বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ

কোলাজ মন্তাজ



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বসাহিত্যে দেশভাগ যেন ট্রাজিক অভিজ্ঞতা। ১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত ভাগ নতুন দুটি দেশের গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত পরিবার পারস্পরিক গৃহবিনিময় করে উভয় রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করলেও অধিকাংশ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় বাস্তবতার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেককে চলে যেতে হয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে। হাসান আজিজুল হকের মতো অনেকককে ভারত ছেড়ে আসতে হয় বাংলাদেশে। এই জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতের রক্তক্ষরণ, নির্মম সময়ের দাগ আমাদের বাংলা সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে। গল্প, উপন্যাস এবং কবিতা সবক্ষেত্রে। কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো, খাজা আহমেদ আববাস, ভীষ্ম সাহানী, খুশবন্ত সিংরা যেভাবে উর্দু এবং হিন্দিতে এই বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন, তা বাংলা সাহিত্যেও এসেছে। এসেছে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক হর্ষ দত্ত যখন প্রশ্ন করেন, “নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোঁয়া রয়ে গেছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টা ঘুরেফিরে এসেছে?” সুনীল তখন উত্তর দেন, “দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সবসময় মনে পড়ে। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এত বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।”

গৌর কিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’, মনোজ বসুর ‘ইয়াসিন মিঞা’, এস এম বজলুল হকের ‘ভাগ না দিয়ে ভাগানো’, অঞ্জলি দেবীর ‘নবীন আশার খড়গ’, অপূর্ব কুমার মৈত্রের ‘স্বাধীনতার ব্যথা’, নরেন্দ্র দেবের ‘চলচ্চিত্র’, সুমথনাথ ঘোষের ‘উদ্বাস্তু’, হরি নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পুনশ্চ’, ‘ইতিহাস’ ও ‘লাঠিয়াল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিক পাত্র’ ও ‘সড়ক’, ফণীন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘গোপাল উড়ের লেন’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’, সমরেশ বসুর ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেডমাস্টার’ ও ‘পালঙ্ক’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘নেহায়েৎ গল্প নয়’, নূর আলীর ‘মোহাজের’, বেগম হাশমত রশীদের ‘ফরিয়াদ’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ছুরি’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্বেতকমল’ ও ‘অধিকার’, প্রতিভা বসুর ‘দুকূল হারা’ ও ‘অপরাহ্ণে’ ইত্যাদি দেশভাগের গল্প।

স্মৃতি’ আর ‘নতুন অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন’—এই দুটি মাত্রায় দেশভাগের সাহিত্য বিকশিত। দেশভাগের সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে এই স্মৃতি আর ফেলে আসা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। দেশভাগের এই গল্প সংকলনে অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ভিটেমাটির রূপকথা’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘দেশভাগের পর’, জাফর তালুকদারের ’পিতৃভূমি’, জীবন সরকারের ‘কোষা’, দেবেশ রায়ের ‘উদ্বাস্তু’, প্রতিভা বসুর ‘দু’কূল হারা’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মোজাহের’ মিহির মুখোপাধ্যায়ের ‘বাঙলাদেশ’, মিহির সেনগুপ্তের ‘পিতামহীর স্বদেশযাত্রা’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’, সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’, জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, প্রফুল্ল রায়ের ‘রাজা যায় রাজা আসে’, বনফুলের ‘দাঙ্গার সময়’, ইসহাক চাখারীর ‘রায়ট’ প্রভৃতি গল্পের নামই যেন দেশভাগের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিতবাহী।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প

এছাড়া ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিকপাত্র’, কৃষণ চন্দরের ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর ‘যে তোমায় ছাড়ে’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পালঙ্ক’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দোসর’, বিমল করের ‘অন্তরে’, শওকত ওসমানের ‘আলিম মুয়াজিজন’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘তোমার উদ্দেশ্যে’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, সাদত হাসান মান্টোর ‘শরিফান’, সমরেশ বসুর ‘আবাদ’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘নেড়ে’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জুয়া’, প্রভৃতি গল্পে দেশভাগের পূর্ব ও পরেকার নানাবিধ মানসিক ও মানবিক সংঘাত, সংঘর্ষ, হাহাকার ফুটিয়ে তুলেছেন লেখকরা।

তবে বাংলাদেশের সাহিত্যে এ বিষয়ে কম লেখা হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া এবং দেশভাগের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এটিই স্বাভাবিক। দেশভাগের পর উপন্যাস পেতে আমাদের ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। ওপার বাংলার আরো কয়েকটি উপন্যাস হলো—অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, শক্তিপদ রাজগুরুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’, সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’।

“১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ হলে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠল। বাঙালি মুসলমান লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলেন। বলা বাহুল্য, তাঁরা বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ধারার উত্তরাধিকারটিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এবার তাঁদের নবযাত্রা শুরু হলো।” (বাংলাদেশের ছোটগল্প, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৯, পৃ. ছয়)

দেশভাগ নিয়ে ঢাকায়, সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্রে অনেকেই উপন্যাস লিখেছেন। কলকাতা থেকে ফিরে সাহিত্যের যে নবযুগের সূচনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ঔপন্যাসিক হলেন—আনোয়ার পাশা, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল ফজল, আবু ইসহাক, সত্যেন সেন, রাজিয়া খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েনউদ্দীন। এদের উপন্যাসে দেশবিভাগ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ও কাহিনীর মৌল বিবেচ্য হয়েছে। পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী ও সেলিনা হোসেনের উপন্যাসেও দেশবিভাগের ইতিহাস-অভিঘাত রূপায়িত হয়েছে।

আরো পড়ুন ➥ শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’

প্রথম দিকের উপন্যাসে দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা, বাস্তুচ্যুতির জন্য বেদনাবোধ, স্মৃতিকাতরতা ও ভয়ার্ত অস্তিত্ব-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত লেখকদের উদারনৈতিক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডকুমেন্টিরির মতো করে দেশভাগের ঘটনার উপস্থাপন করা হয়েছে। তারপর কালে কালে তার বিস্তৃতি ঘটেছে। সেই ষাটের দশকের লেখক যারা, তারা এই এত বছর পরে এসেও যখন দেশবিভাগ নিয়ে উপন্যাস লিখেন, সেখানেও দেশবিভাগের অনিবার্য অভিঘাত চিত্রিত হয়। এর নিকতম উদাহরণ হলো ২০১০ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘আগুনপাখি’।

পঞ্চাশের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৯৪৩ থেকে দেশবিভাগ (১৯৪৭) সময়বৃত্তে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের কাহিনী বিন্যস্ত। আবু ইসহাকের মুখ্য অভিনিবেশ ছিল জয়গুনকেন্দ্রিক নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রামের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা। উপন্যাসের সূচনায় আছে মন্বন্তরের প্রসঙ্গ। দুর্ভিক্ষতাড়িত মানুষ স্বপ্ন দেখেছে, দেশ স্বাধীন হলে চালের দাম কমবে। দেশ একদিন স্বাধীন হয়। কিন্তু জয়গুনদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার হয় সমাধি। তাদের ভিটা থেকে আবার উচ্ছেদ হতে হয়। দেশবিভাগ অসংখ্য মানুষকে উদ্বাস্তু করেছিল। সেই বাস্তবতার পরিবর্তে পাকিস্তান রাষ্ট্রে জয়গুনদের নিরাশ্রয়তার নির্মম আলেখ্য রচিত হয় কাহিনীতে।

আবুল ফজলের ‘রাঙ্গাপ্রভাত’-এ দেশভাগ, পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংকট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা প্রকাশিত হয়েছে।

