ব্রাজিলের বিস্ময়

, ফিচার

ভূ-পর্যটক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল | 2023-09-01 22:16:39

ব্রাজিলের নাম শোনেনি এমন লোক পৃথিবীতে খুব কমই পাওয়া যাবে। সেই কবে কোন ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের কল্যাণে পেলের নাম শুনে বড় হয়েছি। পৃথিবীতে ব্রাজিলই একমাত্র দেশ যার সঙ্গে সবচেয়ে বেশী দেশের স্থল যোগাযোগ রয়েছে। চিলি ও ইকুয়েডর ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার সব দেশের সঙ্গে ব্রাজিলের বর্ডার রয়েছে। দেশগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, পেরু, কলম্বয়িা, ভেনিজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম, ফ্রেঞ্চ গায়ানা। ব্রাজিলের আয়তন ৮৪৫৬৫১০ বর্গ কি.মি., যা বাংলাদেশের চেয়ে ১৫২ গুণ বড়। পৃথিবীতে ৫ম বৃহত্তম। শুধু দেশ হিসাবে তারা বড়ই নয়, আরোও অনেক কিছু রয়েছে যার কৃতিত্ব শুধু ব্রাজিলের।

UNWTO এর আমন্ত্রণে সর্বপ্রথম দক্ষিণ আমেরিকার আজেন্টিনা, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়েতে একটি কনফারেন্সে যোগদান করি ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে। কনফারেন্স শেষে তিন মাসে ল্যাটিন আমেরিকার পাঁচটি দেশ আজেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া ও চিলি ঘুরে আসি। পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকবার দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। ভবিষৎতে আবারো সুযোগ পেলে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বাকী দেশগুলো ঘুরে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।


বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত রয়েছে ব্রাজিলে। নাম ক্যাসিনো বিচ যা ব্রাজিলের Rio Grand do Sul- এ অবস্থিত। এটি ২১২ কি.মি থেকে ২৫৪ কি.মি বিস্তৃত Longest Uninterrupted sandy seashore in the world এবং এটি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখেছে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। এটি দেখতে বছরে ১৫ লক্ষাধিক পর্যটক আসেন।

ক্যাসিনো বিচের পরেই দীর্ঘতম বিচ হিসেবে রয়েছে Padre Island, Texas, USA, যা ১৮২ কি.মি. এটাকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা Drivable Beach। নাইনটি মইল বিচ ১৫১ কি.মি. (৯৪ মাইল) লম্বা। তারপরেই রয়েছে আমাদের কক্সবাজার বিচ যা ১৫০ কি.মি. (৯৩ মাইল)। বিশ্বের দীর্ঘতম নদের নাম নীল নদ (মিশর) এবং তারপরই রয়েছে আমাজন। তবে নীল নদের চেয়ে আমাজনের পানির ধারণ ক্ষমতা বেশী। সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রজাতির গাছ ও প্রাণির দেখা পাওয়া যায় ব্রাজিলে। ব্রাজিল সম্পর্কে ছোট করে লিখা অসম্ভব কারন সৃষ্টিকর্তা ব্রাজিলকে দিয়েছেন দু’হাত ভরে অকৃপনভাবে। আর তাই হয়তো ব্রাজিলিয়ানরা বলে থাকেন, সৃষ্টি কর্তা হচ্ছে ব্রাজিলিয়ান (Deus e brasileiro)।


ব্রাজিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে কার্নিভালের সময়। আবহাওয়া বিবেচনায় এপ্রিল-জুন আর আগষ্ট-অক্টোবরও সেরা সময়। তবে মনে রাখবেন, করোনার টিকার পাশাপাশি Yellow Fever টিকা আবশ্যক। যারা আমাজনে যাবার পরিকল্পনা করবেন তাদের জন্য হেপটাইসিস, টিটেনাসের টিকা ও ম্যালেরিয়ার ওষুধ নিয়ে যাওয়া উচিত।

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাজিলের (Foz do lguagu) ফজ দ ইগুয়াজুতে যাই যা ইগুয়াজু ফলস নামে পরিচিত। ফলসটি ২.৭ কি.মি এবং সেখানে ২৫টি একক ঝরনা রয়েছে যা এটিকে New Natural Seven Wonders of the World এ খেতাব এনে দিয়েছে। ল্যাটিন বা দক্ষিণ আমেরিকা বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে এবং আমাদের বাংলাদেশি লোকজন ও খুব বেশী নেই। যদিও গত ১০ বছরে বেশ লোকজন ছিল। কিন্তু করোনা মহামারির বিপর্যয়ে ও অর্থনৈতিক ধসে বেশীর ভাগ লোকজন অবৈধভাবে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। বর্তমানে আনুমানিক ১০০০-১৫০০ বাংলাদেশি রয়েছে ব্রাজিলে।


