কওমি মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগে শৃঙ্খলা জরুরি

  • মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কওমি মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগে শৃঙ্খলা জরুরি, ছবি: সংগৃহীত

কওমি মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগে শৃঙ্খলা জরুরি, ছবি: সংগৃহীত

সাধারণত মৌখিকভাবেই চলে কওমি মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ। নিয়োগ পাওয়া মাদরাসা থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থী, পুরোনো শিক্ষার্থী কিংবা কারও মাধ্যমে আসা চাকরিপ্রার্থীকে কর্তৃপক্ষের পছন্দ হলে তাকে পাঠদান শুরু করতে বলা হয়। ব্যস, এটাই নিয়ম। কোনো নিয়োগপত্র নেই, লিখিত কোনো ডকুমেন্ট নেই। কোনো লেনদেন নেই। শুধুমাত্র বিশ্বাস আর আস্থার ওপর নির্ভর করে চলে নিয়োগ। বেতন-ভাতা, ছুটি ও অন্যকোনো সুযোগ-সুবিধার কথা সেভাবে উল্লেখ থাকে না। কিংবা থাকলেও তা মৌখিক পর্যায়ে। এভাবেই চলে আসছে। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু সেটা সংখ্যানুপাতে খুবই কম। বিশ্বাস করা কঠিন, তবু এটাই বাস্তবতা।

আমরা জানি, একজন শিক্ষকের দু’টি বিষয়ে পারদর্শিতা অপরিহার্য। এক. বিষয় জ্ঞান এবং শিক্ষণ, দুই. গবেষণা দক্ষতা। এগুলো নির্ভর করে শিক্ষার মৌল ধারণা ও সিলেবাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান, শিক্ষার ইতিহাস, শিক্ষার্থীর মনোজগৎ, জ্ঞান বিতরণে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল-সম্পর্কিত জ্ঞান, পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিক্ষার্থীর শিখনফল পরিমাপ ও মূল্যায়ন করার ক্ষমতা এবং নতুন নতুন শিক্ষণ কৌশল উদ্ভাবনের দক্ষতার ওপর। আর উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে একজন শিক্ষক নিজেকে সৃষ্টিশীল শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। বর্তমান পৃথিবীতে তাই শিক্ষা বিষয়ে উপযুক্ত ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হওয়া যায় না। এর সবগুলোই বলতে গেলে অনুপস্থিত কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায়।

বিজ্ঞাপন

লেখার শুরুতে কওমি শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সামান্য ধারণা দেওয়া হয়েছে। ভেতরের কথা কাছে অন্যের কাছে বলার জন্য বলছি না, কিন্তু বছরের পর বছর এভাবেই চলছে কওমি মাদরাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি। নিয়োগের সময় নিয়োগপত্র ও নিয়োগ রেজিস্টার না থাকায় উভয়পক্ষের মাঝে অনালোচিত থেকে যায় কিছু বিষয়, সেখান থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হয় চাপা ক্ষোভ। ফলে এক সময় সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়। ফলাফল চাকরিচ্যুতি কিংবা পদত্যাগ।

অথচ পবিত্র কোরআনের ইরশাদ ছিলো, ‘দু’জনের চুক্তি লিখে রাখার, যেন কেউ প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সঙ্কটকালে যেন সুষ্ঠু সমাধান অনায়েসে বের হয়ে আসে।’

বিজ্ঞাপন

কওমি মাদরাসার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)-এর তরফে যদিও নিয়োগ রেজিস্টার রাখার নির্দেশ দেওয়া আছে কিন্তু তা নির্দেশ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। যার কোনো বাস্তবতা নেই। মাদরাসাগুলো এ নির্দেশের কোনো তোয়াক্কা করে না। বেফাকও কোনো মনিটরিং কিংবা ব্যবস্থা নেয় না। নিয়োগ রেজিস্টার ব্যবহার ও সংরক্ষণে কোনো চাপ দেয় না।

অন্যদিকে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে শিক্ষকরা নিবন্ধিত না থাকায় বহুমুখি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং উত্তরোত্তর তা কেবল বাড়ছে।

খুবই তুচ্ছ কোনো কারণে বা খামখেয়ালি করে একজন শিক্ষক শিক্ষাবর্ষের মাঝে এক মাদরাসা ছেড়ে আরেক মাদরাসায় যোগদান করছেন। এতে অনেক সময় পূর্বের মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাদরাসার কার্যক্রম বন্ধের উপক্রমও হয়।

যদিও কওমি মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষকই আদর্শবান, চরিত্রবান। শুধু এতটুকুই নয়, তারা একেকজন আদর্শ ও উত্তম চরিত্রের নমুনা। কিন্তু এর পরও কিছু ব্যতিক্রম আছে। এক্ষেত্রে কোনো শিক্ষকের অসামাজিক আচরণ, অনৈতিক কাজ, চারিত্রিক স্খলন প্রকাশ পেলে মাদরাসা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি এখান থেকে বের হয়ে দূরের আরেক স্থানে যেয়ে অতীত গোপন করে দিব্যি চাকরি নিয়ে নিজের লাম্পট্যপনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এতে করে অপরাধ নির্মূল না হয়ে আরও বিস্তৃতি লাভ করে। অথচ শিক্ষক নিবন্ধন প্রক্রিয়ার দ্বারা এ সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান সম্ভব ছিলো।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে প্রতিটি কওমি মাদরাসা তার পরিচালনাগত নীতিতে স্বাধীন। এ স্বাধীনতা বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনীয়। যা কিছু করার তা স্বাধীনতাকে ঠিক রেখেই করতে হবে। যেমনটি জাতিসংঘ পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোকে অনেক নিয়ম-নীতি মেনে চলতে বাধ্য করে। আবার স্বাধীন সার্বভৌম না হয়েও কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন দেশগুলোতে প্রদেশগুলো নিজেদের মতো করে দেশ চালায়। ঠিক এভাবেই বেফাক-হাইয়া মাদরাসাগুলোকে সুষ্ঠু সুশৃঙ্খলভাবে চালাতে পারে।

সকল মাদরাসার জন্য বেফাক-হাইয়া একই নিয়োগবিধি, একই ছুটিবিধি, একই কানুন তৈরি করে দেবে- তা বলছি না। আর তা বাস্তবসম্মতও নয়। কিন্তু প্রতিটি মাদরাসাকে নিজের মতো করে এ সকল বিধি লিখিতভাবে তৈরি করে নিতে বেফাক-হাইয়া বাধ্য করতে পারে। অনেক মাদরাসার লিখিত গঠনতন্ত্র পর্যন্ত নেই। এক্ষেত্রে বেফাক-হাইয়া আইন করতে পারে, মাদরাসার গঠনতন্ত্র, নিয়োগ বিধি, ছুটি বিধি ইত্যাদি তৈরি করে অনুলিপি বেফাক-হাইয়ার কাছে জমা দেবে। কোনো সময় সংশোধনের দরকার হলে নিজেরাই নিয়মমতো সংশোধন করে সংশোধিত বিধির অনুলিপিও বেফাক-হাইয়ার কাছে জমা দেবে। শিক্ষক নিয়োগ-অব্যাহতি মাদরাসাগুলো নিজেদের মতো করবে, কিন্তু নিয়োগ রেজিস্টারের অনুলিপি ও প্রদত্ত নিয়োগপত্রের অনুলিপি বেফাক-হাইয়ার কাছে জমা দেবে।

কওমি মাদরাসাগুলোর চিরায়ত সুনাম-শৃঙ্খলা অক্ষুন্ন রাখার জন্য সকল শিক্ষককে বেফাক-হাইয়ার কাছে নিবন্ধিত থাকা সময়ের অন্যতম দাবি। এটা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়, এ জন্য কোনো নিবন্ধন পরীক্ষারও দরকার নেই। বেফাক-হাইয়ার নির্ধারিত ফরম পূরম করে জমা প্রদান করে কর্তৃপক্ষের মঞ্জুরি স্বাপেক্ষে সহজ নিবন্ধন ধারা চালু করা যায়। বেফাক-হাইয়া কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সকল তথ্যের কলাম রেখে ফরম তৈরি করবে। পাঠদানে আগ্রহীরা ফরম পূরণ করে জমা দিলে কর্তৃপক্ষ তাদের নিবন্ধন নম্বর দেবে। আর নিবন্ধন রেজিস্টারে ফরমের সকল তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। ভবিষ্যতের বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করারও কলাম তাতে থাকবে।

