কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবার মত বোরখার আড়াল থেকে কেবল ছদ্মবেশী পুরুষই নয়, বেরিয়ে আসে সব দাগি আসামি। পত্রিকায় বড়-বড় হেডলাইনে সংবাদ ছাপে। তিনটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া আসামিরাই সুবর্ণদ্বীপের ছদ্মবেশী নৌকারোহীর দল। এদিকে পত্রিকার সংবাদের জোর প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে টেলিফোনেও সাংবাদিকদের কড়া ভাষায় ধমক লাগাতে থাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষ। মনগড়া সংবাদ ছাপবার জন্যে তারা রূঢ় ভাষায় সমালোচনার তীর ছোঁড়ে সাংবাদিকদের লক্ষ করে। কেননা, তাদের দাবি, তাদের কারাগারে যেহেতু কয়েদিসংখ্যা পূর্ববৎ বহাল থাকে, সেহেতু সুবর্ণদ্বীপের মহিলাবেশী যাত্রীদের জেলপালানো আসামি হওয়া কেবল উন্মাদগ্রস্ত কল্পনার ফল হওয়াই সম্ভব। কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়েছিল সাপ, কিন্তু সেই সাপ যে অজগর এবং তার বৃহদন্ত্রে যে আস্ত দেহ নিহিত ছিল সেটাও অবশেষে জানা গেল।
আরও পড়ুন➥ দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-১)
সাংবাদিকেরা তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণ দিয়ে বললেন, যারা সুবর্ণদ্বীপে পাকড়াও হওয়া ছদ্মবেশী তারা বিভিন্ন শ্রেণির কয়েদি-ই। এদের মধ্যে খুনি, ডাকাত, মাদকাসক্ত অপরাধী, ধর্ষক, শিশুধর্ষক পরিচিত প্রায় সব ধরনের অপরাধীই রয়েছে যারা বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে কখনই ধরতে সক্ষম হয় নি। ফলত তারা সবসময়েই ছিল হাতকড়ামুক্ত অর্থাৎ তাদের থাকবার কথা ছিল জেলখানায় কিন্তু তারা বসবাস করছিল মুক্তাঞ্চলে। পুলিশও তা জানতো। ভেতরে-ভেতরে তাদের সঙ্গে পুলিশের একটা ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলতেই থাকে। কর্তৃপক্ষ যখন অধীর হয়ে তাড়া লাগায়, আসামি কই, তখন পুলিশ ঠিক-ঠিক ধরে আনে আসামিদের। তারাও হয়তো উপযুক্ত সময় এবং অনুকূল পরিস্থিতি পেলে আসামিই হয়ে উঠতো কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তখনও তারা আসামি নয়, তারা অপরাধ সংঘটন করে নি। দেখা গেল জেলখানায় যতজন কয়েদি থাকবার কথা ঠিক ততজনই থাকে কিন্তু সংখ্যা তো গুণবাচকতার উপস্থাপক না-ও হতে পারে। হয়তো কারা এবং ঊর্ধ্বতন দুই কর্তৃপক্ষেরই তা জানা ছিল। এখন পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলা হতে থাকলে সেই ঘোলা পানিতে বরাবরের মত মাছ-শিকারিদেরও দেখা যেতে থাকে। তারা নানা ধরনের ছিপ ফেলে মাছের তালাশ করতে থাকে। আবার, আরেকদল সাংবাদিক অন্য সম্ভাবনার সূত্র উত্থাপন করে। তাদের বক্তব্য, যারা সুবর্ণদ্বীপে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে তারা হয়তো কোন ধরনেরই অপরাধী নয়, তারা নিতান্ত ভাগ্যান্বেষণকারী। এদিকে, একটা মারাত্মক বিষয় এরই সমান্তরালে বেরিয়ে আসে, জেলখানার আসামি যদি তারা প্রকৃতই হয়ে থাকে তাহলে তারা জেল থেকে বেরোলো কী করে! নিশ্চয়ই একটা দুর্বৃত্ত চক্র পুরো ব্যাপারটার পরিকল্পনাকারী। তাদেরই চক্রান্তে এরা জেলখানা থেকে পালিয়েছে এবং তাদেরই চক্রান্তে তারা জেল পালালেও জেলখানায় তাদের অনুপস্থিতির পরিসংখ্যান থাকে উহ্য, মানে অন্য লোকেরা পূরণ করে সেই শূন্যতাকে। সারকথা যা দাঁড়ায়, একটা বড় কুচক্রী-মহল মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সাগর থেকে জেগে ওঠা দ্বীপ সুবর্ণদ্বীপে জেলখানা থেকে লোকেদের চোরাচালান করে পাঠিয়ে দিচ্ছে স্থায়ীভাবে বাকি জীবন বসবাসের জন্যে। বাকি জীবন কথাটা এ-কারণেই, তাদের তো কারাভ্যন্তরের অন্ধকারেই থাকবার কথা। সেখানে তারা কাটাবে মুক্ত আলোবায়ুতে। তাদের দিক থেকেই হিসেবটা স্পষ্ট- জেলখানার অন্ধকারে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুটিয়ে কু-লি পাকিয়ে মরবার পরিবর্তে দূরের এই আলোবাতাসের দ্বীপাঞ্চলে থাকাটাও অনেক বেশি জীবনানন্দের। এরকম পক্ষে-বিপক্ষে বাকবিতণ্ডা চলতেই থাকে। সকলেই দৃঢ়কণ্ঠ। সকলের কাছেই নাকি রয়েছে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ। কিন্তু কে দেখবে, কাকে দেখাবে, কে