সাও পাওলো টু রিও

একটা শহর যে এত বড় হতে পারে সাও পাওলো না এলে বিশ্বাসই হতো না। ৪১ মিলিয়ন লোকের বসবাস। সারা বিশ্বের লোক সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ১০টি শহরের একটি। সাও পাওলোতে কামরুলের বাসায় অবস্থান করছি। কামরুলের সাথে ঢাকায় পরিচয় হয়েছিল। কামরুলের বড় ভাই কামাল দীর্ঘদিন ধরে ব্রাজিলে রয়েছে। বিয়ে করেছেন এক ব্রাজিলিয়ানকে। যে অল্প কয়েক জন বাংলাদেশি ব্রাজিলের পাসপোর্ট পেয়েছেন কামাল তার অন্যতম। ব্রাজিলের পাসপোর্টে পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে ভিসার ঝামেলা ছাড়াই যাওয়া যায়। বিশ্বের বিশতম শক্তিশালী পাসপোর্ট।

২০১৫ এর দিকে সাও পাওলোতে এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ছিলেন। যদিও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। কারণ কিছু লোক যেমন প্রতিদিন ব্রাজিলে আসছেন, ঠিক তেমনি কিছু লোক ব্রাজিল ত্যাগ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে। সাও পাওলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এয়ারপোর্টের নাম Guarulhos যা শহর থেকে ৩০ কি.মি. পূর্বে অবস্থিত। এতবড়  শহর আরও বড় মনে হতো ভাষাগত সমস্যার কারণে। ব্রাজিলের ভাষা পুর্তগীজ। ল্যাটিন আমেরিকার সব দেশেই স্প্যানিশ ভাষা চলে, শুধু ব্রাজিলে পর্তুগীজ।


এ দেশ আয়তনে যেমন বড়, তেমনি এর খাবার, পোশাক, আবহাওয়া, জীববৈচিত্যও অনন্য। টাইম জোন রয়েছে ৪টি। মজা করে অনেকে বলেন, যখন একজন ব্যক্তি চারটি ঘড়ি পড়ে কোথাও যান তখন বুঝতে হবে তিনি ব্রাজিলে যাচ্ছেন। এ যেনো একের ভেতরে অনেক দেশের মিলিত রূপ।

সাও পাওলোকে অনেকে ডাকেন সাম্পা। ব্রাজিলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইমিগ্র্যান্টদের বসবাস এই সাও পাওলো শহরে। সাও পাওলোর আয়তন ৭৯৪৩ বর্গ কি.মি.।

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে অনিকের সাথে প্যারাগুয়েতে পরিচয় হয়েছিল এবং বর্তমানে সে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে রয়েছে (২০১৫)। অনিকের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সে স্প্যানিশ, পর্তুগীজ ভাষায় পারদর্শী। তার ওখানে খায়রুলের সঙ্গে পরিচিত হই। সেও ভালো পর্তুগীজ বলতে পারে। একসময় বাংলাদেশে ভালো ক্রিকেট খেলতো। খায়রুল আমাকে বেশ সময় নিয়ে সাও পাওলোর দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরিয়ে দেখালো।

সাও পাওলোর Liberdade এলাকাটি মূলত জাপানীজ, চাইনীজ ও কোরিয়ানদের দখলে। তবে শহরটির ভিতর ইতালীয়ন প্রভাব অনেক। ৬ মিলিয়ন লোকের রয়েছে ইতালীয়ান ব্যাকগ্রাউন্ড। তবে সংখ্যায় অল্প কিন্তু প্রভাবশালী কমিউনিটির মধ্যে আরব ও ইহুদীদের প্রভাব রয়েছে। যদিও শহরের ৪০ শতাংশ লোক এসেছে ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের। তাদের বলা হয় Paulistanos।


