আমি বিজয় দেখছি
বিজয়ের ৫০ বছরএক আশ্চর্য মাস ডিসেম্বর। এবার বিজয়ের রজত জয়ন্তী বলেই যে ডিসেম্বর সুন্দর, তা নয়। বাংলাদেশের চেয়ে বয়সে ছোট হলেও, তার হাত ধরে বড় হতে হতে দেখেছি- ফেব্রুয়ারি, মার্চ, ডিসেম্বর কতো রূপময়। স্বৈরাচার যখন দেশকে খামচে রেখেছিল, তখনও এই লাবণ্য কমেনি। বরং আরো উচ্ছ্বল ছিল বাংলাদেশ। ডিসেম্বরের রূপ বেশি কেন? উত্তরসরল, সহজ। ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাইলফলকে পৌঁছে দিয়েছে। সার্বভৌম বাংলাদেশতো একবেলাতে চলে আসেনি। স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতা আছে। একের পর এক বাঁধ ডিঙিয়ে বাংলাদেশ বিজয়ের মাইলফলকে পৌঁছতে পেরেছিল। কিন্তু একাত্তরের ডিসেম্বরেই বিজয় পূর্ণতা পায়নি। বরং ষোল ডিসেম্বর বিজয়ের আরো কিছু পথরেখা সামনে চলে আসে বাংলাদেশের। সেই গন্তব্যে যাত্রা শুরুর সময়ও ডিসেম্বর।
বিজয়ের স্বাদ নেওয়ার সময় থেকেই জানি, ঘরে আমাদের বিভীষণ রয়ে গেছে। তারা আমাদের মুক্তির স্বাদ নিতে প্রতি পায়ে পায়ে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। লড়াই চলছে এখনও তাদের সঙ্গে। সেই লড়াই রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে দিয়েছিল শুরু থেকেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে রাজনীতি বারবার চ্যুত হওয়ায় বিভাজন বেড়েছে। কোন কোন শত্রু প্রকাশ্য, তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু যারা আছেন উদযাপন, উৎসব, মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে মিশে তাদের ৫০ বছরে আলাদা করা যায়নি। বরং তারা বারবার মিশে গেছে, হারিয়ে গেছে, ভেসে আছে জোয়ারে। শুদ্ধ, শুভ রাজনীতি এবং অথনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে তারাই এখন সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিকে বিতর্কিত করে তুলতে তারা সক্রিয়। বিজয়ের ৫০ এসে দেখছি মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় নিয়ে তাদের বাচলতা ও মুখরতা। যা দেখে লজ্জা, ক্ষোভে আলোর পথের মূল যাত্রীরা সরে আছেন, আড়ালে আছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে বিজয়ের মূল স্বাদ পেতে হলে আলোর পথের মূল যাত্রীদেরকেই বিজয় যাত্রার অগ্রভাগে থাকতে হবে।
শহর গ্রাম ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসে এবারেও মুগ্ধ আমি। দেখছি শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, জেলা শহর, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রামের আইল ধরে যাচ্ছে পতাকা। মাত্র ফসল তুলে নিয়েছে কৃষক। কোথাও কোথাও এখনও মাঠে এখনও কাটা ধান পড়ে আছে। শীতের সবজিও আছে মাঠে। তার মাঝ দিয়েই চলে যাচ্ছে পতাকার ফেরিওয়ালা। আসলে তিনি হয়তো রুজির জন্য পতাকা ফেরি করছেন, কিন্তু বাঙালি, এই জনপদের সকল মানুষইতো লাল সবুজের ফেরিওয়ালা। সবাই যারযার অবস্থান থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বা দূতের কাজটি করছি। আসলে করছি বলার চেয়ে করার কথা, বলা ভালো। আসলে আমরা এই প্রতিনিধিত্বের কাজটি করার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার কাজটিই করছি বেশি। বৃহত্তর স্বার্থ রূপ পেয়েছে গোষ্ঠী ও ব্যাক্তি স্বার্থে। ফলে দুর্নীতি, সম্পদ পাচারের মতো অনৈতিক কাজের সঙ্গে এই ৫০ বছরে আমাদের আত্মীয়তা দৃঢ় হয়েছে। এই আত্মীয়তা কোনভাবেই বিজয় উদযাপনের আনন্দে পূর্ণতা দিতে পারে না।
তবে পূর্ণতা আসবে। স্বাদু হবে বিজয়। এই দৃঢ় বিশ্বাস আমার আছে। যার বীজ বপন করেছে তারুণ্য। তরুণদের নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই আমাদের। তারা আলসে, দেশ প্রেম কম, মাদক- ইন্টারনেট আসক্তিতে ডুবে আছে, স্বার্থপর, স্বপ্নহীন-এই যে অভিযোগ গুলো এর দায় কিন্তু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের। আমাদের অভিভাবকত্বের ত্রুটিই ওদের হতাশায় ডুবিয়েছে। দিকভ্রান্ত করেছে। ওদের সামনে থেকে আমরাই লক্ষ্য, স্বপ্ন ও বিজয়ের মাইলফলক সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তরুণদের কাছে এই চাতুরী করতে গিয়ে হেরে গেছি আমরা। ওরা ঠিকই চিনে নিয়েছে বিজয়ের পথ। চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওদের সাফল্যের উচ্ছ্বাস। এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওদের গতি, দুরন্তপনা দেখে মুগ্ধ আমি। আমার ভালোলাগার, গৌরবের এবং ওদের নিয়ে স্বপ্ন দেখার মূল রহস্যটি হলো-ওরা হেঁটে যাচ্ছে, দৌঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের হাত ধরেই। অতএব বিজয় পূর্ণতা পাবেই। আসছে একাত্তরে দেখা বিজয়। অপেক্ষা করুণ, কড়া নাড়ার শব্দ পাবেন শিগগির।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী