বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
ধর্মং শরণং গচ্ছামি।
সিদ্ধার্থ গৌতম খৃষ্টপূর্ব ৫৬৪সালে(এই সাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে) কপিলাবস্তুর লুম্বিনীতে (বর্তমানে নেপালের অন্তর্গত) শাক্য রাজা শুদ্ধোধন এর প্রাসাদে তাঁর মহিষী মায়া দেবীর ঔরষে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।
তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। রাজকার্য তাঁকে আকর্ষণ করতো না। জীবনের গূঢ় রহস্য নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন। তিনি লক্ষ্য করলেন সংসারে কর্মই প্রধান। বাকি সবই অনিত্য। তিনি ভাবতেন জরা, ব্যাধি, মৃত্যু থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে। যৌবনের এক পর্যায়ে প্রাসাদে মাতা, পিতা, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে রেখে এক রাতে তিনি বেরিয়ে পড়েন পথে। গ্রহণ করলেন শ্রমণের জীবন।
একসময় তিনি গয়ার নিকট উরুবিল্ব (বর্তমানে ভারতের বিহারের বৌদ্ধগয়া) গ্রামে এক বৃক্ষতলে মোক্ষলাভের উপায় ভাবতে জাগতিক সমস্ত আকর্ষণ ত্যাগ করে ধ্যান করতে বসেন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত অবস্থায় এক বৈশাখী পূর্ণিমায় তিনি আলোকপ্রাপ্ত হন। তিনি লাভ করলেন দিব্যজ্ঞান। এই জ্ঞানই হলো অজ্ঞানতা ও অশিক্ষা, লোভ এবং আকাঙ্খা, রোগ ও দুঃখভোগ এবং পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি। সেই মুক্তিলাভের উপায় হলো জীবন যাপনে শুদ্ধাচার।
তাঁর আশি বছরের জীবনের বাকি অংশ তিনি কাটালেন তাঁর মোক্ষলাভের সূত্র এবং লোভ, হিংসা-দ্বেষহীন পরোপকারের জীবন ধারণের জন্য শিষ্য এবং শিষ্যদের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করে। বারানসীর অদূরে সারনাথে প্রথম পাঁচজনকে তিনি শিষ্যত্বে বরণ করেন। এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বর্ধিত হতে থাকে এবং প্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিকে দিকে। বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় তাঁর এই প্রচার।প্রথমে গাঙ্গেয় অববাহিকাতে চলে এই প্রচারাভিযান। পরে তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এইভাবে শান্তির অমোঘ বাণী প্রচারে বাকি জীবন কাটিয়ে তিনি যখন বুঝলেন তাঁর ধরাধাম ত্যাগের সময় হয়েছে, তখন তিনি তাঁর প্রচার সাথী শিষ্যদের উদ্দেশ্যে শেষ দেশনা প্রদান করেন। সেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেন যে তিনি তাঁদের পথের দিশা দেখিয়ে গেলেন মাত্র। মানুষ মরণশীল।মানব জীবনে দুঃখ,কষ্ট জরা,ব্যাধি অবশ্যম্ভাবী।তাই জীবদ্দশায় উচিৎ সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্টির সকল জীবের কল্যাণসাধন করা।তাঁদেরকে নিজের আত্মাকে আলোকিত করে নিজেকেই আলোকপ্রাপ্ত হতে হবে।
মল্ল রাজত্বভুক্ত কুশিনগরে তিনি মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। কি আশ্চর্য! সেই দিনটিও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই তিন বিশেষ দিনের সমষ্টিকে ভেসাক ডে হিসাবে পালন করা হয়। ভারত থেকে তিব্বত হয়ে চীন, জাপান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর সহ পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম একসময় ছড়িয়ে পড়ে। যার বিপুল প্রভাব এখনো বিদ্যমান।
শাক্যমুণি গৌতমবুদ্ধর প্রধানতম শিক্ষা ও প্রার্থনা হলো জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক। সিদ্ধার্থ গৌতমের ধর্ম গ্রহণ করে সম্রাট অশোক তা তাঁর রাজত্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে দেন। সম্রাট অশোক লুম্বিনীতে তীর্থভ্রমণ করাকালীন একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন। সেই স্তম্ভে ব্রাহ্মী লিপিতে শাক্যমুনি বুদ্ধ কথাটি পাওয়া যায়। এর অর্থ করা যায় শাক্যদের মধ্যে তপস্বী ও আলোকপ্রাপ্ত।
মহামতি বুদ্ধের বাণী প্রথম দিকে ছিল শ্রুতি নির্ভর। পরবর্তীতে তা ভিনায়া বা প্রচারকদের (বর্তমানকালের শ্রমন বা ভান্তে) জন্য প্রতিপালনীয় বিধান ও সুত্ত পিতাকা বা বুদ্ধদেবের উপদেশসমূহ তাঁর শিক্ষা হিসাবে লিপিবদ্ধকরণ করা হয়। আরও পরে তাঁর অনুসারীরা অভিধর্ম, জাতক কাহিনী, মহাযান সূত্র ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার মধ্যে জাতক কাহিনীতে সিদ্ধার্থ গৌতমের পূর্ববর্তী জন্মসমূহের কথা লিপিবদ্ধ আছে। আলোকপ্রাপ্ত হয়ে পুনর্জন্ম থেকে মহামুক্তির আগে তিনি পূর্ব জন্মসমূহের কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন।বেশিরভাগ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ আদিকালে পালি ভাষায় লিখিত হয়েছিল।
জ্ঞান অন্বেষণকে বৌদ্ধ ধর্ম সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়। বৌদ্ধ যুগেই পৃথিবীর বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় রূপে পরিচিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। আমরা গর্ব বোধ করতে পারি যে আমাদের মাটির সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধ ধর্মকে তিব্বতে প্রচারে প্রধানতম ভূমিকা রাখেন।তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম রাজধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ও সেখান থেকে চীন,কোরিয়া,জাপান সহ এশিয়ার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিহাসের এক পর্যায়ে ভারতবর্ষের বিশাল এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রাবল্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা এই ধর্মকে সিংহল দ্বীপে(বর্তমান শ্রীলঙ্কা) প্রসারিত করেন।আজও পৃথিবীতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা বিভিন্ন ধারায় তাঁদের মহান শান্তির ধর্মকে পালন ও সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক