স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করা বাংলাদেশ আজকে ঋণদাতা দেশ। বিশ্বে ৪১তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে অবস্থান করছে। গত ৫০ বছরে অর্থনীতির আকার বেড়েছে ৬০০ গুণ। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
ভৌত অবকাঠামো নির্মাণেও এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। নিজেদের অর্থায়নে তৈরি করছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। মাতারবাড়ি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের মতো মেগা প্রকল্প। মহাকাশে জানান দিয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।
মেগা প্রকল্পের বাইরেও ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইপিজেড) নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এতে রফতানি বাড়বে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একইসঙ্গে এই ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশের এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
এই সময়ের মধ্যে শোষণ, বঞ্চনা, নানাবিধ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করা পাকিস্তানকে প্রায় সব সূচকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। আজ তাদের সংসদে বাংলাদেশের উন্নয়নের উদাহরণ টানা হয়। তারাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে। কিছু কিছু সূচকে ভারতকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিবেচনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ মার্কিন ডলার, যা ভারতের চেয়ে বেশি।
সামাজিক বিভিন্ন সূচকে গত দশ বছরে ভারতকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ। শিক্ষার হার কিংবা গড় আয়ুর দিক থেকে পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর, ভারতে ৬৯.৪ এবং পাকিস্তানে ৬৭.১ বছর। যদিও শিক্ষার হারের দিক থেকে ভারত থেকে আমরা সামান্য একটু পিছিয়ে আছি। ভারতের ৭৪.৪ শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ৭৩.৯ শতাংশ যেখানে পাকিস্তানে শিক্ষার হার মাত্র ৫৯.১৩ শতাংশ। শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে এদেশে।
স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উঠে আসার ক্ষেত্রে মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের অন্তত দুটি পূরণ করতে হয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে সব সূচক পূরণ করে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছে। সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণে জাতিসংঘে সুপারিশ করা হয়েছে বলে একনেক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০২০ অনুসারে, বাংলাদেশ তার সামগ্রিক লিঙ্গ ব্যবধান ৭৩% দূর করেছে। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)।
তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। করোনার কারণে একধাপ পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০–২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ৬৭ লাখ (৩১.৪৫ বিলিয়ন) ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি করেছে, যা বিশ্বের মোট পোশাক রফতানির প্রায় ৭ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে রফতানি বেড়েছিল ১৫ শতাংশের মতো।
আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছেন বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮ শতাংশই আসছে পোশাক খাত থেকে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন ধান উৎপন্ন হয়, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। প্রবাসী আয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ভারত আছে প্রথম স্থানে। এ ক্ষেত্রে চীন আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ।
ওষুধ রফতানিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম। জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো প্রকাশিত বিজ্ঞান প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ওষুধ রফতানিকারক দেশ। বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ ১৫০টি দেশে রফতানি হচ্ছে। এ খাতের বাৎসরিক বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকায়।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ, যা শতকরা হারে বিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ। এর বদৌলতে বাংলাদেশ এ খাতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যায় প্রথম হলো ভারত। ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টন, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ। তবে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।