নিবন্ধন বাতিলেরও একটা স্বচ্ছ নিয়ম থাকবে। তাতে উল্লেখ থাকবে, কোন কোন অপরাধে নিবন্ধন বাতিল হবে, অপরাধ কিভাবে প্রমাণিত হবে, অপরাধের তথ্য কার মারফত কিভাবে আসতে হবে। কোন ধরণের অপরাধে নিবন্ধন বাতিল না হলেও অপরাধ নিবন্ধন রেজিস্টারে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে।

গ্রাম পর্যায়ের মাদরাসা এবং প্রাইভেট মাদরাসাগুলোর অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধের জন্য নিবন্ধনকে একাধিক মারহালাতে বিভক্ত করা যেতে পারে। মুতাওয়াসসিতা, ছানাবিয়া, তাকমিল অথবা ছানাবিয়া, তাকমিল এভাবেও বিভক্ত করা যেতে পারে। নচেৎ অনেক সময় দেখা যায় নুরুল ইজাহ পড়ানোর যোগ্যতা নেই দিব্যি তাকে হেদায়া দেওয়া হয়েছে। নিজে ইবারত পড়তেও পারে না, তরজমাও করতে পারে না, নোট দেখে দারস পাড়ি দেয়। আর মারহালাভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এখনতো বলতে গেলে কওমি মাদরাসায় কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণের (নূরানি প্রশিক্ষণ ছাড়া) ব্যবস্থা নেই।

বেফাক-হাইয়া আইন করতে পারে, শর্তারোপ করতে পারে, অনিবন্ধিত কোনো ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না।

কোনো নিয়ম-নীতি না থাকায় কোথাও শিক্ষক নির্যাতিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় আবার কোথাও প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারাদেশে সকল কওমি মাদরাসা এক নিয়মে পরিচালিত হতে হবে তা বলছি না। তবে প্রতিটি মাদরাসার নিজস্ব নিয়মগুলো লিখিতভাবে থাকা দরকার এবং তা বেফাক-হাইয়ার গোচরিভূতও থাকা দরকার।

শিক্ষকতা আর পাঁচটা চাকরির মতো নয়। এ বিষয়টা সদ্য শিক্ষকতায় যোগ দেওয়া মানুষটি মনে আসে না। কারণ নিয়মিত ক্লাসের বাইরে জ্ঞান বিতরণ যে আলাদা কিছু, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা হয়নি প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে।

সুতরাং ঢেলে সাজাতে হবে বর্তমান শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। বেতন কাঠানো নির্ধারণ, বেতনবৈষম্য কমানো থেকে শুরু করে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে কঠোর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে কিন্তু আখেরে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

মোটাদাগে বলা চলে, শিক্ষক নিবন্ধন পদ্ধতি চালু, নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা সংরক্ষণ, শিক্ষক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, নিবন্ধনহীন শিক্ষক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা, মাদরাসাগুলোর জন্য নিজস্ব নিয়োগ বিধি-অব্যাহতি বিধি-ছুটি বিধি বাধ্যতামুলক করা, নিয়োগ রেজিস্টার, নিয়োগ ফাইল ও নিয়োগপত্র বাধ্যতামূলক করা, নিয়োগপত্রের অনুলিপি বোর্ডে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, অব্যাহতি নিয়ে শিক্ষক-মাদরাসা দ্বিপাক্ষিক মতানৈক্য হলে বোর্ডকে জানানো এবং বোর্ডের মাধ্যমে সুরাহার ব্যবস্থা জটিল কিছু নয়। এগুলোর জন্য দরকার শুধু সদিচ্ছা। এখন প্রশ্ন হলো- সেই সদিচ্ছাটুকু কী আমাদের আছে?

মুফতি মাহফূযুল হক: কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন:
কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠন আবশ্যক

দুই লক্ষাধিক কওমি শিক্ষকের কথা ভাববার কেউ নেই!

কওমি শিক্ষকদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা

কওমি মেরুদণ্ড যেভাবে সোজা রাখতে পারি

করোনার কবলে কওমি মাদরাসার শিক্ষক-পরিচালক, অতঃপর...

বিপদগ্রস্ত কওমি শিক্ষকের কথা বলা কী অন্যায়?

কওমি মাদরাসার মুহতামিমদের প্রতি অনুরোধ