দখিনের আনন্দ-দুয়ারে গর্বিত উত্তর-পূর্বের বানভাসী
‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে’ পদ্মার এপার-ওপারদখিনের আনন্দ-দুয়ার পদ্মা সেতু নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আংশিক জন-ভাবনার কথা মাথায় আসলো। আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ বর্তমানে জীবনের জন্যে প্রকৃতির সঙ্গে লড়ছে। প্রবল ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় আক্রান্ত। পাতে নেই ভাত, এমনকি পাতও নেই অনেকের, ঘর আছে তবে আশ্রয় নেই। বানের জল বের করে দিয়েছে অনেককেই। কারো ঘরে হাঁটুসমান পানি, কারো বা তারচেয়ে বেশি অথবা কম। আছে সাপ-জোঁকের ভয়, উনুন চড়ানোর জো নেই; হয় সেখানে পানি নয়তো ঘরে নেই যথেষ্ট উপকরণ। লড়াই টিকে থাকার, বেঁচে থাকার। এমন অবস্থায় থাকা মানুষের মনে পদ্মা সেতুর প্রভাব কতখানি সে আগ্রহ আমার। তার ওপর আছে এইসময়ে একদিকে যেমন বিশাল আয়োজন, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধিতা। এ বিরোধিতা অবশ্য সেতু নির্মাণ ভাবনা থেকে শুরু করে নির্মাণ কাজ সমাধার সকল স্তরে। কেবল কি বিরোধিতা? না, ওখানে ছিল নির্মাণে বাধার বিবিধ পরিকল্পনা, নীলনকশা!
বানভাসীদের ক’জনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী প্রতিক্রিয়া তাদের। স্বাভাবিক মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নৈরাশ্যবাদ ভর করেছে যাদের তাদের অনেকেই নিজেদের হাল নিয়ে উদ্বিগ্ন, করতলে মৃত্যু নিয়ে নিয়ে যারা বাঁচার স্বপ্ন দেখে তাদের চেহারায় খুশিভাব আছে, তারা আনন্দিত। পঞ্চাশোর্ধ মুহিত মিয়া বন্যায় ঘর ছাড়া। পাঁচজনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম। কৃষিনির্ভর, কোরবানি উপলক্ষে অন্যের সহায়তা কয়েকটি গরু কিনেছেন। বন্যায় গোয়ালে পানি উঠে গেছে, ঘরেও হাঁটুসমান পানি, পাশের একটি বাড়িতে গরুগুলো নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তার কথায়, ‘এভাবেই বাঁচা লাগে। একটার লাগি আরেকটা আটকি থাকে না (একটার জন্যে আরেকটা আটকে থাকে না)। পদ্মা সেতু অইছে হুনছি, আমরার পানির লাগি সেতু আটকি যাইবো কেনে (আমাদের বন্যার জন্যে সেতু আটকে যাবে কেন)?’ একই জায়গায় আশ্রিত আরেকজনের সঙ্গে কথা। তার জবাব—‘আমরার কিতা অইতো, পানি কোনদিন নামতো (আমাদের কী হবে, পানি কবে নামবে)?’ এলাকার একটা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত এক নারীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম, বললেন না কিছু। গ্রামে এমনই হয় আসলে!
উত্তর-পূর্বের ভাবনাগুলো জড়ো করতে চাইলাম। কয়েকজনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তায় মনে হলো মন্তব্য প্রকাশিত হয় মূলত প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের ধরনেই। প্রশ্নকর্তা যে ইঙ্গিতে প্রশ্ন করবেন উত্তর আসবে ও ইঙ্গিতেই। সাধারণের মধ্যে কথার মারপ্যাঁচ নেই। যেভাবে কথাগুলো কানে যায় সেভাবেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। পদ্মা সেতু নিয়ে এটা যেমন, তেমনি অন্য যেকোনো বিষয়েই। যখন আপনি তুলনা করতে যাবেন তখন কারো কারো আচমকা ব্যাখ্যাহীন কষ্ট ঝরবে। এটা ছোট্ট কোন বিষয় থেকে শুরু করে যেকোনো বড় বিষয়ের সকল পর্যায়েই। উদাহরণ মেলে এইসময়ে একই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত অনেকের মাঝে। খাবার কার পাতে বেশি পড়ল, কার পাতে কম—এসব নিয়েও মানুষ ভাবে, প্রতিক্রিয়া দেখায়। আর এটা যখন বন্যায় অসহায় হয়ে পড়া মানুষদের শোনানো হয় ‘তুমি বঞ্চিত’ তখন তারা হতাশ হয়, কষ্ট পায়। এটাকে ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং’ বললে কি অত্যুক্তি হয়? মনে হয় না!