কাকে দেখাবে, কে কার কাছ থেকে দেখতে চাইবে- এইসব জল্পনা-কল্পনা নিয়ে স্থানে-স্থানে জটলা পাকায় লোকেরা। তারা হুমড়ি খেয়ে পত্রিকার পাতা ওল্টায়। সবটা খবর পড়ে মনোযোগ দিয়ে। তারপর পরের দিনের পত্রিকার জন্যে অপেক্ষা করে। সে-পত্রিকা এলে সেটা অভিনিবেশ সহকারে সবটা পড়ে ফেলে। পড়ে তার পরের দিনের পত্রিকার জন্যে অপেক্ষা করে। সেটাও গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ে অক্ষরে-অক্ষরে। পড়ে অপেক্ষা করে পরের দিনের পত্রিকার জন্যে। এভাবে পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলে, সবাই সংবাদ পাঠ করতে থাকে এবং অপেক্ষা করতে থাকে। যারা অন্ধকারে দ্বীপে অবতরণ করতে গিয়ে ধরা পড়লো তাদের কথা তারপর আর কারও ভাবনাতেই থাকলো না। তারা কারা, কেন তাদের এমন পরিণতি, কোন্ কুচক্রের তারা শিকার এসব নিয়ে কেউ উৎসাহও প্রকাশ করে না। যে-লোকগুলো বোরখার আড়ালে নারী সেজেছিল তারা নারী নয়, নারী নয় বলে তারা কারও মা-বোন নয়, কিন্তু তারা তো কারও না কারও ভাই বা বাবা বা সন্তান। কারাগারে কয়েদির সংখ্যা ঠিক থাকলেও একথা তো অস্বীকার করবার কোন উপায় থাকে না, যে-মুহূর্তে লোকগুলো সুবর্ণদ্বীপে পা রাখলো ঠিক তখনই কোন না কোন ঘরে মানে সংসারে-পরিবারে সদস্যসংখ্যায় টান পড়েছিল। তারা নিশ্চয়ই জানে, তাদের সন্তানেরাই অন্ধকার থেকে চলে গেছে আরও অন্ধকারে। কিন্ত কোন সাংবাদিক কিংবা কোন কর্তৃপক্ষ তখনও সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে পারে নি।
নাম-পরিচয়হীন লোকেরাও কেবল কর্মগুণে নিজেদের সংকীর্ণ সীমাকে ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বৃহত্তর অঙ্গণে। আন্তর্জাতিক ‘ফ্রিকনমিস্ট’ পত্রিকার কল্যাণে এরিমধ্যে সুবর্ণদ্বীপের খ্যাতি দেশের সীমানা পেরিয়ে পাড়ি দিয়েছে বিদেশ। দু’জন বিদেশির অবস্থিতি সেই খ্যাতির মুকুটে নক্ষত্রের মত দু’টি পালক। ছদ্মবেশীদের ধরা পড়বার অল্প কিছুদিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষ এবং গণমাধ্যমের হাল্কা বিতর্কের পরে যখন শুনশান না হলেও এক ধরনের নিরবতার সঞ্চার ঘটে তখনই ফের সুবর্ণদ্বীপের মাত্র একজন ব্যক্তি ব্যক্তি থেকে পরিণত হলো ব্যক্তিত্বে। যেটা অকল্পনীয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন স্থানীয় ব্যক্তি সবকিছুকে ছাপিয়ে রশ্মিপাত করতে আরম্ভ করলো। অথচ যার মধ্যে বস্তুত আলোকের চেয়ে অন্ধকারের ভাগই অধিক। আলিম বক্স ছিল একসময়কার জেলপালানো আসামি। দেশের অন্ধকার সাম্রারাজ্যের রাজধানীর সে ছিল এক উল্লেখযোগ্য অধীশ্বর। আবার, রাজধানির বিখ্যাত পতিতাপল্লী ছিল তার করতলগত। তবে, বাতির নিচে অন্ধকারের বাস্তবতার মত তার সাম্রারাজ্যেই তার পতনের বীজ রোপিত হয়। রাজধানির সেই বিখ্যাত পতিতাপল্লীর সবচাইতে সুন্দরী নারীটি ছিল তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কিন্তু সেই নারী অন্য এক নায়কোপম যুবকের প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ রচনা করে। মধ্যপ্রাচ্যফেরত সেই যুবকের সংবাদ জেনে ক্রুদ্ধ আলিম ভয়ংকর নির্যাতনের ছাপ তার শরীরে প্রায় স্থায়ীভাবে এঁকে দেয়। তারপরের ঘটনা আরও নাটকীয় মোড়ে যাত্রা করে। মধ্যপ্রাচ্য-ফেরত যুবকটি যে এইচআইভি পজিটিভ মানে এইড্স্ রোগের বাহক ছিল তা জানা ছিল না পল্লীসুন্দরীর। পরে, অসুস্থতার বশে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সে জানতে পারে, একই সংক্রমণের শিকার সে-ও। তা জেনেও কেবল অর্থের প্রয়োজনে সে তা গোপন করে যায়। এমনকি মাঝে-মাঝে সে আলিম বক্সের সংসর্গও অব্যাহত রাখে। সেটা সে করে প্রতিশোধের বশে। আলিম বক্সের নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতেই সে এমন কাজ করে।
আরও পড়ুন➥ দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-২)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-৩)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৪)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৫)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৬)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৭)