রাজিয়া খানের ‘বটতলার উপন্যাস’-এ দেশভাগজনিত সংকট এবং উপমহাদেশের বিশাল ভৌগোলিক পরিসরে চরিত্রপাত্রের জটিল সমস্যার বিন্যাস দেখানো হয়েছে। মঈনের স্বদেশ উন্মূলিত বাস্তবতা দেশভাগজনিত। তার ব্যক্তিজীবনের স্বপ্ন, প্রেম, এমনকি পারিবারিক পরিবেষ্টনীকে বিপর্যস্ত করেছে দেশভাগ। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরও মঈন কলকাতার মেয়ে সুমিতার প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব করেছে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাধারায় সেই অনুরাগ শেষ পর্যন্ত নতুন রাষ্ট্রের জটিল পরিস্থিতিতে শুভ পরিণতিতে উপনীত হতে পারেনি।

শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ১৯৩৮ থেকে ১৯৫১ কালপর্বের কাহিনী। দুটি গ্রাম বাকলিয়া ও তালতলী প্রধান হলেও কলকাতা ও ঢাকার পটভূমিও উপন্যাসটির ঘটনাধারায় বিস্তৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধোত্তর কলকাতার দাঙ্গা, দেশবিভাগের পর বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের পথপরিক্রমায় এগিয়ে গেছে ‘সংশপ্তক’-এর কাহিনী।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’ উপন্যাসের কাহিনী পরিব্যাপ্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। কবি রহমতের স্মৃতিকথার মধ্য দিয়ে দেশভাগ ও দেশবিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্মোচিত হয়েছে। স্বপ্নের ভূখণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক হায়াত খাঁ টঙ্গী সোনারগাঁ জুট মিলে শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণকালে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। অনেক সূর্যের প্রত্যাশায় লালিত ভূখণ্ডের এ বেদনার স্বরূপ নির্দেশের মধ্য দিয়েই উপন্যাসের সূচনা। দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নকল্পনা ও ভাবাবেগ কিভাবে বারবার বিচ্যুত হয়েছে তারই পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা উপন্যাসটির গভীরে প্রোথিত।

আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র কাহিনী শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালে এসে। এরপরই দেশভাগ থেকে শুরু হয়েছে ‘সংকর সংকীর্তন’-এর ঘটনা। কলকাতা ও তার আশপাশের পটভূমিতে প্রধান চরিত্র মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের জীবন চিত্রিত হয়েছে এখানে। তবে ফরাজি আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত এ উপন্যাসের ঘটনা। ব্রিটিশদের স্বার্থচালিত শোষণ-প্রক্রিয়া ও দ্বিজাতিতত্ত্ব উদ্ভাবনের মনস্তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। মূলত ‘ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ এবং ‘সংকর সংকীর্তন’ এই তিনটি উপন্যাসে একটি পরিবারের যোগসূত্রে বাঙালি মুসলমানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন। সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ ও তিন খণ্ডের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’য় দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবন ও তেভাগা প্রসঙ্গের রূপায়ণে পরোক্ষভাবে দেশভাগের প্রসঙ্গ রেখায়িত। মূলত ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন কালানুক্রমিক ঘটনাধারায় আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদী আদর্শ এবং প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক জীবনবোধের বিকাশ ঘটে।

তিনটি স্মৃতিকথা

মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’, সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ এবং সীমা দাশের ‘দ্যাশ থেকে দেশে’ বই তিনটিতে আমরা দেশভাগের স্মৃতি দেখতে পাই। বিষাদবৃক্ষ লেখার আগে মিহির সেন গুপ্ত আরো তিনটি বই লিখেছিলেন, যদিও তার কোনোটারই বিষয় দেশভাগ ছিল না। চতুর্থ বইতে রচনাশৈলীতে অবশ্য তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়। বরিশালের প্রান্তিক গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারে লেখকের জন্ম। মিহির লিখেছেন, “আমার আলেখ্যর জন্যে সময়কাল হিসেবে আমি ন্যূনাধিক দশ বছরের মতো একটা পরিসর নিয়েছি। সেই দশ বছরের সময়কালটি উনিশশো একান্ন-বাহান্ন থেকে উনিশশো বাষট্টি-তেষট্টি পর্যন্ত বিসত্মৃত।” তাঁর বাড়ির পেছনদিকে ছিল একটা সরু খাল। “দুপাশের বাড়িঘর, আগান-বাগানের মাঝখান দিয়ে তার গতি লীন হতো গিয়ে বড় খালে। বড় খালটিও ওইরকমভাবে গিয়ে পড়ত নদীতে।” বাড়ির পেছনের এই ছোট খালটিকে লেখক তাঁর বরিশালি ভাষায় বলেছেন, ‘পিছারার খাল’। মিহিরের বর্ণনায়—“এই খালটি আমাদের বড় আত্মীয় ছিল।” এই পিছারার খালটিকে ঘিরে কতগুলো হিন্দু পরিবারের ক্রমবর্ধমান আর্থিক অবনতি, আঁকড়ে থাকা জমিদারি ঠাঁটবাট, সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলা, মুসলিম তালুকদার ইত্যাদি শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি মিহির বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশেষত আমাদের পরিবারের বা তার থেকেও ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে যেসব মধ্যস্বত্বভোগী আছে তাদের সমূহ সংকট। তাদের মধ্যস্বত্বের খাজনার পরিমাণের ব্যাপারটা অঙ্কে আসে না। কিছু খাসজমির উপজ তাদের বাঁচিয়ে রাখে।… এই খাসজমি যদি তারা নিজেরা চাষ করে তবুও কথা ছিল। কিন্তু তা কী করে হবে? তারা যে জমিদার। জমিদার জমি চষে না। প্রজাপত্তনির প্রজারাই তা চষে। জমিদার ফসলের ভাগ পায়। এই ব্যবস্থার জন্যে যখন প্রজাপত্তনি, মধ্যস্বত্ব যায় তখন খাসজমিও যাবার রাস্তা ধরে…।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

লেখক সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছেন পূর্ববাংলায় দেশভাগের পক্ষে বাতাবরণ তৈরির মূলে ছিল জমিস্বার্থ। জমির মালিকানার হ্রাস-বৃদ্ধি যে কিভাবে পূর্ববাংলার হিন্দু ও মুসলিম মানসিকতা প্রভাবিত ও চালিত করেছিল তার যথাযথ বিবরণ আছে মিহিরের বিষাদবৃক্ষে। তিনি লিখেছেন, “পিছারার খালের চৌহদ্দিতে যেমন, গোটা পূর্ব বাংলায়ও তেমনি, সামন্তশ্রেণী বলতে হিন্দু সামন্তদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু তা ছিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর সামগ্রিক হিসেবে। তার অর্থ এই নয় যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জমিদার বা অন্য মধ্যস্বত্বভোগীরা সাধারণ এইসব মানুষকে শোষণ বা নির্যাতন করত না। আমার পরিমণ্ডলে আমি অনেক তথাকথিক তালুকদার দেখেছি যারা সাম্প্রদায়িকভাবে মুসলমান এবং শ্রেণীশোষণ বা নির্যাতনে ওখানকার হিন্দু জমিদার বা তালুকদারের তুলনায় কিছুমাত্র ভিন্ন নয়। সেক্ষেত্রে লিগপন্থীরা সাধারণদের বুঝিয়েছিল যে পাকিস্তান কায়েম হলে সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ হবে এবং অবস্থাপন্নদের সংযত রাখার জন্যে ইসলামি বিধি মতে ‘জাকাত’, ‘খয়েরাত’ ইত্যাদি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু পাকিস্তান কায়েম হবার পর এমনকি মধ্যস্বত্ব প্রথা উচ্ছেদ হবার পরও এই প্রতিজ্ঞা পালনের কোনো প্রচেষ্টাই হয়নি। না হওয়ার কারণটিও অবশ্য শরিয়তি ব্যবস্থার অন্তর্গত, অন্যের ‘হক্কের সম্পত্তি’ দখল করা না-জায়েজ, হারাম—এমত নির্দেশ। সে সম্পত্তি হিন্দুর হলে জায়েজ এবং মুসলমানের হলে না-জায়েজ, এসব বিতর্কে তখন অন্তত কেউ যাননি…।”