পরিশ্রমী হিসেবে সাও পাওলোর লোকদের সুনাম রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, যখন সাও পাওলোর লোকেরা কাজ করে তখন বাকী ব্রাজিলিয়ানরা আরাম করে। আরও বলা হয়ে থাকে, দেশটির ৪৫ শতাংশ উৎপাদনের আয় আসে এই সাও পাওলো প্রদেশ থেকে। সাও পাওলোর অবশ্যই দর্শনীয় স্থান হচ্ছে Avenida Paulista সেখান থেকে হেটেই Ibirapuera এবং Park Centro যাওয়া যায়। Sao Paulo Stock Exchange হচ্ছে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম স্টক একচেঞ্জ। পিৎজার জন্যও সাও পাওলো বিখ্যাত। Sao Paulo is the second largest consumer of pizza in the world। ৩০৫ বিলিয়ন ডলারের স্টক একচেঞ্জ হয় প্রতিদিন সাও পাওলোতে। খাইরুলের সাথে পাউলিস্তার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিশাল বড় রাস্তা পথচারীদের হাঁটার জন্য। দুপাশে নয়ন জুড়ানো সুউচ্চ অট্রালিকা আকাশ পানে চেয়ে আছে। কিছু জায়গায় দেখলাম সুভ্যেনির নিয়ে রাস্তায় বিক্রি করছেন কিছু লোক, পর্যটক সমাগম রয়েছে এই এলাকটিতে। ব্রাজিলিয়ান বিখ্যাত আর্কিটেক্ট অস্কার নেইমার একটি স্থাপত্য দেখলাম। অস্কার নেইমা একজন পৃথিবী বিখ্যাত আর্কিটেক্ট। সারা ব্রাজিল জুড়েই যার স্থাপত্য নির্মাণ শিল্পীর নিপুন কাজ রয়েছে। সাও পাওলোতেই তার ৮/১০টি কাজ রয়েছে এবং সম্প্রতি আরেকজন বিখ্যাত আর্টিস্ট Eduardo kobra যিনি Street Art এর জন্য বিখ্যাত, সাও পাওলোর সন্তান এবং ব্রাজিল ছাড়াও ৫টি মহাদেশে ৩০০০ মুরাল তৈরি করেছেন। পাউলিস্তার রাস্তায়ও কোবরার তৈরি করেছেন ওস্কার নেইমারের ম্যুরাল। খুবই আকর্ষণীয়। সারা ব্রাজিলের রাস্তায় প্রচুর Street Printing এবং গ্রাফিতি আর্ট।  Banksy নামের একজন ব্রিটিশ আর্টিস্ট এই গ্রাফিতি আর্টকে জনপ্রিয় করেন।


১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাজিল স্বাধীনতা লাভ করে পর্তুগাল থেকে। বর্তমানে রাজধানী ব্রাসিলিয়া, এর আগে রাজধানী ছিল রিও ডি জেনেরিও এবং সালভাদর। ব্রাজিলে যত আন্তজাতিক কোম্পানির অফিস রয়েছে তার ৬৩ শতাংশ সাও পাওলোতে। সাও পাওলো বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহরগুলির একটি। অভিজাত শপিং বা উইনডো শপিংয়ের জন্য যেতে পারেন Jardins, JK শপিং মল ও Iguatemi তে।

ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবল পাগল জাতি আর তাইতো সাও পাওলো শহরে রয়েছে ফুটবলের জাদুঘর। ফুটবল প্রেমীদের জন্য আবশ্যই দর্শনীয় স্থান। ১৯৫০ ও ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয় এই শহরে। ফর্মুলা ওয়ান ব্রাজিলের অন্যতম জনপ্রিয় স্পোর্টস। তারা তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হয়েছে রেসে।

এত বড় যে, আনায়াসে হারিয়ে যাওয়া যায় Sao Paulo Tiete Bus টার্মিনালে। বিশ্বের ২য় বৃহত্তম বাস টার্মিনাল। খায়রুল আমাকে নিয়ে সেই বাস টার্মিনালে। সেখান থেকে রিওর কাছাকাছি পারিবা দ্যা সল যাব। দুরত্ব ৪২৩ কি.মি. যেতে ৬/৭ ঘণ্টা লাগবে। পারিবা দ্যা সেল এ রাখাল বাবু নামে এক বাংলাদেশি থাকেন। তার কাছে যাব। রাখাল মালয়েশিয়া থেকে ব্রাজিলে এসেছে। একটি গ্লোভস তৈরির কারখানাতে চাকুরি করে। বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। রাখাল বলে দিয়েছিলো। রাতে কামরুল ও তার রুমমেট রুমান আমাকে মসজিদ পার্কের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিলো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর