দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান

  • মহীবুল আজিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

নতুন বিপত্তি দেখা দিতে থাকে একাধিক। প্রথমত খায়ের আর জান্নাতের নির্জনতার দিন শেষ। খানিকটা একটেরে তাদের ঘরটা এই সুপুরির বেড়া-ঘেরা নির্জনতায় বেশ ভালই ছিল। ফুলবানুর চিকিৎসাজনিত জটিলতাহেতু মৃত্যুর পর সে খুব হতাশ হয়ে পড়ে কিন্তু থানা-অফিসের পিয়ন খায়ের এমন সুন্দরী বউ পাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবে নি। তার ওপর এখন এই তেল-গ্যাসপ্রাপ্তি তাকে দ্বিগুণ উৎফুল্ল করে তোলে। কিন্তু লোকেদের ভিড়ে নিজেদের শান্তি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে একটা মিহি হতাশা তাকে পেয়ে বসে। চেহারা খুব সুশ্রী না হওয়ায় তার মনে একটা বিষন্নতা সবসময়েই ছিল। তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয় সন্দেহ। সে যখন থানা-অফিসে তার কাজে যায়, আগে হলে বউ জান্নাত থাকতো ঘরে। একা-একা ঘরগেরস্থালি নিয়ে সে ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু তেল-গ্যাসের পরিবর্তিত বাস্তবতার পর দেখা গেল, খায়ের চলে যাচ্ছে থানা-অফিসে। কিন্তু লোকেরা এসেই চলেছে। বিশেষ করে উৎসাহী যুবকেরাই সংখ্যায় অধিক। তাদের কোলাহল শুনে জান্নাত এক-আধটু উঁকি মেরে দেখেই। দেখতে তাকে হয় তার নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে। গ্যাসে রান্না করতে এসে কেউ যদি ঢুঁ মেরে উৎসাহবশে তার ঘরের জিনিস নিয়ে চম্পট দেয় সেটা নিশ্চয়ই কাজের কথা নয়। খায়ের ভাবতে না চাইলেও ভাবনা তাকে চায়। যুবকেরা যদি উৎসাহের চোটে গ্যাস দেখতে এসে তার বউটাকে দেখতে থাকে এবং যদি যুবকদের কাউকে তার বউয়েরও পছন্দ হয়ে যায় সেটা আরেক বিপদ। আশেপাশে সুশ্রী যুবকের অভাব নেই। এদিকে আরেক ঝামেলার সূত্রপাত। আগুয়ান লোকেদের অনেকেই ডোবার পানির অস্বাভাবিক তৈলাক্ততা লক্ষ করলে তাদের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। তাদের মধ্যে যারা একটু প-িত গোছের তারা বলে, যেইহানে গ্যাস থাকে হেইয়ানো থাকে তার ভাই তেল। মানে তেল-গ্যাস ভাই-ভাই। কাজেই গ্যাসের সমান্তরালে তেলও ডোবায় থাকা সম্ভব এবং যখন ডোবার পানি তৈলাক্তই দেখায় তারা উৎসাহের বশে মগ-বালতি-হাড়ি-পাতিল ভরে ডোবার পানি নিয়েই চলে অবিশ্রান্ত।

দুপুরের আগে-আগেই খবরটা পায় খায়ের। কর্মবিরতির ফাঁকে ঘরে এসে সে খাবে। খানিকটা গড়িয়ে নিয়ে ফের চলে যাবে কাজে। কিন্তু তার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় দুলাল উদ্বিগ্নভাবে তাকে খবরটা দেয়-

বিজ্ঞাপন

: খায়ের ভাই, তুমি কী খবর জানো কিছু? তোমার ঘরের সামনের ডোবা সিঁচ্চা ফালাইছে মাইন্ষে। হাড়ি-পাতিল-বালতি ভইর‌্যা সব পানি লইয়া গেছে। হেই পানি সিদ্ধ কইর‌্যা অহনে সবতে তেল বাইর করতাছে পানির থেইক্যা।