এই ক’দিন অসহায় হয়ে পড়া মানুষদের ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিংয়ের’ চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের কানের কাছে বারবার বলা হচ্ছে—‘দেশ যখন বন্যায় আক্রান্ত তখন সরকার পদ্মা সেতু নিয়ে ব্যস্ত’। টেলিভিশনে এসে, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে একই কথা বারবার বলা হয়েছে, বলা হচ্ছে। একই কথাগুলোয় বানভাসীদের অনেকেই অপ্রাসঙ্গিক হলেও কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক তাদের। বিপদে পড়া মানুষেরা সবসময়ই নিজেদের বঞ্চিত ভাবে, বুকের গভীরে জমাট হয়ে পড়া হাহাকারগুলো চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চায়। ব্যক্তিগত কষ্টগুলোয় যেখানে আশাবাদের বাণী শুনিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টার কথা আমাদের তখন সেখানে তাদেরকে কষ্টে আগুন দেওয়ার চেষ্টা অনুচিত। যেখানে অভয় বাণী বাঁচার প্রেরণাদায়ী হয় সেখানে কেন উদ্দেশ্যমূলক হতাশার ঝাঁঝ? এটা কি অমানবিক নয়?
আমরা দেখেছি, পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়ার প্রতি ধাপে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরোধিতা। এই সেতু নিয়ে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যগুলো এখনও বিস্মৃত হয়নি দেশের মানুষ। ‘সরকার সেতু বানাতে পারবে না, জোড়াতালি দিয়ে সেতু বানালেও সে সেতুতে কেউ উঠবেন না’—এমনও বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। বিএনপির বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে থাকে আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা প্রায়ই কথা বলেন এসব নিয়ে, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন। এই অভিযোগগুলোর বিপরীতে বিএনপি কখনই নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেনি। তারা কেবলই সেতুর বিরোধিতা করে গেছে, আগেও করেছে, এখনও করছে। সেতু নির্মাণ কাজ সম্পন্নের পর উদ্বোধনের আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করেও গ্রহণ করেনি বলেও বক্তব্য দিয়েছে। সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যায়নি বিএনপির প্রতিনিধিদের কেউ।
বিরোধিতার এই অবাক ধারাবাহিকতা কেন? আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর মতো বড় স্থাপনা বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে করার সাফল্য দেখিয়েছে বলে; নাকি বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অভিযোগের সেই ‘ষড়যন্ত্র’ সফল হয়নি বলে? শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অর্থ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সাফল্যে যে পদ্মা সেতু তার কৃতিত্ব স্বাভাবিকভাবেই নেবে আওয়ামী লীগ। তবে শেষ পর্যন্ত এটা বাংলাদেশেরই সাফল্য। বাংলাদেশের এই সাফল্যে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। দেশে-দেশে পদ্মা সেতু যেখানে বাংলাদেশের অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সেখানে রাজনৈতিক বিরোধিতার নামে এই সংকীর্ণতা থেকে কেন বের হতে পারছে না বিএনপি?
ঘটনা-দুর্ঘটনা, হাসি-কান্না, দুর্যোগ-সুযোগসহ অনেক কিছুই আসবে-যাবে। এটাই মানুষের জীবন। অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয় মানুষকে। রাষ্ট্র সমষ্টি মানুষের। এক অঞ্চলের মানুষের দুর্যোগে অন্য অঞ্চল ভারাক্রান্ত হলেও থেমে থাকে না, থাকা সম্ভবও না। একদিকে সিলেট অঞ্চলে আমরা যখন বন্যায় ভাসছি অন্যদিকে দখিনে খুলেছে আনন্দ-দুয়ার। আজ (২৫ জুন ২০২২) আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতু-সংগ্রামী তিনি। কারণ কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু থেকে তাদের প্রতিশ্রুত সহায়তা ফিরিয়ে নিয়ে কলঙ্ক লেপ্টে দিতে চেয়েছিল, তখন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন পদ্মা সেতু করেই ছাড়ব, এবং সেটা নিজস্ব অর্থায়নে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন—‘আমরাও পারি’। শেখ হাসিনা পেরেছিলেন বলে বাংলাদেশ পেরেছে। পদ্মা সেতু যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘দুর্মর’ কবিতা; ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ ‘পূর্বাভাস গ্রন্থে সুকান্তের পূর্বাভাস—‘এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে/ সোনালী নয়কো, রক্তে রঙিন দান/ দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে/ দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।’
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বানভাসী হয়েও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে আমরা গর্বিত। আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন প্রধানমন্ত্রী!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।