আরেক জায়গায় মিহির লিখেছেন, “আশেপাশের মুসলমান গ্রামগুলিতে যথেষ্ট উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবার বিশেষ ছিল না। মাঝারি মাপের যারা তারাই এখন সব ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পদ নিয়ে নিজেদের ঘর এবং জীবন সাজাতে চেষ্টা করছে। এই সময়টা থেকে বড়, মাঝারি এবং কিছু ছোট কৃষক পরিবারও ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তির পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনায় বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠে। রাতারাতি তাদের বাড়ি-ঘরদোরের চেহারা বদলে যেতে থাকে এবং তারা বেশ হোমড়াচোমড়া হয়ে দাঁড়ায়।” অন্যদিকে, “পিছারার খালের আশেপাশের হিন্দু সমাজটি তখন একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। ফলে অবশিষ্ট হিন্দু অধিবাসীদের মধ্যে একটা নৈতিক অধঃপতন আস্তে আস্তে পরিলক্ষিত হতে থাকে। পারিবারিক শাসন আলগা, অভিভাবকেরা উদাসীন, ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, বিবাহের বয়স অতিক্রান্ত মেয়েদের বিয়ে-থা দেওয়া হচ্ছে না। সে এক মাৎস্যন্যায়ী অবস্থা।”

বিদ্বজ্জনরা বিভিন্ন নিবন্ধে দেখিয়েছেন, পূর্ববাংলায় নিম্নবর্গীয় ও নমঃশূদ্ররা বরাবরই ছিল একটি দোদুল্যমান শ্রেণি। নিম্নবর্গীয় পরিচিতি সত্তা হিন্দু বা মুসলিমের সত্তা থেকে স্বতন্ত্র—এরকম একটা বোধ বরাবরই তাদের মধ্যে অটুট ছিল। তারা কখনো দাঁড়িয়েছে মুসলিমদের পাশে, কখনো হিন্দুদের। দেশভাগের প্রাক্কালে মুসলিম লিগের বন্ধু হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল হয়ে উঠেছিলেন নমঃশূদ্রদের অবিসম্বাদী নেতা। পরবর্তীকালে জিন্নাহর প্রথম সরকারে পূর্ববাংলা থেকে আমন্ত্রিত একমাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ১৯৫০ সালেই অবশ্য যোগেন্দ্রনাথ জিন্নাহর মন্ত্রিসভায় তিনি যে কতটা অবহেলার পাত্র তা বুঝে যান এবং একটি দীর্ঘ পদত্যাগপত্র লিখে ভারতে চলে আসেন। তা সত্ত্বেও অনেকদিন পর্যন্ত নিম্নবর্গীয়দের ধারণা ছিল, মুসলিম দাঙ্গাবাজরা তাদের স্পর্শ করবে না। কিন্তু যেখানে জমিস্বার্থই প্রধান এবং রাষ্ট্র যখন সরাসরি মদদ ও প্রশ্রয় দিচ্ছে তখন নিজেদের আর কতদিন নিরাপদ রাখা সম্ভব।

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

নিম্নবর্গীয়দের ওপর আক্রমণ মিহিরবাবু প্রত্যক্ষ করেছেন পঞ্চাশের দশকের শেষে। তিনি লিখেছেন, “আটান্ন-ঊনষাট সাল। পিছারার খালের আশেপাশের ভদ্র হিন্দু গেরস্তরা প্রায় শতকরা নিরানব্বই ভাগ তখন গ্রাম ত্যাগ করেছেন। শুধুমাত্র নিরুপায় হয়ে কিছু ভদ্র হিন্দু এবং নিম্নবর্ণীয়রা, যুগী, নাপিত, ধোপা, কামার, কুমোরেরা গ্রামে রয়ে গেছে। নিম্নবর্ণীয়দের তখনও ভরসা আছে যে মুসলমান শাসকশ্রেণী তাদের উপর আঘাত হানবে না।… পরে আর নিম্নবর্ণীয় বা বর্গীয় হিন্দু-মুসলমানদের অভিন্ন স্বার্থের কথা ক্ষমতাসীন কায়েমি স্বার্থান্বেষী সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের মনে থাকে না।… উচ্চবর্গীয়দের সম্পত্তি দখল হলে তাদের নজর পড়ে অপবর্গীয়/ বর্ণীয়দের গেরস্থালিতে। অতএব দখলকারিরা কায়দা পাল্টাতে শুরু করে।… তাঁতি বা যুগীদের ভিটেমাটি দখল শুরু হয়।… তখন আমাদের সংহতি সংগীতের সেইসব পংক্তিগুলো হারিয়ে যেতে থাকল—হিন্দু ও মুসলিম এক পরানেরআমরা করি না বিবাদ…।”

একটি ন্যায্য প্রশ্ন হলো, মিহির তাঁর এই বইয়ের নাম বিষাদবৃক্ষ রেখেছেন কেন? যে-পিছারার খালের বর্ণনা দিয়ে তিনি তাঁর লেখা শুরু করেছিলেন তার পাড়ে আছে একজোড়া রেন্ট্রি গাছ—লেখকের ভাষায় একত্রে সেই মহাবৃক্ষ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এই বৃক্ষের নিচে একদা সুভাষচন্দ্র বসু এসেছিলেন। হিন্দু-মুসলিম বা নিম্নবর্গীয়দের বহু গান, কথকতা, যাত্রাপালার আসর বসত ওই বৃক্ষের আশপাশে, তারপর দেশভাগ হলো, একে একে চলে যেতে লাগল হিন্দুরা, সেই মর্মান্তিক ঘটনারও সাক্ষী ওই মহাবৃক্ষ। হিন্দুরা চলে যাওয়ার ফলে সেই পিছারার খাল আর বড় খালের দুই পাড়ে সৃষ্টি হলো এক বিশাল শূন্যতা। “সেই শূন্যতা আমি স্বয়ং উপলব্ধি করেছি, উপলব্ধি করতে দেখেছি ওখানে থেকে যাওয়া হিন্দুদের এবং মুসলমানজনেদেরও। এমনকি যারা হিন্দুদের দেশত্যাগজনিত কারণে সমূহ লাভবান, তাদের বাড়ির যুবজনেরা বা মেয়েরা এই শূন্যতার কারণে যে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করত তাও তো দেখেছি। এই শূন্যতা ভরাট করার উপায় এখানের মুসলমান সমাজের মানুষদের তখন ছিল না। পিছারার খালের আবেষ্টনীর মুসলমান এবং তফসিলিভুক্ত মানুষের মধ্যে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। যা দু-একজন এই শ্রেণীচরিত্রের ছিলেন, তারা শ্রেণী গঠন করেননি, শুধুই মধ্যবিত্ত হিসেবে স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির ফয়দা তুলেছেন। মধ্যবিত্তশ্রেণী বলতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভদ্রবাবুরাই ওখানে সমাজের স্তম্ভ এবং এ কারণেই তাদের দেশত্যাগ এই বিরাট শূন্যতার বাতাবরণ তৈরি করেছিল।”

