিগুলো মূলত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে অন্য কোনো দেশে পরিযায়নের পথে এদেশে কিছুদিনের জন্য যাত্রা বিরতি করে ও ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে মূল দেশে ফিরে যাওয়ার সময়ও আরেকবার এদেশে যাত্রা বিরতি করে।

যদিও পরিযায়ী পাখি বলতে মূলত শীতের পাখিগুলোকেই বোঝায়, তথাপি কিছু পাখি গ্রীষ্মেও পরিযায়ন করে, যেমন- বিভিন্ন প্রজাতির কোকিল, সুমচা, সুইচোরা, মাছরাঙা ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রজাতির কোকিল এদেশে মার্চ থেকে এপ্রিলে আসে, অন্য উপযুক্ত পাখির বাসায় ডিম পাড়ে, ছানা তোলে এবং ছানাসহ সকলেই আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে শীতকালীন আবাসে চলে যায়।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পান্না কোকিল। ছবি- লেখক

আগেই বলেছি কোকিলরা বাসা বানায় না। ওরা ডিমে তাও দেয় না এবং ছানাদেরও লালন-পালন করে না। ববং ওরা অন্য উপযুক্ত পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং তাদের মাধ্যমে নিজেদের বংশবৃদ্ধির কাজটি করিয়ে নেয়। কোকিলের বিভিন্ন প্রজাতি, যেমন- কোকিল, পাপিয়া, চোখ গেল, বউ কথা কও, পান্না কোকিল, বেগুনি কোকিল, বাদামি কোকিল, সরগম, ফিঙ্গে কুলি প্রভৃতির স্ত্রী পাখিরা নিজেদের জন্য উপযুক্ত পোষক বা ধাত্রী পাখির বাসায় ধাত্রীর পাড়া ডিম ফেলে দিয়ে ঠিক একই রঙের প্রায় সমান আকারের ডিম পাড়ে। বংশ রক্ষা নিশ্চিত করতে একটি পোষকের বাসায় ডিম না পেড়ে একাধিক বাসায় ১-৩টি করে ডিম পাড়ে। এসব শাবক পরজীবী পাখির ডিম সচরাচর পোষক পাখির ডিমের আগে ফোটে ও পরজীবী পাখিদের সদ্যফোটা চোখ অফোটা ছানারা পোষক পাখির অফোটা ডিম বা সদ্যফোটা ছানা পিঠ দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাসা থেকে নিচে ফেলে দেয় যেন ওরা এদের খাবার বা যতেœ ভাগ বসাতে না পারে। আর এভাবেই ছানাগুলো পোষক বাবা-মায়ের যত্নে একদিন বড়ো হয়ে ওঠে। অথচ পোষক পাখি তা টেরই পায় না।

বাসা না বানানো এই কোকিলদের মধ্যে যারা আবাসিক এবং পন্থ-পরিযায়ী নয়, কিন্তু প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করার জন্য অন্য দেশ থেকে গ্রীষ্মকালে এদেশে আসে ওদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল, চাতক ও পান্না কোকিল। এছাড়াও আরও যেসব প্রজাতির কোকিল এদেশে প্রজনন পরিযায়ী হয়ে আসে সেগুলোর মধ্যে বউ কথা কও, ধূসর-পেট কোাকিল ও বেগুনি কোকিল অন্যতম। তবে, প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন-এর মতে ওরা এদেশের আবাসিক পাখি। এছাড়াও এ তালিকায় ছোট কোকিলকেও অর্ন্তভুক্ত করা যায়। তবে, এদেশে গ্রীষ্মের অনিয়মিত এই পরিযায়ী পাখিটির প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির কোন চাক্ষুস প্রমাণ না পাওয়ায় লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল, চাতক ও পান্না কোকিলের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। 

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়রণ্যে পান্না কোকিল। ছবি- লেখক

এক. লাল-ডানা ঝুঁটিয়াল কোকিল: ফিচারের শুরুতে লাল ডানার খোপাধারী যে কোকিলটির গল্প বলা হয়েছে সে হলো লাল-ডানা বা লাল-পাখা ঝুঁটিয়াল কোকিল। এটি এদেশের দুর্লভ প্রজনন পরিযায়ী কোকিল। পশ্চিমবঙ্গে বলে গোলা কোকিল। ইংরেজি নাম Chestnut-winged Cuckoo বা Red-winged Crested Cuckoo । বৈজ্ঞানিক নাম Clamator coromandus। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত।

লাল-ডানা কোকিল চাতক পাখির মতোই লম্বালেজী ঝুঁটিদার কোকিল। হাঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন একটি লালচে চাতক। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৮-৪৬ সেন্টিমিটার ও ওজন ৬৬-৮৬ গ্রাম। কালো মাথায় কালো ঝুঁটি, চোখ ও চঞ্চু কালো। পিঠের উপরটা ও লম্বা লেজ চকচকে নীলচে-কালো। ডানার উপরটা ও প্রান্ত লাল। গাল ও গলা হালকা লালচে। ঘাড়ের উপর অর্ধ সাদা বন্ধনী। বুক-পেট সাদা। চোখের মনি গাঢ় বাদামি। পা ও পায়ের পাতা ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি ফ্যাকাশে, দেহের উপরটা লালচে ফুটকিযুক্ত ও ঝুঁটি ছোট। 

