মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে সূর্যমুখী। বাস্তব জীবনের নিস্তব্ধতা ভাঙছে তার হলুদ আভায়। মৌমাছির আলিঙ্গন পেতে ছড়াচ্ছে উষ্ণ মুগ্ধতা। হলুদের কারুকার্যে বিমোহিত হচ্ছে পথিকের মন। লুকায়িত সৌন্দর্য প্রকৃতির মাঝে তুলে ধরে প্রবল আকর্ষণে টানছে দর্শনার্থীদের। সবুজ পাতা ভেদ করা সেই অনিন্দ্য হাসি যেন কৃষকের মুখেরই প্রতিচ্ছবি। সূর্যমুখী ফুল চাষে জনপ্রিয়তা বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।
সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। সূর্যমুখী গাছ লম্বায় ৩ মিটার (৯ দশমিক ৮ ফুট) হয়ে থাকে। ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এই ফুল দেখতে কিছুটা সূর্যের মতো এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। ফুলের বীজ হাঁস-মুরগির খাদ্যরূপে ও তেলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জানা যায়, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের উৎস হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে এ ফুলের চাষ শুরু হলেও কৃষকের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় নি বহুদিন। পরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বর্তমানে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর জেলা, পাবনা, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলাতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
সোমবার (১২ মে) সকালে সরেজমিনে নওগাঁ সদর উপজেলার মুক্তির মোড় কেন্দ্র শহীদ মিনারের পাশে দেখা যায়, সূর্যমুখী বাতাসে; দুলছে আলোর প্রতিফলনে পাপড়িগুলো যেন চকচকে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে। মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্যফুলে মধু আহরণে ছুটাছুটি করছে আর এসব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে পথচারীরা। এছাড়াও নওগাঁর বেশ কিছু অঞ্চলে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী। একদিকে যেমন ফুলগুলো সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে তেমনি বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে সূর্যমুখীর বীজ। সূর্যমুখী গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
প্রতিদিন ভোরে সূর্যমুখী বাগানের সকল গাছ অনেকটা পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। যেদিকে সূর্য দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে। সূর্যের সাথে সাথে সূর্যমুখীগুলোও ধীরে ধীরে নিজেদের দিক পাল্টাতে থাকে। সূর্য যেদিকে যায় তারাও সেদিকে যায়। সবসময়ই এগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তারাও তখন পশ্চিম দিক বরাবর থাকে। অস্ত যাওয়ার পরে তারা রাতব্যাপী আবার উল্টো দিকে ঘুরে পূর্বমুখী হয়। এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এই চক্র চলতেই থাকে।
তবে সবার মাঝে একটি প্রশ্ন অনেক সময় ঘুরপাক খায় যে সূর্যমুখী ফুল কেন সূর্যে দিক হয়ে থাকে! সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এই দিক পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য উন্মোচন করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এই চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সব সময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। গবেষকরা সায়েন্স জার্নালে তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়িকে অনেক সময় ‘দেহঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এই চক্র বিদ্যমান। যেমন প্রত্যেক মানুষেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম চলে আসে।
পথচারী রায়হান বলেন, ফুল শুভ্রতার প্রতীক ও পবিত্র। ফুলকে যারা ভালোবাসে তাদের মনটাও সুন্দর। সূর্যমুখী ফুল সব ফুলের চেয়ে আলাদা কারন সূর্যের দিক মুখ করে বেশিরভাগ থাকে এ ফুল। বিশেষ করে দুপুর শুরু হলে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এ ফুল যা দেখতেও খুব সুন্দর লাগে তাছাড়া এ ফুলের বীজ থেকে তেল হয় যা অনেক স্বাস্থ্যকর।
ক্ষুদে শিক্ষার্থী আফরিন (১০) জানায়, আমি ফুল খুবই ভালোবাসি আর সূর্যমুখী ফুলগুলো হলুদ হবার কারনে আরো বেশি ভালো লাগে। নামটা যেমন সুন্দর তেমনি মুগ্ধতাও ছড়ায়। ফুলগুলো থেকে তেল হয় তাই কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। আমরা দূর থেকে দেখেই শান্তি পাই।
স্থানীয় বাসিন্দা আরেফিন তুহিন বলেন, স্বল্প পরিসরে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যারা সূর্যমুখী ফুলের গাছ লাগিয়েছে তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ফুল মানেই সুন্দর সূর্যমুখীও এটিএ ব্যাতিক্রম নয়। মাঝে মাঝে যখন ফুলের দিকে চোখ যায় খুব ভালোলাগা কাজ করে। এ ফুল দেখতে যেমন সুন্দর এটির তেল ও খুব পুষ্টিকর।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরে সূর্যমুখী চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ হেক্টর ও অর্জন হয়েছে ৬৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন হয়েছে ১০০ মেট্রিক টন।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন- সূর্যমুখী একদিকে যেমন শুভ্রতার প্রতীক আবার অন্যদিকে বীজ থেকে তেল উৎপাদন হয় আবার মধুও পাওয়া যায়। বাজারে যে ভৈজ্যতেল গুলো রয়েছে যেমন, সয়াবিন,সরিষা, পাম-ওয়েল ইত্যাদি এগুলোর চেয়েও অনেক বেশি পুষ্টিগুণ আছে সূর্যমুখীর তেলে যা স্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যর জন্য খুবই উপকারী। আমরা বেশি বেশি উৎপাদনে কৃষকদের সব রকম পরামর্শ দিয়ে থাকি।