এই সাংস্কৃতিক শূন্যতার বিষয়টি কোনো দেশভাগের ইতিহাস বইতে পাওয়া যাবে না। এই শূন্যতা কোনো সংবেদনশীল হৃদয় ছাড়া অনুভব করা অসম্ভব। এটাই একটা স্মৃতিকথার সাফল্য এবং হয়তো এ-কারণে তা অনেক গুরুত্বপূর্ণও বটে। আরো বোঝা যায়, লেখক পূর্ববাংলাকে ভালোবেসেছিলেন সেখানকার একজন মানুষ হিসেবে, হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান ধরে নিয়েই। সে-কারণেই ওই শূন্যতা তাঁর চোখে প্রকট হয়ে উঠেছিল। বিষাদবৃক্ষ হলো আসলে সেই শূন্যতারই কাহিনী। দয়াময়ীর কথা একটি অসম্ভব সুন্দর, সম্পূর্ণ ব্যাকরণসম্মত স্মৃতিকথা হলো সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’। ব্যাকরণসম্মত এই অর্থে যে, লেখক এখানে শুধু আদ্যোপান্ত স্মৃতিচারণই করেছেন—জিন্নাহ, নেহরু, কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ প্রসঙ্গ তাঁর রচনায় একবারও আসেনি। দয়ার জন্ম ১৯৫১ সালে ময়মনসিংহের দিঘাপাইত গ্রামে। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দশ বছর তিনি কাটিয়েছেন ওই প্রত্যন্ত গ্রামে। দয়ার কৃতিত্ব এই যে, পরিণত বয়সে নিজের আত্মকথা লেখার সময়েও তিনি তাঁর বোধবুদ্ধি ও সারল্য দিয়ে সেই দশকটিকে বিচার করেছেন। নিঃসন্দেহে দয়াময়ীর কথা পঞ্চাশের দশকের পূর্ববাংলার একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। লক্ষ করার মতো, লেখিকার ক্ষোভ বারবার ফুটে উঠেছে সে-যুগের হিন্দু ভদ্রলোকদের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। যেমন “আমার পালিকা মায়ের কথা আমার কাছে ছিল যেন নিয়তির বাণী।”, “দয়া ভুইল্যা যাইও না মাজম আমাদের কামলা, মোসলমানের পোলা, গরু-বাছুর, খ্যাত-খামার দেখনের মানুষ, তোমার রক্তের সম্পক্কের কেউ না। মিলন-মিশনের কাম নাই।” এই হলো এক হিন্দু উচ্চবিত্ত মহিলার অন্তরের কথা। আর তাঁর প্রজা দরিদ্র বর্গাচাষি মাজম ফজরের নামাজের সময় বলে, “ও মা, দয়া তুই কি পাগুলনি; আল্লাহর সঙ্গে দুগ্গা-লক্ষ্মীর কুন কাজিয়া নাই। বেহেস্তে সগ্গলের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা, কুন কাজিয়ার জায়গা নাই। ওইসব মাইনষে করে।” দয়াময়ীর কথা পড়লে বোঝা যায় সে-সময়ের পূর্ববাংলার প্রান্তিক গ্রামগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তেমন তীব্র ছিল না। দাঙ্গা, খুন-খারাবিও নয়। সাধারণ কিছু ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যা বাদ দিলে দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি অটুট ছিল। তবু বহু হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। দিঘাপাইত গ্রামটা ছিল শান্ত। কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই। তবু চারিদিকে যে একটা অশান্তির হাওয়া বইছে তা ওই নিস্তরঙ্গ গ্রামে বসেও টের পাওয়া যেত। সুনন্দা শিকদার লিখেছেন, “বড় তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছে চারিদিকের দৃশ্যপট।… পলুদাদের বাড়িটা কি তাড়াতাড়ি ভিটে হয়ে গেল। চলে গেল গরুর গাড়িতে করে থালাবাসন, কাঁঠাল গাছের পিঁড়ি, পোঁটলায় ভর্তি চিড়ে-মুড়ি, ট্রাঙ্ক, শতরঞ্চি দিয়ে বাঁধা বিছানা-বালিশ।… চোখ মুছতে মুছতে কেউ যেতেন, কেউ আবার চিৎকার করে বলতে বলতে যেতেন—‘ও গো চলি জন্মের মতন, যদি কোনো অপরাধ কইরা থাকি মাপ কইরা দিও।’ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতিদিন এই দৃশ্য দেখতাম। অনেকে আবার বলতেন, ‘ওরে বুড়ি যাইতেছি সারা জীবনের মতো। গাঁওয়ের কারো সঙ্গে তো আর দেখা হইব না। হিন্দুস্থানে গেলে তুই দেখা করিস।”

আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত

কোনো সন্দেহ নেই যে, দুই বাংলাজুড়ে লাখ লাখ মানুষের এই আকস্মিক বিচ্ছেদই হলো বঙ্গবিভাজনের অন্যতম ট্র্যাজিক পরিণতি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না থাক, ছোঁয়াছুঁয়ির সতর্কতা ছিল তীব্র। দয়াময়ীর কথায় তার অজস্র নিদর্শন আছে, “মাকে সিরাজদা একটা কথা বলত, তোমারও পিসিমা কম না। এতকাল তোমাগো সঙ্গে আমাগো সম্পক্ক, তাও তোমারে ছুঁইলে তোমাগো জাত যায়। দয়া একটা ছুট পোনাই, অরে কারো সঙ্গে মিলবার দেও না। তোমাগো ঘরবাড়ি পুড়ল, দ্যাশ ছাইড়ত্যাছো, কিন্তু জেদটা ঠিক পুইস্যা রাখছো।… রাগ কইরো না পিসিমা, অনেক দুঃখে এই কথা কইলাম। তুমি আমারে ঘরে ডাইক্যা কোনোদিন এক গিলাস পানি খাওয়াইছো?”

সুনন্দা শিকদারের মতে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বঙ্গবিভাজনের মূলে আছে ওই ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যা। হিন্দুদের শরীর মুসলমানে স্পর্শ করলে হিন্দুদের জাত যায়। এর অর্থ হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। এসে যায় জাতিবিরোধ। এই বিরোধে হিন্দুরাই যে সেই সময় হয়ে পড়েছিল দুর্বল প্রতিপক্ষ, সেকথা সবাই জানে। সে-কারণেই তো দলে দলে হিন্দুদের দেশত্যাগ। কিন্তু হিন্দুরা কি ছিল একেবারেই নির্দোষ, অবলা একটি জাতি! বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সুনন্দা শিকদার তাঁর সোবহান দাদার মুখ দিয়ে, “নোয়াখালিতে হিন্দুদের ওপর মুসলমানেরা ভীষণ অত্যাচার আর জুলুমবাজি করেছে। হিন্দু মেয়েদের অপমান করেছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে মুসলমানদের এত অপঘিন্না হিন্দুরা করেছে তারও তুলনা নেই।… হিন্দুরা কুনদিন মুসলমানদের ঘরে ঢুকতে দেয় নাই। ছুঁইলে জাত যায়। আলাদা হুঁকা, আলাদা বাসন। মুসলমান মেহমানেরে বাইরে বসাইয়া খাওয়ায়। অনেক বছর ধইরা এই ভুলগুলা হিন্দুরা করছে। তবে যেভাবে মোসলমানেরা শোধ তুলতাছে, এইডা কিন্তু আমাগো পছন্দ না।”

‘দ্যাশ থেকে দেশে’ স্মৃতিকথা হিসেবে সার্থক ঠিকই কিন্তু বইটিকে দেশভাগ বিষয়ক স্মৃতি আলেখ্যগুলোর তালিকায় স্থান দেওয়া উচিত কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সম্পূর্ণ বইটি তিনটি আলাদা খণ্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে দেশভাগ ও দেশত্যাগের যাবতীয় স্মৃতি সংকলিত হয়েছে দ্বিতীয় খণ্ডে যার নাম ‘দ্যাশ থেকে দেশে আসার বৃত্তান্ত’। এই খণ্ডটি মোট দুশো পাতার বইতে দখল করেছে মাত্র ছাব্বিশ পৃষ্ঠা। অর্থাৎ দেশভাগ এই লেখিকাকে শৈশবে যতটা আলোড়িত করেছিল পরবর্তীকালে তার রেশ আর তেমন তীব্র ছিল না। এই বইটি আরো এক বিচারে পূর্বে আলোচিত দুটি বইয়ের থেকে আলাদা। তা হলো, আগের দুটি বই পড়লে বোঝা যায় তাদের লেখক-লেখিকাদের মনে দেশভাগজনিত বিষণ্ণতা একটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। কিন্তু আলোচ্য বইয়ের লেখিকা সীমা দাশ কলকাতায় এসে আরো বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন এবং আরো অনেক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, যেগুলো তাঁর দেশত্যাগের বেদনা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। সম্ভবত সেটাই বাঞ্ছনীয়। তাই অতীতচারণ করতে গিয়ে তিনি পূর্ববাংলার জীবনকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, কলকাতার গণনাট্য সংঘ, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস ইত্যাদি স্বনামধন্য চরিত্রও সেখানে সমমর্যাদা পেয়েছে। দ্যাশ থেকে দেশে তাই আদ্যোপান্ত একটি স্মৃতিকথা হলেও পুরোপুরি দেশভাগ বিষয়ক স্মৃতিকথা নয়। আরো একটি বিষয় অবাক করার মতো। লেখক যতদিন পূর্ববাংলায় ছিলেন (শৈশব), কোনো মুসলমান চরিত্র তাঁর সেই শৈশবের স্মৃতিতে নেই। সীমা দাশের জন্ম পটুয়াখালীতে ১৯৩৮ সালে। বাংলার বিভাজনপূর্ব রাজনীতিতে পটুয়াখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। তার এক বছর আগে ১৯৩৭ সালে এই পটুয়াখালী আসনে মুসলিম লিগ নেতা ঢাকার নবাব নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করেছিলেন সদ্য গঠিত কৃষক প্রজাপার্টির নেতা ফজলুল হক। শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতের দৃষ্টি ছিল পটুয়াখালীর দিকে। এই নির্বাচনে জিতে হক সাহেব বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। শুধু তাই নয়, তাঁর জয় প্রমাণ করে দিয়েছিল বাংলার রাজনীতিতে নেতা নির্বাচন বা বর্জনের ক্ষেত্রে কৃষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর অ্যান্ডারসন নিজে নাজিমুদ্দিনের হয়ে প্রচার করে তাঁকে জেতাতে পারেননি। এসব ঘটনা সীমা দাশের বাবা, কাকা বা পড়শিজনদের মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলেছিল তা এই স্মৃতিকথাটি পড়লে বোঝা যায় না। লেখিকার জন্ম একটি সংগীতমগ্ন, সংস্কৃতিমনা পরিবারে। বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর চর্চা, প্রয়োগরীতি ইত্যাদি এই স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে বারবার। আবার লেখিকা ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার স্মৃতি উল্লেখ করেছেন, “মাঝরাতে হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসছে কোলাহল চিৎকার—আল্লা হো আকবার ধ্বনি।… আমাদের পাড়াটায় সবাই হিন্দু।… দূর থেকে তারা দেখতে পায় আগুন যেন আকাশ ছুঁতে চলেছে। এরই মধ্যে শোনা যায় দুরকম ধ্বনি—‘বন্দে মাতরম’, ‘আল্লা হো আকবর’… বাড়ির উঠোনে তখনও তীর, ধনুক, লাঠি, ইট, বালি পড়ে। এই আগুন জানিয়ে গেল ভেতরে ভেতরে হিন্দু মুসলমান একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে যৌনতা

এই দাঙ্গার পর তাঁদের পরিবারটি আর বেশিদিন পূর্ববাংলায় থাকেনি। বোঝাই যায় ওই দাঙ্গা সেই শান্তিপ্রিয়, সংগীতপ্রেমী পরিবারটির অন্তঃস্থলে বিরাট ধাক্কা দিয়েছিল, পুড়ে গিয়েছিল তাঁদের দোকানটিও। সীমা দাশের বাবা তখন থেকেই কলকাতায় চাকরির সন্ধান শুরু করে দেন। এরপর আসে দেশত্যাগের গল্প। তার আগে অবশ্য লেখিকা স্বাধীনতা ও দেশভাগের দিনটি বর্ণনা করেছেন এভাবে, “স্বাধীনতার দিন বাড়িতে দুরকমের পতাকা টাঙানো হয়েছিল। একটা পাকিস্তানের অন্যটা কংগ্রেসের।… মুসলমান পাড়ার তুলনায় এ সাজ জৌলুসহীন, ওদের ওখানে কোনো কংগ্রেসের পতাকা নেই। কেবল শ’য়ে শ’য়ে জিন্নাহর ছবি। দূরে মুসলমান পাড়ায় আমরা ছোটরা কয়েকজন হাঁটতে হাঁটতে গেছি। ওরা কী করছে দেখি গে। ওদের টানাটানি, আপ্যায়নের ঠেলায় আমরা তো অস্থির। প্যাকেট প্যাকেট মিঠাই, তবক দেওয়া সব মুসলমানি মিষ্টি। তখন ছোট হলেও মনে সুখ পাচ্ছি না। যেন হেরে গেছি আমরা।”—এখানে লেখকের সরল সত্য ভাষণে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। প্রথমত, দেশভাগ হওয়ামাত্রই যে মুসলিমরা হিন্দু বিতাড়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তা নয়। দুটি আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত হলেও বিদ্বেষ তখনও ছিল না। যা এসেছে পরে, বিভিন্ন সামাজিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। দ্বিতীয়ত, লেখক মনে সুখ পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁরা হেরে গিয়েছেন। কেন এই পরাজয় বোধ? এই বোধের উত্তর কোনো স্মৃতিকথাতেই নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে এই পরাজয়ের পীড়নই ছিল অন্তত প্রথম পর্যায়ে দেশত্যাগের আসল কার্যকারণ। এই দেশত্যাগের বিষণ্ণতা সবার জন্যই একরকম, “সবার চোখে জল। কেউ বলে আবার আইস্যো। কেউ বলে আমাদের ভুলবা না তো। গিয়াই পত্র দিও। সবার কান্না দেখে মনটা হু হু করে ওঠে।” পরে আবার, “সব ছবি হয়ে যাচ্ছে, স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে,… ওই তো দূরে স্টিমার ঘাট, ওই তো পাবলিক থিয়েটার হল, ওই তো বাজার, ওই আদালত, পোস্টাপিস, কালীবাড়ি, ওই তো ওখানে সতীন সেনের বাড়ি।… আমরা আবার আসুম। মায়ের চোখেও জল।”

এই তিনটি স্মৃতিকথারই লেখক-লেখিকারা হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি এবং তিনটি রচনারই মূল সুর একটাই, দেশভাগ না হলেই ভালো হতো। কিন্তু একথা তো ঠিক, পূর্ববাংলার দরিদ্র মুসলিম কৃষকরা সর্বাত্মঃকরণে দেশভাগ চেয়েছিলেন। পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের তাঁদের কাছে কোনো তাৎপর্য ছিল না। তাঁরা ভেবেছিলেন, পাকিস্তান হলে বুঝি জমিদারি উচ্ছেদ ও তাঁদের দারিদ্র্যের অবসান হবে। অর্থাৎ কৃষকদের বিদ্রোহের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানপ্রাপ্তি। এর জন্য কৃষকদের দায়ী করা যায় না, দায়ী হলো তারা, যারা কৃষকদের সামনে সেই মরীচিকা তুলে ধরেছিল। দেশভাগ হলো আসলে সেই মরীচিকার কাহিনী আর ওপরে বর্ণিত স্মৃতিকথাগুলো হলো তার উপকাহিনী বা শাখা-প্রশাখামাত্র। আমাদের প্রার্থনা ও লক্ষ্য হওয়া উচিত এহেন মরীচিকার মায়াজালে জড়িয়ে হিন্দু বা মুসলিমরা যেন আর বিপথগামী না হয়। (তথ্যসূত্র: তিনটি স্মৃতিকথা ও দেশভাগ: গৌতম রায়)

দেশভাগের কারণ খুঁজেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকেও ভারত থেকে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। তাঁর বন্ধু জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেতে হয়েছে। দুই বন্ধুর বিচ্ছেদও লেখায় এসেছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেশভাগের কারণ খুঁজেছেন তার লেখায়। তার একটি লেখার শিরোনাম, ‘১৯৪৭ ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ’। তার বিশ্লেষণ এমন:
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি ট্র্যাজেডি খুবই ভয়ঙ্কর: একটি ঘটেছে ১৮৫৭ সালে, আরেকটি ১৯৪৭-এ। একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। মাঝখানে আছে স্বাধীনতাসংগ্রামের মহাকাব্য, কিন্তু সে সংগ্রামের পরিণতি মহাকাব্যিক হয়নি, হয়েছে ট্র্যাজিক। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল, আপাতদৃষ্টিতে তা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং পুরোপুরি অকল্পনীয়। কেউ ভাবেনি এমনটি ঘটবে। স্বাধীনতার নামে যে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস পাওয়া যাবে, এবং ভারতবর্ষ যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো ডমিনিয়ন হয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরেই রয়ে যাবে, এটা মোটামুটি জানা ছিল। কংগ্রেস ও লিগ এ ব্যাপারে সম্মত ছিল; কিন্তু দেশভাগ ঘটবে, বাংলা ও পাঞ্জাব দু-টুকরো হয়ে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হবে—এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

মুসলিম লীগ যা চেয়েছিল, সেটা হলো মুসলমানদের অন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি, তার জন্য যে দেশভাগ প্রয়োজন হবে, এটা তারা ভাবেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি ঢিলেঢালা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি ভৌগোলিক গ্রুপ তৈরির ধারণাটাকে গ্রহণ করেছিল, তার পেছনে এই বোধ কার্যকর ছিল, এর বেশি পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি হয়নি। কারণ তাদের বক্তব্য ছিল, ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ; এবং তাকে কোনো রকমেই বিভাজিত করা চলবে না। তবে দুই পক্ষই আবার এই ব্যাপারে একমত ছিল যে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যাবে না, রাষ্ট্র থাকবে এককেন্দ্রিক; বিরোধটা ছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা কিভাবে ভাগ করা যায়, তা নিয়ে। জওহরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেউই প্রাদেশিক নেতা হতে চাননি, চেয়েছেন সর্বভারতীয় কর্তা হবেন।

আরো পড়ুন ➥ চে, বিপ্লব ও বাজার

ওই যে এক জাতির দেশ বলে দাবি করা—এর ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ। কারণ এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। আসলে ভারতবর্ষ তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম নয়, ভাষা। সে হিসাবে ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষে একটি-দুটিও নয়, সতেরোটি জাতি ছিল। ভারতবর্ষের মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। কিন্তু কংগ্রেস ও লিগ কেউই শ্রেণি সমস্যার সমাধান চায়নি। দুই দলই ছিল বিত্তবানদের সংগঠন। তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকেরা তাদের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে, এবং তারা গদিতে বসে পড়ে ঠিক সেভাবেই দেশ শাসন করবে, যেভাবে ইংরেজরা করেছে। শাসন মানে আগের মতোই দাঁড়াবে শোষণ। শ্রেণিবিভাজনের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল; সেটা কংগ্রেস ও লিগ কেউ চায়নি; ইংরেজরা তো চায়ইনি। ইংরেজরা চেয়েছে তাদের আনুকূল্যে তৈরি বিত্তবান তাঁবেদার শ্রেণির হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাবে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে।

দেশভাগ হয়েছে এই তিন পক্ষের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। মেহনতি মানুষ এর ধারেকাছেও ছিল না। বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কংগ্রেস ও লিগের নেতাদের দর-কষাকষি চলেছে। জিন্নাহ ও নেহরুর সঙ্গে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নেহরুর সঙ্গে তো সম্পর্কটা বন্ধুত্বের পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। এই বন্ধুত্ব বড়লাটের স্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নেহরু-জিন্নাহর কলহটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার মতো। বাগ্বিতণ্ডা চলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ভাই-ই মেনে নিলেন যে ক্ষমতার ভাগটা দেশভাগ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে গেল।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জ্বলে নেভে ফ্যাসিস্ট ও বিপ্লবীর চরিত্র

ক্ষতি বিত্তবানদের হয়নি। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। ঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, তবে ধারণা করা হয়, ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষতিটা অপূরণীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব করা যায়নি, যাবেও না। অথচ মূল যে সমস্যা—যেটা হলো শ্রেণিবিভাজনের—তার কোনো সমাধান ঘটল না। ধনী-গরিবের পার্থক্য আগের মতোই রয়ে গেল। উন্নতি যা হলো তা বিত্তবানদের, সেই উন্নতির বাহক হয়ে থাকল মেহনতি মানুষ, আগে যেমন ছিল। শ্রেণি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমাজতন্ত্রীরা করেছিলেন। তাঁরা সংগ্রামে ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদী দলের হাতে। যারা ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত, এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী। বস্তুত দেশভাগে তড়িঘড়ি সম্মত হওয়ার পেছনে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তো ছিলই, আরো বড় করে ছিল সমাজবিপ্লবের ভয়। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার একটা মীমাংসা সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটলে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে—ছালা তো যাবেই, আমও হাতছাড়া হবে। অতএব যা পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ভালো। অস্পষ্টভাবে হলেও নেহরু-জিন্নাহরা জানতেন, ইংরেজের সঙ্গে দর-কষাকষি সম্ভব, কিন্তু মেহনতিরা উঠে এলে কোনো আলাপই চলবে না। তাঁরা জানতেন, ইংরেজ তাঁদের শত্রু বটে, তবে আরো বড় শত্রু হচ্ছে স্বদেশি মেহনতি মানুষ। এর প্রমাণ সুন্দরভাবে পাওয়া গেছে ‘স্বাধীনতা’র পরে। ভারতে কংগ্রেসবিরোধী মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হয়নি, যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি লিগবিরোধী কংগ্রেস; কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি।

শ্রেণি সমস্যা আড়াল করার জন্যই কিন্তু জাতি সমস্যাকে প্রধান করে তোলা হয়েছিল। এবং জাতীয়তার মূল ভিত্তি যে ভাষা, সেটাকে অস্বীকার করে ধর্মকে নিয়ে আসা হয়েছিল সামনে। ফলে সম্প্রদায় জাতি হয়ে গেল, জাতি রয়ে গেল আড়ালে। কংগ্রেস বলল, দেশটা এক জাতির, লিগ বলল, সেটা সত্য নয়, দেশ দুই জাতির। এক ও দুইয়ের হট্টগোলে সতের জাতি হারিয়ে গেল। কমিউনিস্ট পার্টি সতের জাতির কথা বলেছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও লিগের যৌথ তৎপরতার কারণ ওই সত্যটিকে সামনে নিয়ে আসতে পারেনি।

   

শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না কবি হেলাল হাফিজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

 

‘আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর…’

‘হৃদয়ের ঋণ’ কবিতার কবি হেলাল হাফিজ এখন নিঃসঙ্গ ও একাকী জীবন-যাপন করছেন সবার চোখের আড়ালে।

এখন মোটেও ভালো নেই কবি! সুস্থও নন! কথা বলতে গেলে তাঁর খবু কষ্ট হয়। শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না তিনি! নেত্রকোনা থেকে কবি হেলাল হাফিজকে দেখতে আসা সাংবাদিক আলপনা বেগম বার্তা২৪.কমকে কবির এ অসুস্থতার কথা নিশ্চিত করেন।

আলপনা বলেন, কবিকে দেখার কেউ নেই! ভীষণরকম একাকী আর সবার চোখের আড়ালে বাস করছেন তিনি। রাজধানী ঢাকার শাহবাগ এলাকার হোটেল সুপার হোম নামে আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষে থাকেন কবি হেলাল হাফিজ। হোটেল কর্তৃপক্ষ বিনা ভাড়ায় তাঁকে একটি ভিআইপি কক্ষ বরাদ্দ করেছে। সেখানেই অনেকদিন ধরে নিঃসঙ্গে সময় কাটছে তাঁর।

আলপনা জানান, কবি হেলাল হাফিজ একা একা গোসল করতে পারেন না। তাঁকে গোসল করিয়ে দিতে হয়। হোটেলের এক বয় কবিকে ধরে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে দেন।

কবি বাম চোখে কম দেখতে পান বলে জানান আলপনা। তিনি জানান, কবি বয়সজনিত কারণে শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। বাংলা ভাষার এই কবি গ্লুকোমায় আক্রান্ত। এর পাশাপাশি কিডনি, ডায়াবেটিস ও স্নায়ুরোগেও ভুগছেন তিনি।

রোমান্টিক ও প্রেমের কবিতা লিখেও কবি নিজে সারাজীবন থেকেছেন চিরকুমার!

নেত্রকোনায় বাড়ি কবি হেলাল হাফিজের। সে সূত্রে নেত্রকোনা থেকে আসা সাংবাদিক আলপনার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানালেন, একবার ইচ্ছে আছে, নেত্রকোনায় যাওয়ার। শরীর কিছুটা সুস্থ হলে তিনি সেখানে একবারের জন্যও হলে যেতে চান। দেখতে চান নিজের জন্মভিটা! সবাইকে একনজরও দেখে আসবেন তিনি।

নিজের চিকিৎসার বিষয়ে ভীষণরকম উদাসীন কবি হেলাল হাফিজ। ইতোপূর্বে, বার বার চেষ্টা করেও তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যায়নি।

২০২২ সালে শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হলে কবি হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হয়েছিলেন। ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তিনি। খানিকটা সুস্থ হলে ফের হোটেলে ফিরে আসেন কবি। এর ৪/৫ দিন পর ফের অসুস্থতাবোধ করলে হোটেলের লোকজন তাঁকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যান। তারপর কিছুটা সুস্থ হয়ে আজও শাহবাগের হোটেল কক্ষে একাকী জীবন-যাপন করছেন কবি হেলাল হাফিজ।

বাংলা ভাষার ভীষণ জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁর কবি প্রতিভার পরিচিতি লাভ করে। কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

কর্মজীবনে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য সম্পাদনাও করেছেন কবি হেলাল হাফিজ।

;

চুরুলিয়ার স্মৃতি ও নজরুলের অসাম্প্রদায়িক স্বদেশের অধরা স্বপ্ন



অঞ্জনা দত্ত
নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

(পূর্ব প্রকাশের পর) উপাচার্যের কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অন্য একটি কক্ষে, যেখানে বেশ কয়েকটি আলমারিতে নজরুলের সৃষ্টি সংরক্ষিত আছে। রয়েছে প্রায় চার হাজার গানের স্ক্রিপ্ট। এছাড়া দুটো কলের গান দেখতে পেলাম, যেগুলোতে নজরুল একসময় গান শুনতেন। দু’একটা বাদ্যযন্ত্রও ছিল মনে হয়। কয়েকটা ছবি তুলে রওনা দিলাম কবিতীর্থ চুরুলিয়ার পথে। এর মধ্যে ভদ্রলোক জানিয়ে রাখলেন তিনি চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমিতে বলে রেখেছেন আমাদের কথা, ‘অতএব আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না’।

একাডেমির দেখভাল বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে। চুরুলিয়ায় পৌঁছে অবাক হলাম নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র একজন এখনো জীবিত আছেন, যে কথাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কেউ বলেননি। সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওখানে আমাদের লোক আছে, নজরুল একাডেমি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ইত্যাদি অনেক কথাই জানালেন। অথচ ওখানে যে নজরুল পরিবারের একান্ত আপনজন রয়েছেন সেটি উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গেলেন! এটি জানা থাকলে কুড়ি কিলোমিটারের পথ আমাদের নিকট হয়তোবা দুই কিলোমিটারে দাঁড়াত!

আসানসোল থেকে চুরুলিয়ার পথে একধরনের উত্তেজনা নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপিত নজরুলের স্ট্যাচ্যুর সাথে ছবি নিতে ভুল হলো না। কুড়ি কিলোমিটার খুব বেশি দূর তো নয়। নিমেষেই পৌঁছে গেলাম। দু’জন সাধারণ চেহারা ও বেশভূষার মানুষ আমাদের দেখা মাত্র সাথে নিয়ে একতলা বিশিষ্ট বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। টেবিলের ওপারে বসে আছেন শ্যামল বরণ, বলিরেখামণ্ডিত চেহারা, চশমা পরিহিত প্রায় আশির অধিক বয়েসি এক ভদ্রলোক। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ওটা ঠিক সাদা ছিল না, বহুল ব্যবহারে মলিন হয়ে পড়েছে আসল রঙ। আর চশমার ওপারে চোখ দু’টি কি ঘোলাটে ছিল ? আমাদের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তিনি, কাজী রেজাউল করিম, নজরুলের কনিষ্ঠ ভাই আলী হোসেনের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকার। বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম কাজী রেজাউল করিমের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এঁর কথা কেন কিছু বলা হয়নি। আশ্চর্য!

রেজাউল করিমের সাথে গল্পে জমে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কথাবার্তায় সাবলীল ছিলেন। বয়স তাঁর স্মৃতিশক্তির ওপর এখনো কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই বৎসর ত্রিপুরায় নজরুলের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এই উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। স্মরণিকার জন্য আয়োজকরা পি কে ডি’কে লেখা দিতে বলেছিলেন। ওর লেখা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল প্রায়।

রেজাউল করিম সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে পি কে ডি জানালেন আজকে চুরুলিয়ায় এসে রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলার পর সে ভাবছে তাঁকে আবার নতুন করে লিখতে হবে নজরুলকে নিয়ে। রেজাউল সাহেব জানালেন, আগরতলা থেকে তাঁকেও লিখতে বলা হয়েছে। সুস্থ থাকলে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে ঐ অনুষ্ঠানে। তাঁর নিজের পরিবারের কথা জানালেন। নজরুলের নাতি নাতনিদের কথা বললেন। বলা বাহুল্য সেগুলো খুব প্রীতিকর কিছু নয়। তাঁর নিজের কষ্টের কথা জানালেন। সুবর্ণ কাজী, রেজাউল করিমের তিন পুত্রের একজন, যার মধ্যে তিনি কিছু সম্ভাবনা দেখেছিলেন সংগীতে , তিনি তেমন কিছু করতে পারেননি। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে একজন হলেন সোনালী কাজী। বাকি এক মেয়ে এবং দুই পুত্রের কেউই নজরুলের সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। সংসারের নিয়মই মনে হয় এমন। একজন আয় (সেটি যে কোনোকিছুই হতে পারে) করেন। পরের প্রজন্ম সেটি এনক্যাশ করে চলেন (তবে এক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না কেননা কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ নিজগুণে গুণান্বিত ছিলেন)। আর তৃতীয় প্রজন্ম দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এই ফর্মুলা পুরোপুরি কাজে না লাগলেও নজরুলের আদর্শ থেকে এরা অনেক দূরে। আপাদমস্তক মার্ক্সিস্ট কাজী রেজাউল করিমের চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে উঠল।

এবারে রেজাউল সাহেব আমাদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পাকা একতলা বাড়ি। টিনের ছাউনির ওপর পুরনো বাড়ির অনুকরণে খড় দিয়ে ছেয়ে দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ ক’বছর হলো। যে দুজন আমাদের প্রথমেই তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন তারাই রেজাউল সাহেবের দেখাশোনা করেন। পরিবারটি, অন্তত রেজাউল সাহেব, তাঁর চাচার মতো অসাম্প্রদায়িকই রয়ে গেলেন। আমি বাড়িটি ঘুরে দেখতে চাইলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর এবং বাসনপত্র দেখে অবাক হলাম। কেননা ছেলেরা এল্যুমিনিয়ামের ডেকচি কড়াই এমন পরিষ্কার রাখতে পারার কথা নয়। জানালেন রান্নার জন্য অন্য মহিলা আছে। আর তাঁর স্ত্রী যে ঘরে রাঁধতেন, সে ঘরটিও অবহেলায়, অযত্নে পড়ে নেই।

