দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

, ফিচার

মাছুম কামাল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 21:18:03

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার নিদর্শন হিসেবে টিকে আছে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি’—যা ইংরেজ কবরস্থান নামেই স্থানীয়ভাবে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত বিভিন্ন দেশের ৭৩৬ জন যোদ্ধার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নির্মিত এই ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি’। যাদের মধ্যে ৩ জন নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক ও ১৬৬ জন বৈমানিক রয়েছেন।

যেসব দেশের নিহতরা রয়েছেন
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের ৩৬৭ জন, কানাডার ১২ জন, অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন, নিউজিল্যান্ডের ৪ জন, দক্ষিণ আফ্রিকার ১ জন, অবিভক্ত ভারতের ১৭৮ জন, রোডেশিয়ার ৩ জন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ জন, বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) ১ জন, বেলজিয়ামের ১ জন, পোল্যান্ডের ১ জন ও জাপানের ২৪ জন সৈনিক।

গণকবরের নামফলক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি ও নিহতদের কাহিনী
১৯৪১-১৯৪৫ সালে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালে বার্মার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ব্রিটিশ ভারতীয় ও স্থানীয় সৈনিকদের দুটি দুর্বল ডিভিশনে সংঘটিত করা হয়, যার একটি বার্মার রেঙ্গুনের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথ রক্ষার জন্য এবং অন্যটি (যেটির সাথে পরে চীনা সেনাবাহিনী যুক্ত হয়) মধ্য বার্মাকে পূর্ব দিকের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য।

১৯৪১ সালে জাপানিদের আমেরিকার ওপর হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের শুরু। এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনের অভিমুখে সমরাস্ত্র ও রসদ সরবরাহের পথ বার্মারোড বন্ধ করা। কিন্তু ১৯৩৭ সাল থেকেই জাপান, চীনে যুদ্ধরত ছিল। এই হামলায় ১৯৪২ সালের ডিসম্বরে কিছু সাফল্যও পায় জাপান। কিন্তু পরবর্তী ছয় মাস এটি প্রতিহতও হয়।

১৯৪৩ সালে দুটি আক্রমণাত্মক হামলা হয়। আকিয়াব এলাকা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়। মূলত ১৯৪৪ সালের মে মাসের দিকে জাপানের মূল আক্রমণ শুরু হয়। এই হামলার লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর অনুমেয় আক্রমণ প্রতিহত করা ও আসামে অনুপ্রবেশ করে লোডো সড়ক এবং চীনে রসদ সরবরাহ করার জন্য ব্যবহৃত বিমানক্ষেত্রগুলো বিধ্বস্ত করা। একে কেন্দ্র করে পরবর্তী তিনমাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

এই সমাধিতে সমাহিত সকলেই অবিভিক্ত ভারতের মুসলিম সৈনিক

তৎকালীন কুমিল্লা একটি বৃহৎ হাসপাতাল ও সমর সরবরাহ কেন্দ্র এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলেই ছিল চতুর্দশ সেনাবাহিনীর প্রধান দফতর। আর সেই সূত্রেই তৎকালে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় ও নিকটবর্তী নিহত সৈনিকদের সমাধিস্থলটিই বর্তমানের ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত অন্যান্যদের স্মৃতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন প্রায় ৪৫,০০০ কমনওয়েলথ সৈনিক। যার মধ্যে রয়েছেন ২৭,০০০ ভারতীয় সৈনিক। এদের অধিকাংশেরই বয়স ২২ থেকে ৩০-এর মধ্যে। তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষতি রয়েছে বার্মা, আসাম ও বাংলাদেশের নয়টি রণ সমাধিক্ষেত্রে।

নিহত একজন ব্রিটিশ বৈমানিকের সমাধিফলক

ভারতীয় ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে দীর্ঘতম (প্রায় ১০০০ মাইল) পশ্চাদপসরণ দিয়ে সূচিত এই সমরাভিজান পরিণতি লাভ করে উত্তরের পথে বার্মা বিজয়ে, যা ইতিহাসের একটি অনন্য-সাধারণ ঘটনা। তবে, কোনো যুদ্ধের ফলই শেষ পর্যন্ত যতটা জয় কিংবা পরাজয়ের তারচেয়ে বেশি দুঃখ এবং বেদনার।

কমনওয়েলথের যুদ্ধ সমাধি কমিশন কর্তৃক ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি’র নবপর্যায়ের নামকরণ ও সংস্কারকাজের পর বর্তমানে তারাই সিমেট্রির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বেও নিয়োজিত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর