নারী মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প
বিজয়ের ৫০ বছর![ছবি: বার্তা২৪.কম](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2021/Dec/16/1639653179717.jpg)
ছবি: বার্তা২৪.কম
দেশ স্বাধীনের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া, চিকিৎসক ও সেবিকা হিসেবে কাজ করা ছাড়াও অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন নারীরা। কুষ্টিয়ার এমন নারী দুই বোনকে নিয়ে বার্তা২৪.কমের বিশেষ আয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ। সেবিকা হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া আপন দুই বোন লুলু ই ফেরদৌস ও লুলু ই জান্নাত। তাদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরী করেছেন বার্তা২৪.কমের ষ্টাফ করেসপন্ডেন্ট, এসএম জামাল।
লুলু ই জান্নাত বলেন, আমার বয়স যখন ১৫ বছর ছিল। আমি তখন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তাম। ভর্তি হওয়ার পর কিছুদিন পরে উত্তাল মার্চ ৭ মার্চের ভাষন শুনে আমরা শিহরিত হলাম।
![](https://imaginary.barta24.com/resize?width=700&quality=75&path=uploads/news/2021/Dec/16/1639652842753.jpg)
কিন্তু বাবা সরকারি চাকরি করতেন বলে আমাদের হাতে পতাকা বা ব্যানার হাতে করে রাস্তায় রাস্তায় স্বাধীন দেশ চাই, আইয়ুব খান হোটে যাও এমন স্লোগান দিয়ে রাস্তায় যাওয়াটা তেমন পচ্ছন্দ করতেন না। আমার বাবা এসব দৃষ্টিকটু মনে করতেন ।
আমার বাবা বলেন আমি সরকারি চাকরি করি কিন্তু এসবের কারণে যদি চাকরিটা চলে যায় তাহলে তো বিপদে পড়ে যাবো। যদি বা আমি এবং আমার বড় আপা উদ্বুদ্ধ হয়ে কিন্তু এগুলো করতাম। আপা (লুলু ই ফেরদৌস) আমাকে বারবার বলছিলো এগুলো আমাদের অবশ্যই করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে। স্বাধীন দেশ চাই। এজন্য যা যা করণীয় আমরা করবো ইনশাআল্লাহ।
৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সারা দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। কৃষক শ্রমিক মজুর শিক্ষক-ছাত্র আপামর জনতা সবাই যেন এক কাতারে এসেছিল। আমাদের তারুণ্যদীপ্ত যে বয়সটা ছিল ১৫-১৬ বছরের তরুণী উদ্দীপ্ত সে সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আমরা সত্যিই উদ্দীপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু তবে আমাদের এই বয়সে আব্বা আমাদের কমফর্টেবল করতেছিল না ।এরপরে ২৬ শে মার্চ কালরাত্রি আঁধার নেমে আসলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের তাণ্ডবের যখন আমরা শহরের মধ্যে আর থাকতে পারছিলাম না। সে সময় আমাদের লাহিনীপাড়া গ্রামে দাদার বাড়ীতে আমাদের সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার আব্বা। তখন আমরা শহরের কোর্টপাড়ায় ছিলাম।
কিন্তু লাহিনীপাড়া গ্রামে দাদাবাড়ীর দিকেও পাকসেনারা সেই চলে গেল। তখন কিন্তু আব্বা বললো এখানেও তো থাকা নিরাপদ মনে করছি না। তখন আমার আব্বার এক আত্মীয় থাকতেন দৌলতপুরের বিলবোয়ালিয়া এলাকায়। তখন আমাদের নিয়ে আব্বা সেখানে গেলে আমাদের দেখভাল করার কয়দিন পর আমাদের শিকারপুর বর্ডার দিয়ে পার করেছিলেন তারা।
আব্বা ইনভাইটেড বেঙ্গল সরকারি চাকরি করতেন। আর চাকরি করার কারণে কলকাতার অনেক এলাকার চেনাজানা ছিলেন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়ই আমরা নার্সিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে কৃষ্ণনগরেরএকটি হাসপাতালে শরণার্থী ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া শুরু করি আমরা দুই বোন মিলে।
যুদ্ধকালীন সময়ে আহত মুক্তিযোদ্ধা এমনকি ডায়রিয়া কলেরা রোগের সংখ্যা বেড়ে গেল তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ডাক্তার নার্স চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সেসময় চিকিৎসক ছিল তারা স্বাস্থ্যখাতে সঠিকভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে না পারায় অন্যদেরও এগিয়ে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন।
তখন আব্বা আমাদের বললেন যে আমাদের তো কোন ছেলে নাই। তোমরা দুজন প্রাথমিক চিকিৎসা কাজে এগিয়ে আসো। দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করো ।
তখন আর কি করার আমাদের যেই সেবা স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক কাজগুলো আমরা করতাম। কুষ্টিয়ার ডাক্তার কোরাইশী, ডাক্তার আলী আহসান, সহ নাম না জানা অনেক ডাক্তাররা । এছাড়াও সেখানে চিকিৎসাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ডাক্তার সাদ মোহাম্মদ ছিলেন, চট্টগ্রামের প্রদীপ কুমার সাহা সহ অনেকেই ছিলেন।
ডাক্তাররা যখন রোগী সামলাতে পারছিল না তখন আলাদা আমাদের জন্য ট্রেন্ড করে দেওয়া হলো। সেখানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত কলেরায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতাম।
সে সময়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ রোগী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের নিজের চোখে দেখা লাশ ধরে ধরে একটার পর একটা করে ট্রাকের উপর ফেলছিল।কারণ লাশ সৎকারের ব্যবস্থা সেসময় উন্নত ছিল না।
লুলু ই ফেরদৌস বলেন, ‘খোলা মাঠে তাবুতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন। একদিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন। তার অবস্থা বেশ গুরুতর ছিল। মাথা দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সেসময় তাড়াহুড়া করে সুচ আমার হাতের মধ্যে ঢুকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে আমি আমার হাতের দিকে না তাকিতেতাকে বাচানোর চেষ্টা করেও বাচাতে পারিনি। আমার হাতের ওপরই মারা যান সেই যোদ্ধা। এভাবেই অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছি। খাবার দিয়েছি। তাঁদের কষ্ট দেখলে মুখে ভাত তুলতে পারতাম না। সুস্থ হয়ে অনেকেই যুদ্ধে চলে যেতেন।’
ডিসেম্বরে দুই বোন খবর পান, দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেদিন আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন তারা। ভারতীয়দের মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পরিবারসহ কুষ্টিয়ায় ফিরে আসেন তারা। আসার সময় ভারত সরকার তাঁদের কাজের স্বীকৃতিপত্র দেয়।
আমরা আজ আছি আগামীতে থাকবো না । আমাদের যে প্রজন্ম থাকবে তারা আমাদের দেশাটাকে কিভাবে রাখবে। সেজন্য এ সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের যেভাবে আমাদের ভালো রেখেছে আমাদের সন্তানদেরও যেন সেভাবে স্বযত্নে রাখে।