এক নজরে নুসরাত হত্যাকাণ্ড ও মামলার রায়
নুসরাত হত্যাচলতি বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে নৃশংস হত্যার ঘটনা। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত।
গায়ে আগুন দেওয়ার আগে নুসরাতের সঙ্গে যা ঘটেছিল
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। তাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে।। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ মার্চ ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার। পরদিন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দী দেন নুসরাত জাহান।
এ মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠায় পুলিশ। পরে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়।
যেভাবে মারা হয় নুসরাতকে-পিবিআইয়ের বর্ণনা
৬ এপ্রিল সকালে শাহাদত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদরাসায় আসে এবং পরিকল্পনা মতো যার যার অবস্থানে যায়। শাহাদত হোসেন পলিথিনে করে আনা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে আনা গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। কামরুন্নাহার মনির তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাত মোজা পরিধান করে সেখানে অবস্থান নেয়। নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা মতো উম্মে সুলতানা পপি গিয়ে নুসরাতকে বলে, তার বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে।
একথা শুনে নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায় পপি। নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে ছাদে উঠলে কামরুন্নাহার মনি, শাহাদত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পেছনে ছাদে যায়। সেখানে তারা নুসরাতকে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে নুসরাত অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহাদত হোসেন শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ও পপিকে বলে নুসরাতের বোরকার মধ্য থেকে ওড়না নেওয়ার জন্য। পপি ওড়না নিয়ে জুবায়েরকে দেয়। জুবায়ের এক অংশ দিয়ে পা বাঁধে ও পপি হাত পেছনে বেঁধে ফেলে। এরপর পপি, মনি ও শাহাদাত তাকে শুইয়ে ফেলে। পরে তাকে মুখ চেপে ধরে গিঁট দেয়া হয়। জাভেদ কালো পলিথিনে থাকা তেল গ্লাসে করে নিয়ে নুসরাতের শরীরে ঢেলে দেয়।
শামীমের ইঙ্গিতে জোবায়ের তার কাছে থাকা ম্যাচ থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়, তারপর সেখান থেকে সবাই চলে যায়। আদালতে এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে অভিযুক্তরা।
শিক্ষক-কর্মচারীরা নুসরাতকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল নুসরাতের মৃত্যু হয়।
মামলা
এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। গত ২৮ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত শেষে মাদরাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে পিবিআইয়ের লাগে ৩৩ কার্যদিবস।
মামলার কার্যক্রম
গত ১০ জুন নুসরাত হত্যা মামলাটি আদালত আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে বিচার কাজ শুরু হয়। ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন সাক্ষ্য দেন।
এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও বাদীপক্ষের খণ্ডন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ২৪ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করেন।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের রায়
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়। বেলা ১১টায় অভিযুক্ত ১৬ জন আসামিকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নিয়ে আসা হয়। সোয়া ১১টায় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ নুসরাত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। তিনি ১৩ মিনিটেই নুসরাত হত্যা মামলার রায় পড়া শেষ করেন। এতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ ১৬ আসামির মত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা
মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নুর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদরাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদরাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর আসামি মাদরাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের, আট নম্বর আসামি মাদরাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন, মাদরাসার ফাজিল প্রথম বর্ষ ও ফেনী পলিটেকনিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রলীগকর্মী মো. শামীম, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলন সদস্য ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এমরান হোসেন মামুন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ইফতেখার উদ্দিন রানা, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রদলকর্মী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন শাকিল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রুহুল আমিন, মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপি ও মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী কামরুন নাহার মনি।
রায় নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ-আসামি পক্ষের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর এজলাসে কান্নায় ভেঙে পড়েন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা। তারা এ সময় উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘একটা আত্মহত্যাকে হত্যা সাজিয়ে আমাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে এই রায় ঘোষণা করা হয়েছে।’ এ সময় এজলাসে নুসরাত হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাকে সবচেয়ে বেশি কান্না করতে দেখা যায়।
এদিকে, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার রায়ে সরকার স্বস্তি প্রকাশ করছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘অবিশ্বাস্য মনে হলেও বিচার প্রক্রিয়াটা ত্বরান্বিত হয়েছে, দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে, এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বস্তি প্রকাশ করছি।’
পরিবারের প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে, আদালতের রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন নুসরাতের পরিবার। রায় শুনে নুসরাতের বাবা একে এম মুসা জানান, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট। দ্রুত যেন রায় বাস্তবায়ন করা হয়। এছাড়া আসামি পক্ষ যদি হাইকোর্টে আপিল করে তারপরও যেন, এই রায় বহাল থাকে।
নুসরাতের মা শিরীন আখতার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অবদানের কারণে আজকে আমরা নুসরাত হত্যার সুষ্ঠু বিচার পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী খুবই দুঃখ করে আমাকে বলেছিলেন, আমি মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি তারপরও তাকে বাঁচানো যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তার সুষ্ঠু বিচার হবে। আমরা আজ বিচার পেয়েছি।’