গ্রীষ্মকালে দেশের সব ধরনের বনাঞ্চল ও বনের আশেপাশের গাছপালাসম্পন্ন এলাকায় দেখা যায়। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। ঘন ঝোপ বা পাতাঘেরা গাছে লুকিয়ে থাকে বলে সহজে নজরে আসে না। প্রধানত শুঁয়াপোকা ও নরম দেহের কীটপতঙ্গ খায়। দ্রুত ডানা ঝাপটে গাছ থেকে গাছে ঘুরে বেরায়। স্ত্রী সচরাচর নীরব। পুরুষ অন্য সময় নীরব থাকলেও প্রজনন ঋতুতে উঁচ্চ কন্ঠে ‘ব্রিপ-ব্রিপ-ব্রিপ---’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে আগস্ট প্রজননকাল। বাসা না বানানো অন্যান্য কোকিলের মতো ওরাও না বানায় বাসা, না দেয় ডিমে তা, না করে ছানাদের যত্নে। সচরাচর ছাতারে বা পেঙ্গা পাখির বাসায় ওদের ডিমের সঙ্গে মিলিয়ে ২-৩টি নীল ডিম পাড়ে। ছাতারে বা পেঙ্গার ডিম ফোটার আগেই ওদের ডিম ফোটে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

দুই. চাতক: এটি এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান প্রজনন পরিযায়ী খোঁপাধারী কোকিল। পিঁউকাহা, পাপিয়া বা পাকড়া কোকিল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Pied Cuckoo, Pied Crested Cuckoo বা Jacobin Cuckoo বৈজ্ঞানিক নাম Clamator jocobinus । পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার পাখিটি প্রতি গ্রীষ্মে এদেশে প্রজনন করার জন্য পরিযায়ী হয়ে আসে। পাখিটি বছরের পর বছর একই সময়ে একই জায়গায় পরিযায়ন করে। 

চাতক লম্বালেজি ঝুঁটিয়াল কোকিল। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের গড় দৈর্ঘ্য ৩৩ সেন্টিমিটার যার মধ্যে লেজই ১৬ সেন্টিমিটার । ওজন ৬৫-৭০ গ্রাম। মাথায় কালো ঝুঁটি, দেহের উপরটা কালো ও নিচটা সাদা। লেজের ডগা সাদা। ডানার প্রান্তে সাদা ছোপ থাকে। চোখ বাদামি ও চঞ্চু কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল ধূসর-কালো। নখ কালো। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ ধূসর-বাদামি, গলা-বুকে ধূসর ও দেহতলে পীতাভ আভা থাকে। গ্রীষ্মকালে এদেশের বন, বাগান, আবাদি জমি, খামার, ঝোপঝাড় সর্বত্রই ওদের দেখা যায়। সচরাচর একাকী, জোড়ায় বা ৫-৬টির ছোটো দলে থাকে। ঘন ঝোপ বা পাতাঘেরা গাছে লুকিয়ে খাবার খায়। প্রজাপতি ও মথের শূককীট, ছারপোকা, উঁইপোকা, পিঁপড়া ইত্যাদি প্রিয় খাবার। স্ত্রী সচরাচর নীরব। তবে, পুরুষ চাতক ‘পিউ---পি-পি-পিউ---’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে জুলাই প্রজননকাল। পুরুষ চাতক পূর্বরাগের সময় সুরেলা কন্ঠে গান গায়। পরভৃত গোত্রের বেশিরভাগ প্রজাতির মতো ওরাও বাসা বানায় না। আর ডিমে তা দেয়া বা ছানার যতœ নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ছাতারে (Babbler), বুলবুল (Bulbul), ফিঙে (Drongo) পোষক পাখি অর্থাৎ এসব পাখির বাসায় স্ত্রী চাতক চুপিসারে বাসাপ্রতি ২-৩টি করে ডিম পাড়ে, পোষক পাখির ডিমের রঙের সাথে মিল রেখে। ডিম ফোটে পোষক পাখির ডিম ফোটার আগে। ছানারা পোষক পাখির যত্নে বড়ো হয়ে উঠে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

আরও পড়ুন:

আমাদের প্রজাপতি

বাঘের থেকেও বিরল পাখি সুন্দরী হাঁস

পরিযায়ী পাখিরা আসছে


তিন. পান্না কোকিল: এটি বিরল ও সুদর্শন গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী কোকিল। সবুজাভ কোকিল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Asian Emerald Cuckoo বা Emerald Cuckoo । বৈজ্ঞানিক নাম Chrysococcyx maculatus । প্রতি গ্রীষ্মে পাখিটি এদেশে আসে ডিম-ছানা তোলার জন্য; যদিও না বানায় বাসা, না দেয় ডিমে তা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, চীন, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় দেখা যায়।

