দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান

  • মহীবুল আজিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

এমন ভাবনাতে হয়তো বিরক্তি প্রকাশ করা যায়। নিজেদের সম্পদ বিষয়ে এমন ঔদাস্য অনুচিত বলে বিবেচনা করা যায়, যেখানে দেশ-বিদেশের এত-এত শিক্ষিত মানুষ তাদের এলাকার মত এমন একটা সাদামাঠা জায়গা নিয়ে এতটাই ভাবান্বিত। তবে সুবর্ণদ্বীপের লোকেরা ‘ফ্রিকনমিস্ট’-পত্রিকার প্রতিবেদনের কিছুদিনের মধ্যেই অনুভব করলো, দ্বীপটার মধ্যে কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই নইলে এখানে এসে হেলিকপ্টার দাঁড়ায় কেন। কী যে শব্দ সেই হেলিকপ্টারের, আর কী তার অস্তিত্বের ঘোষণা! শোনা যায়, হেলিকপ্টারে করে রাজধানির এবং বিদেশের দামি-দামি লোকেরা আসে। তারপর হেলিকপ্টার চলে গেলে আসে আরেক উত্তেজনা। এতদিন বিদেশি বলতে দ্বীপে ছিল কেবল ডাক্তার লুইগি। এখন এলো আরেকজন, সামনে আরো আসবার সম্ভাবনা প্রবল। যিনি এসেছেন তাঁর নাম ভেলাম ভ্যান সান্দেল- পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ বাঁধ-বিশেষজ্ঞ। নিরাময়ের কাছাকাছি একটা দোতলা ভবন ভেলামের দপ্তর। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, তেল-গ্যাসের সঙ্গে বাঁধের আবার কী সম্পর্ক! অনেকেরই সেটা মনে হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু সরকারকে তারা এই মর্মে বোঝাতে সক্ষম হলো, দ্বীপই যদি না থাকে, সেটির অস্তিত্ব যদি হারিয়ে যায় তাহলে তেল-গ্যাসের মজুদ থেকেই বা কী হবে! যে-দ্বীপ সমুদ্রতল থেকে মাথা তোলে সে-দ্বীপ আবার যদি মাথা ডুবিয়ে নেয় তাহলে তেল-গ্যাস সম্পর্কিত সমস্ত উদ্যোগ-উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত প্রহসনে রূপ নেবে। কাজেই আন্তর্জাতিক মহলের একটা গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগের বিষয় সুবর্ণদ্বীপ-সুরক্ষা। ভেলাম ভ্যান সান্দেল এবং তার দেশীয় সহযোগীরা প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে গবেষণা চালিয়ে দেখবেন দ্বীপকে ঘিরে কীভাবে বাঁধ নির্মাণ করলে তা দ্বীপকে সমস্ত রকমের প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা থেকে রক্ষা করবে। সেই সুরক্ষার কাজটি করা হলে পরে যত খুশি উত্তোলন করতে থাকো তেল আর গ্যাস।

এখানে লক্ষ্য করবার মত আরেকটি পরিবর্তন ঘটে যেটি দ্বীপবাসীদের স্বভাব ও মানসিকতা প্রসঙ্গে সাম্প্রতিকতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হলো অনেকের নিকটে। অবশ্য এর সঙ্গে সরকারি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির কথাও কেউ-কেউ বলে থাকে। এমনিতে দ্বীপের চারদিকই খোলা। যে-কোন দিক থেকেই ভাসতে-ভাসতে এসে দ্বীপে ঢুকে পড়া যেতো। ধরো নলছিটি, ঝালকাঠি, স্বরূপকাঠি, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, মনপুরা, রামগতি, চর আলেকজান্ডার এসব জায়গা থেকেই এসে সুবর্ণদ্বীপে বসতি গাড়ে লোকেরা। তারাই এখানকার আদি বাসিন্দা। লোকেরা আসতো থাকতো দ্বীপের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করতো। তাদের অনেকেই আবার কিছুদিন থেকে চলেও যেতো। কিন্তু তেল-গ্যাসের সংবাদটার ফলাও-প্রচারণার পর-পর দ্বীপাভিমুখি আগমন অকস্মাৎ বাড়তে থাকে। এটা হতে পারে সমাপতন বা আকস্মিকতা। দ্বীপে প্রবেশের পরিচিত প্রায় সবগুলো ঘাটে বিশেষ চৌকি বসানো হয়। এর বাইরেও থাকে নানান চোরাগোপ্তা প্রবেশ-পথ। কোন-কোন পথ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আগে সেসব পথে তত ব্যস্ততা দেখা যায় নি কিন্তু সম্প্রতি সেখানে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে তৎপরতা। রাতের অন্ধকারে হয়তো দ্রুতগতি স্পিডবোট নানা চরিত্রের ঢেউ ডিঙ্গিয়ে যাত্রী এনে উগরে দিয়ে গেল দ্বীপে। গায়ে জল মেখে কাদা মেখে কি আধাআধি স্নাত হয়েও লোকেরা দ্বীপে পা ফেলে। এরকমই একটি অদ্ভুত পাকড়াওয়ের ঘটনা প্রশাসনকে বিশেষভাবে চিন্তায় ফেলে দেয়।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-১)

মধ্যরাতের পর-পর নতুন-বাজারের কাছাকাছি একটি প্রবেশ-পথে এসে থামে একটা সাম্পান। নিয়মমত এগিয়ে যায় চৌকির লোক। সচরাচর মহিলা-যাত্রী হলে চৌকিদাররা তত ঘাটায় না। এক-আধটু প্রশ্ন করে ছেড়ে দেয়। যেমন, কোন্ জায়গা থেকে আসা হলো, কী জন্যে আসা, এসে কী লাভ বরং রাজধানিতে যেতে পারো না- এমন সব প্রশ্ন। আরও একটি গুরুতর ঝুঁকির দিক বিবেচনায় রেখেই এমন চৌকিদারি ব্যবস্থা। অনেক সময় বিভিন্ন জেলা থেকে চোর-ডাকাত-খুনি-আসামিরা গা-ঢাকা দেবার জন্যে এসে ঢোকে সুবর্ণদ্বীপে। আপনি হয়তো পশ্চিমপাড়ার একটি ছাপড়া-মত চায়ের দোকানে চা খেতে বসলেন আর আপনার সামনে মার্ক্স গুঁড়ো-দুধে চা বানিয়ে নিয়ে এলো একটা লোক যে চারদিন আগেই একটা শিশুকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে। কেবল তা-ই নয়, ধর্ষণের পরে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে শিশুটিকে হত্যাও করেছে। সে আপনার সামনে চায়ের কাপটা রাখলে আপনি তাকে দেখে ভাবলেন আহা বেচারা চিরদুখি লোকটা! কিন্তু আপনার তো জানার কথা নয়, লোকটা একটা ভয়ংকর খুনি যে খুন করেছে এবং যে সুযোগ পেলে আবারও করতে পারে খুন। এত ভয়ানক কা- করেও সে কী সফলভাবেই না নিজেকে আপনার সামনে গোবেচারা প্রমাণ করতে সক্ষম হলো। আসতে পারে সুবর্ণদ্বীপে জেলপালানো কয়েদি। কিস্সু না, এসেই সে সারা গালে এমন দাড়ি গজিয়ে তুলবে, দেখে আপনার রীতিমত শ্রদ্ধা জেগে উঠবে অন্তরে। আবার, শ্মশ্রƒময় একটা লোক এসে সারা গালের দাড়ি ফেলে দিয়ে এমন মসৃণ গাল করে তুলবে দেখে আপনার মনে জেগে উঠবে মমত্বের বোধ। এইসব ঝুঁকির কারণে সুবর্ণদ্বীপের ওপর প্রশাসনকে রাখতে হয় বাড়তি নজর।

বিজ্ঞাপন

মধ্যরাতের পরে একটি সাম্পান এসে ভিড়লে জনাবিশেক বোরখাবৃতা যাত্রী নেমে আসে সাম্পান থেকে। একে রাত তার ওপর মহিলা যাত্রী এই দুই ঝুঁকি চৌকিদারদের বেশ বিপাকে ঠেলে দেয়। নৌকা থেকে নেমেই তাদের স্ব-স্ব শারীরিক সক্ষমতার প্রমাণ রেখে লাফ দিতে হয় তীরে। তারা কাদাতেই পড়ে, ফের উঠে দাঁড়ায়, কেউ আবার পড়ে এবং আবারও উঠে দাঁড়ায়। পড়ে প্রায় সকলেই, বস্তুত পড়াটাই তাদের পরবর্তী না-পড়ার উপক্রমণিকা। চৌকিদাররা যথাসম্ভব সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে মধ্যরাত্রির অনারামকে সহনীয় করে তুলতে চায় দ্বীপে নবাগত যাত্রীদের জন্যে। লাফের চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে অকস্মাৎ এক অবগুণ্ঠিতা, সেটাই তার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ছিল, কাদায় চিৎ হয়ে পড়লে খুবই বেকায়দায় তার বোরখা এবং ভেতরের চেক-নকশাঅলা কাপড় দু’টোই চরাৎ শব্দে ফেঁড়ে গেলে চৌকিদার, যাত্রীসকল সবাই প্রমাদ গুণতে থাকে। বোরখার সম্মুখভাগে দুই পায়ের মাঝখানে বেশ খানিকটা অংশ ছিঁড়ে যায় এবং সেই বরাবর তার অন্তর্বস্ত্রও ছিন্ন হয়ে গেলে আশেপাশের সকলেই বোরখাবৃত যাত্রীর লুঙ্গির কাপড়টি দেখতে পায়। মুহূর্তের জন্যে তারা একটু অপ্রস্তুতই হয়ে যায় এবং ভাবে, তাহলে মেয়েমানুষেরাও ছেলেদের মত লুঙ্গির কাপড়ের শাড়ি পরে। কিন্তু ঘটনা এমন দ্রুত নাটকীয়তার কবলে পড়ে পুরো ব্যাপারটাকে ঘোরালো আর জটিল করে তুলবে তা সেই মধ্যরাতের কোন দ্বীপবাসীরই ভাবনায় ছিল না। বোরখাবৃত যাত্রীর সহায়তায় আগুয়ান একজন চৌকিদার তার হাতের লাঠিটি যথাসম্ভব সামলে নিয়ে পতিত লোকটিকে মাটি থেকে তুলে ধরবার বাসনায় যেইমাত্র তার নিকটে পৌঁছায়, অমনি বাইরের বোরখা এবং ভেতরের অন্তর্বস্ত্র সবটা ছিঁড়ে যে-উদ্ঘাটনের বা উন্মোচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেই অবকাশ-পথেই বোরখা এবং বস্ত্রের সম্মিলিত আড়াল ভেদ করে বেরিয়ে পড়ে একটি শিশ্ন, আর এ তো বলাই অতিকথন, শিশ্ন বোরখাবৃতাদের হওয়ার কথা নয়। কী ভয়ংকর কাণ্ড চৌকিদারেরা ভাবে, বোরখার আড়াল থেকে শিশ্ন মেলে কী করে! তাহলে নৌকাগত যাত্রীরা সকলেই নারীর আড়ালে পুরুষ! মনে হওয়ামাত্রই চৌকিদারেরা চোর-চোর ডাকাত-ডাকাত চিৎকারে চরাচর কাঁপিয়ে দিতে শুরু করলে মার-মার-ধর এমন শোরগোল ধেয়ে আসতে থাকে চতুর্দিক থেকে। বোরখাবৃতারা হতচকিত হয়ে পড়ে। দ্বীপে তারা নবাগত বিধায় তাদের পক্ষে শীঘ্র অন্ধকারভেদী অভিমুখের সন্ধান কষ্টকর হয়। ফলে তারা যতটা সম্ভব মহিলা-প্রতিভায় দাঁড়িয়েই থাকে। কিন্তু চৌকিদারেরা ততক্ষণে জনাবিশেক যাত্রীর প্রায় সবাইকে ঘেরাও করেছে। নিকটের কয়েকজন পুলিশও ছুটে এসে তাদের হাতকে শক্তিশালী করে। উপস্থিত তদন্তের ফলে দেখা গেল, বিশটি বোরখার আড়ালে বিশজন পুরুষ। তারা নারীর ছদ্মবেশে দ্বীপে অনুপ্রবেশ করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের গন্তব্য হয় জেলখানা। দ্বীপটি ছোট হলেও সেটির জেলখানা খুব ছোট নয়।

আরও পড়ুন➥ দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-২)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-৩)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৪)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৫)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৬)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৭)

দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৮)