মাটি ও মানুষের ক্ষমতায়নের পথে 'গেম চেঞ্জার' পদ্মা সেতু
‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপারকৃষি-বাংলার অধিকারের দাবিতে পদ্মার তীর থেকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন হাজী শরিয়তউল্লাহ। পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলো পরিবেষ্টিত দক্ষিণবঙ্গের প্রান্ত থেকে কৃষক-প্রজার সংগঠিত শক্তিতে ব্রিটিশ-বাংলার রাজনীতির মূল চালিকা শক্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। কলকাতার শাসনকেন্দ্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মাধ্যমে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন বাংলাকে 'অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশ' বানিয়ে বাঙালি জাতিকে শাসন ও শোষণ করছি, তখন পদ্মা-বিধৌত জনপদ থেকে গর্জে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
সহস্র বর্ষের বাংলা ও বাঙালির পলিমাটি অঙ্কিত কৃষি সংস্কৃতির রাজনৈতিক বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপহার দিয়েছেন মাটি ও মানুষের ক্ষমতায়নের পথে 'গেম চেঞ্জার' পদ্মা সেতু।
ঐতিহাসিক পদ্মা সেতু স্থাপনা হিসাবে বিশ্বের বিস্ময়। যোগাযোগ অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্মরণীয়। বিপণন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধিতে সহায়ক। কৃষি, শিল্পায়ন, উন্নয়ন, পর্যটন, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী গুরুত্বের অনুঘটক।
কিন্তু পদ্মা সেতুর সবচেয়ে তাৎপর্যবাহী অবদান রাজনৈতিক, যা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ক্ষমতায়নের পথে 'গেম চেঞ্জার'। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গতিপ্রবাহে পালন করবে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা। গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার রক্ষায় ঐক্যবোধে প্রাণিত করবে সমগ্র জাতিকে।
ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ-বাংলা ও পাকিস্তানি রাজনীতির যে দুষ্ট প্রেতাত্মা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুঃখজনকভাবে এখনও প্রবহমান, তার চির অবসান হবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সৃজিত মানুষের রাজনৈতিক সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের শক্তিতে। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ আর বাবু জমিদারদের কব্জায় ছিল রাজনীতি। পাকিস্তান আমলে ফৌজি আর এলিটরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবদমিত করেছিল জনতা ও তাদের রাজনৈতিক অধিকারকে। বাংলাদেশ আমলেও প্রায়শই সেই অপধারার প্রভাবে কতিপয় সাফারি পরিহিত এলিটচক্র রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে বসে বার বার পাশাখেলার ছকে জনতাকে বঞ্চিত করে নিয়ন্ত্রণ করেছে রাজনীতিকে।
ফলে দেশের মালিক-মোক্তার জনগণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে বাধ্য হয়েছে হত্যা, ক্যু, জবরদখলের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে লাঞ্ছিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের মচ্ছব। পলাশীর প্রান্তরের অসহায় দর্শকের মতো বাংলাদেশের জনগণ বার বার থেকেছে অশগ্রহণের অধিকারহীন এবং দেখেছে নিজেদের রাজনৈতিক ভাগ্য বিপর্যয়ের করুণ ধারা।
পদ্মা সেতু সেই বিচ্ছিন্নতা ও অংশগ্রহণহীনতার অধ্যায় প্রমত্তা নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে সম্পন্ন করবে জনতার প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। শিবচরের কৃষক, জাজিরার দোকানদার, টেকেরহাটের ব্যবসায়ী, আলফাডাঙ্গার নারীসমাজ, খেপুঁপাড়ার জেলে, বরগুনার কালামেঘের মাঝি, পাথরঘাটার প্রান্তিক মানুষ, সুন্দরবনের মাওয়ালি, চরফ্যাশনের সমুদ্রগামী সারেঙ অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দেবে ঢাকায় আবর্তিত রাজনীতি। রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিস্থিতিতে ও অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সরব, সোচ্চার ও সক্রিয় হবে বাংলাদেশের কেন্দ্র এবং প্রান্তে প্রান্তে বসবাসকারী বাঙালি।
গণতন্ত্রকে সজিব ও সচল রাখতে জনঅংশগ্রহণের যে আবশ্যিক পূর্বশর্ত রয়েছে, তা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সম্ভব হবে বহুলাংশে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রাণকেন্দ্র ঢাকা অরক্ষিত থেকে পরিণত হতে পারবে না ক্ষমতালোভী ও অবৈধ শক্তির শাঠ্য-যড়যন্ত্র ও ক্ষমতা দখলের চারণক্ষেত্রে। জাতীয় রাজনৈতিক সঙ্কটে সমগ্র বাংলাদেশ নিমেষে পরিণত হবে প্রতিবাদের পল্টনে। ঢাকা থেকে সর্বদক্ষিণের ছেঁড়াদ্বীপ পর্যন্ত সক্রিয় জনতার সম্মিলিত সমাবেশ উড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে যাবতীয় অপতৎপরতা।
মাটি ও মানুষের ক্ষমতায়নের পথে 'গেম চেঞ্জার' পদ্মা সেতু বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জাতিগঠনের চলমান ধারাকেও বেগবান করবে। জনতার রক্তাক্ত সংগ্রামে অর্জিত বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও ঐক্যের পথকেও করবে আরও মসৃণ এবং সুদৃঢ়।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।