কোকিল গোত্রের অন্যতম ছোট এই সদস্যটির দেহের দৈর্ঘ্য ১৭-১৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ২৩-৩০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে ভিন্নতা থাকে। পুরুষের পিঠের উপরটা চকচকে পান্না-সবুজ, তাতে থাকে সোনালি-ব্রোঞ্জ আভা। থুতনি, গলা ও বুকেও তাই। বুক-পেটের নিচটা সাদা, তাতে ধাতব ব্রোঞ্জ-সবুজ ডোরা। লেজের নিচটা ধাতব সবুজ, তাতে সাদা ডোরা। স্ত্রীর মাথা ও ঘাড়ের পিছনটা সোনালি লাল। পিঠের পালক ব্রোঞ্জ-সবুজ। গলা-বুক-পেটে সাদার উপর বাদামি-ব্রোঞ্জ ডোরা। লেজে খয়েরি-কালো ডোরা, ডগা সাদা। চোখের রং গাঢ় লাল। চঞ্চু কমলা-হলুদ, আগা কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল গাঢ় বাদামি-সবুজ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের উপরটায় থাকে লাল-বাদামি ডোরা। থুতনি, গলা ও ঘাড়ে থাকে লালচে কালো দাগ। দেহের নিচটায় রয়েছে অনুজ্জ¦ল সাদা ও বাদামি ডোরা। 

 পান্না কোকিল প্রধানত চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। তবে নিচু ভূমি ও পাহাড়ের ১,৫০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। ওরা একাকী বা ৪-৬টির দলে বিচরণ করে। গাছের মগডালে পাতার আচ্ছাদনে লুকিয়ে থাকে, তাই সহজে চোখে পড়ে না। পিঁপড়া, শুঁয়াপোকা ও নরম পোকামাকড় খেতে পছন্দ করে। পূর্ণিমা রাতে পুরুষটি ‘চিরর্র-চিরর্র---’ শব্দে ডাকে।

এদেশে ওরা এপ্রিলের মাঝামাঝি আসে ও জুলাইয়ের শেষে চলে যায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষটি দিনভর ‘চিরর্র-চিরর্র-চিরর্র-চিরর্র---’ শব্দে ডাকতে থাকে। মৌটুসি (Sunbird)  বা মাকড়সাভূকের (Spiderhunter) বাসায় একটি করে সাদার উপর বাদামি বা লালচে ছিটযুক্ত ডিম পাড়ে। যদিও ওদের ডিম আকারে কিছুটা বড়ো হয়, কিন্তু ডিমের রং পোষক বা ধাত্রী পাখির মতোই। পোষকের ডিমের আগেই এই ডিম ফোটে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পান্না কোকিলের ছবি তোলারত অবস্থায় লেখক

E-mail:[email protected], [email protected]

   

হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেলেন ৫৪ বছর পর!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

৫৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেয়েছেন ম্যারিলিন বার্চ (৭৬)। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের পন্টারডাউইর বাসিন্দা।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ম্যারিলিন বার্চ স্কাই নিউজকে বলেন, এতো বছর পর আংটিটি খুঁজে পাওয়া সত্যিই অবাক করা বিষয়। ১৯৭০ সালে পারিবারিক খামারে গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় আংটিটি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজার পরও না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম এটা আর কখনো পাবো না।

তবে শনাক্তবিদ কিথ ফিলিপসের মনে ছিল অন্য কিছু। তিনি খামারের লোকজনকে বিভিন্ন সময় সেখানকার ভূমি খননের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁর হিসাবে, সেখানে মাটির নিচে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে।

সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন মুদ্রা এবং বিটের টুকরা আমাদের দেখাতেন। কিন্তু আংটিটির খোঁজ মেলেনি। 

ম্যারিলিন বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় ফিলিপস যখন খামার ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলি, ফিলিপস শোনো, যেসব আবর্জনা তুমি উদ্ধার করেছ এসব ফেলো। যাও, আমার বিয়ের আংটিটি খুঁজে বের করতে পার কি না, দেখো।’

এ কথা শোনার পর তারা দুজনেই তখন হেসেছিল। তবে এক সপ্তাহ বা তারও কিছু সময় পরে ফিলিপস ম্যারিলিনের আংটিটি নিয়ে হাজির হন।

ম্যারিলিন বলেন, আংটিটিকে খামারের মাঠে মাটির প্রায় ৮ ইঞ্চি নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটিকে তিনি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এটিকে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন।

মিসেস বার্চের স্বামী পিটার বার্চ গত জানুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিয়েছেন। সে উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার পর সব আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। এখন সবকিছু এই আংটিটি ঘিরেই হচ্ছে।

;

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;