শুনে খায়ের বিস্মিত। ভাবনাটা ছিল তারই মাথার মধ্যে। লোকে সেটা জানলো কী করে! দ্রুত বাড়ি এসে দেখে একদল লোক গ্যাসের আগুনে রান্না চড়িয়ে দিয়েছে এবং ভোজবাজির মত তার ডোবাটা পানিশূন্য হয়ে রয়েছে। ডোবার তলদেশে কাদায় কিছু মাছ থাকলেও থাকতে পারে। কাদার মধ্যে ইতস্তত সঞ্চরণ চোখে পড়ে। বেচারা খায়ের কী আর করে। ছিল একটা সমান জায়গা। সেটা থেকে মাটি নিয়ে সে ঘরের ভিটে উঁচু করেছে। তারপর বৃষ্টি এসে মাটিকাটা জায়গাটাকে ডোবা বানিয়ে দিয়েছে। এখন লোকে সেই ডোবাকে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে জলশূন্য করে দিলে সে আর কী করতে পারে। সে তো একা, জান্নাত তার সঙ্গে থাকা না-থাকা সমান। আর তার বিপক্ষে হাড়ি-পাতিল-বালতি হাতে জনতা। সেই জনতাকে সামাল দেওয়া তার কাজ না। সামাল সে দেওয়ার চিন্তাও করে না। কিন্তু তার চাইতেও অনেক বড় বিপদ যে এই ডোবার ধারে আগুনের মধ্যে বা তৈলাক্ত পানির মধ্যে নিহিত ছিল সেটা সে না ভেবেছে নিজে, না কেউ তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। শূন্য ডোবা হয়তো পিটিয়ে হওয়া দুই/এক বৃষ্টিতেই পূর্ণ হয়ে যেতে পারে। সেটা কোন হতাশাব্যঞ্জক বিষয় নয়। কিন্তু যখন তার ঘরে থানার দারোগার নেতৃত্বে পুলিশ আসে, এসে তার ওপর নির্দেশ জারি করে তখন নতুন বউ জান্নাতের সৌভাগ্যসূচকতা সম্পর্কিত ভাবনার পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে। সেই ভাবনা করবার জন্যেও অবশ্য একটু সময় দরকার। আবুল খায়ের সেই সময়টুকুও পায় না।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-১)

সকালটা ছিল রোদের আঁচে ঝকমকে। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ডোবায় অনেকটাই জলের আমদানি ঘটেছে। যদিও সেই নবজলও কিছু তৈলাক্ত সম্ভাবনাযুক্ত। জলের উপরিভাগ ভারি-ভারি ঠেকে খায়েরের চোখে। চাল আনতে দোকানে যাওয়া দরকার। বউ রাতেই জানিয়েছে, চাল প্রায় শেষ। কেবল সব্জি-খিচুড়ি করলেই যেটুকু চাল আছে তা দিয়ে মিলিয়ে-মিশিয়ে একটা বেলা চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। আগের রাতে খায়েরের খিচুড়ি খাওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল আকাশে মেঘের আনাগোনায় কিন্তু আজ সেই মেঘ উধাও। বরং গতকাল যে-বেলে মাছ পাওয়া গেছে সেটাকে শুধু পেঁয়াজে একটু ঝালে-ঝোলে রাঁধতে পারলে অনায়াসে তিন প্লেট ভাত হজম করে ফেলা যায়। তাই ভেতরকার ভাত-সচেতনতাই খায়েরকে বাজার-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। বাজারেই সে যাচ্ছিল। কিন্তু দরজা মেলতেই দেখে বাইরে তারই আঙ্গিনায় দারোগার নেতৃত্বে চারজন পোশাকধারী পুলিশ এবং একজন লোক ক্যামেরা-হাতে দাঁড়িয়ে। আশ্চর্যেরও আশ্চর্য হয় খায়ের এবং তার স্ত্রী জান্নাত। মনের মধ্যে ভয় ঢুকে পড়ে দুজনেরই। পুলিশ মানেই ভয়ের ব্যাপার, তার সঙ্গে যদি থাকে দারোগা তাহলে সেটা রূপ নেয় আরও ভয় ও আতঙ্কে। ভেতরে ভয় পেলেও বাইরে একটা শান্ত-অকম্পিত আবহ বজায় রাখে খায়ের। পুলিশদের দু’তিনজন তার পরিচিতও।

:কী ভাই, আপনেরা, এইহানে? কী ব্যাপার? কোন সমস্যা?

একটা সমস্যার কথা চকিতে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল খায়েরের মনে। নিশ্চয়ই গ্যাসে রান্না করতে গিয়ে অথবা ডোবা থেকে জল সংগ্রহ করতে গিয়ে লোকেরা নিজেদের মধ্যে লিপ্ত হয়েছিল বিবাদে-বিসংবাদে। হতে পারে বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল নারীতে-নারীতে কিন্তু তার বিস্তৃতি ঘটেছিল পুরুষে-পুরুষে। দ্বীপে এমন ঘটনাও ঘটেছিল, পুকুরঘাটে বাসনকোসন মাজতে গিয়ে দুই নারীর মধ্যে বাদ-বিসংবাদের সূচনা এবং মাঠে কর্মরত দুই পুরুষের লাঠালাঠিতে তার সমাপ্তি। বিবদমান লোকেরা হয়তো খায়েরের বাড়ির আঙ্গিনায় বিবাদে লিপ্ত না হয়ে অন্য কোথাও ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেছে। কিন্তু উৎপত্তিস্থল যেহেতু তারই ঠিকানা তাই সেই ঠিকানা-মোতাবেক পুলিশ এসে হাজির। পুলিশেরা সচরাচর ঠিকানা ভুল করে না। পুলিশ হলো সেই বিবাদ-বিসংবাদের হাতেনাতে ফল। কিন্তু না, সেরকম কিছু ঘটে না। যা ঘটে তা তার চাইতেও গুরুতর।

আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-২)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-৩)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৪)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৫)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৬)

চলবে...

৮ম পর্ব পড়ুন আগামী শুক্রবার