হঠাৎ রেজাউল করিম সাহেব আমাদের এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি জানতে চাইলেন এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করার পর আমাদের দেশে কীভাবে মৌলবাদের উত্থান হয়? উত্তর দেবার বিশেষ কিছু ছিল না। অথবা বলা ভালো সংক্ষেপে বলার মতো নয় বিষয়টি। তাই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি তাঁর সহচরদের বললেন, আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাতে। সব বলতে নজরুল একাডেমি, লাইব্রেরি, নজরুল যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, তার ভগ্নাবশেষ, পারিবারিক গোরস্থান ইত্যাদি সব দেখিয়ে দিতে। তিনি এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। ও হ্যাঁ, নজরুল একাডেমি-যেটি রেজাউল করিমের বড়ো ভাই প্রয়াত মোফাজ্জল ইসলাম সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেয়ায় তিনি খুশিই হয়েছেন।

‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি...’ কবির বিখ্যাত সেই ছবিতে সাজানো অফিস কক্ষ..

কেননা এটি চালিয়ে নেয়ার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর সন্তানদের এবং নজরুলের নাতি নাতনিদের এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ নেই। আমার মনে হয়েছিল কাজী রেজাউল করিম সাহেব স্বস্তিতে আছেন এই ভেবে যে নজরুল যথার্থভাবে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর একটি ব্যাপার অনেকক্ষণ থেকে আমার মাথায় পাক খাচ্ছিল নজরুলের বাড়ির সীমানা, একাডেমি, বিশাল লাইব্রেরি (যেখানে সতের হাজার বই রয়েছে, এটা পরে হয়েছে), কবরস্থান ইত্যাদি দেখে ভাবছিলাম কেন নজরুলকে বালক বয়েসে বাবাকে হারানোর পরে সংসার প্রতিপালনের জন্য রোজগার করতে যেতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন: কবিতীর্থে একদিন

নয় বছর বয়েসে মক্তব শেষ করার পর ঐ মক্তবে ছোটো শিশুদের তিনি পড়াতেন। মসজিদে আযান দিতেন। যোগ দিলেন লেটো দলে। এটি অবশ্য একেবারে খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল না আমার দৃষ্টিতে। কেননা ঐ সময়ে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা স্ফুরিত হয়। নজরুল নিজেই সংস্কৃত এবং অন্যান্য বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেন। স্কুলে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন। শিক্ষকরা প্রবেশিকা পরীক্ষায় তাঁর থেকে ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলেন। কিন্তু তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজায় নজরুল যুদ্ধ করতে চলে যান। আর স্কুলে ফিরে আসেননি।

আমার মনে হয় প্রকৃতিগত ভাবে নজরুল ছিলেন অতি চঞ্চল। ধরাবাঁধা জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন না। সৃষ্টির নেশা তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াত। সংসারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। বিশেষ করে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান বুলবুলের মৃত্যুর পরে (প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের মাস কয়েক পরে মারা যান) তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। বুলবুল কচিকন্ঠে অপূর্ব সুন্দর গাইতেন। নজরুলের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে গান শেখাবেন। সেই ইচ্ছায় বাধ সাধলেন স্বয়ং ঈশ্বর।১৯৩০ সালের মে মাসে বুলবুল না ফেরার দেশে চলে যান। বারো বছর পরে ১৯৪২ সাল হতে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। লেখালেখি করার ক্ষমতা সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল ! বুলবুল মারা যাওয়ার পর কবি ছেলের স্মৃতিতে লিখেছিলেন ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি …’!

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই বাবরি দোলানো ঝাঁকরা চুলের নজরুল ধীরে ধীরে অপস্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলেন। কবি বুঝতে পারেননি তিনিও ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

কবি তাঁর ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছিলেন-
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”

চিরকালের অসাম্প্রদায়িক নজরুল, যিনি সবসময় লড়াই করেছিলেন মানব ধর্মের জন্য; তিনি জানলেন না তাঁর দেশ বিভক্ত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল দুই সম্প্রদায়ের লোক। এই বিভাজন নজরুল মেনে নিতে পারতেন না জেনেই বিধাতা হয়তো বা তাঁকে বহু আগে থেকেই বাকশক্তি রহিত করে রেখেছিলেন। কে জানে!

নজরুলের এই কথাগুলো আজকের বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। যে স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, সেটি ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক, যাঁর এক ডাকে মুক্তিকামী বাঙালি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। তবে এই দেশের মাটিতে মীরজাফরদের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল সাগরসম রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহিদ, চার লক্ষাধিক মা-বোনের নৃশংস অত্যাচার নির্যাতন ঘটিয়েছিল এই দেশের মীরজাফররা পাকিস্তানি সেনাদের মাধ্যমে। আর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। দেশের এই অপশক্তিরা ঝাড়েবংশে বেড়ে চলেছে। একজন নজরুলের আবির্ভাব কী তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নকে, লড়াইকে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে? (সমাপ্ত) 

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

ফিউচার প্ল্যান



শরীফুল আলম। নিউইয়র্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফিউচার প্ল্যান

ফিউচার প্ল্যান

  • Font increase
  • Font Decrease

কখনো কখনো সমুদ্রের কাছে গিয়ে আমি হারিয়ে যাই
কখনো শিল্পীর আঁকা ছবির কাছে
আমি স্নিগ্ধ আকাশের কাছে গিয়ে উড়িয়ে দেই
আমার সমস্ত বিষণ্ণতা
আমি মেঘের আস্তরে ঢেকে রাখি আমার সুখ , আমার মুখ
আমার সজিবতা ।

ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আস তুমি শেষ বিকেলে
অদ্ভুত সুখ তখনও বিরাজ করে এই আত্মায়
পলাতক শব্দ গুলো শিশিরের ন্যায়
আধো আধো প্রেমের ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে ।

একটা সুদীর্ঘ সময়ের সমাপ্তি করলে তুমি ,
সেই পুরনো রাত , পুরনো দিন
মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আস তুমি
অনেকটা জোনাকির ছলে ।

তুমি এক আলৌকিক আগুণ
তুমুল পোড়াও তুমি আমাকে
কখনো স্বপ্নের ভিতর
কখনো পিয়ানোর সানাই হয়ে
তুমি নিত্য পরিক্রমা এই মনে ,
তোমার ঠোসকা পড়া তেরছা কথা
"ডাকলেও আর আসবো না "
শুনতে বড় বেখাপ্পা লাগে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা তখন মনে পড়ে যায়
ঝড় , ঝঞ্ঝার কথা তখন মনে পড়ে যায়
প্রকৃত প্রস্তাবে তখন তোমার বিবর্তনের কথাই মনে পড়ে যায়
আর বিবর্তন মানে - আড়াল রাখতেই সে পছন্দ করে
ফাগুনে আগুণ লাগাতেই সে পছন্দ করে
তার সানগ্লাস তখন যেন থেমে যায় গ্ল্যালাক্সি ক্রসিংয়ে
আড়চোখ দেখে নেয় সব
বিলম্বিত লাবণি , ফিউচার প্ল্যান ।

;

কবিতীর্থে একদিন



অঞ্জনা দত্ত  
-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধূর ধূপ!’’

অনেক ছোটোবেলায় যখন এই কবিতাটি পড়ি তখন কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। সেদিনের সেই অনুভূতি আজও মনে আছে। কেননা কবি তখন বাকরহিত ছিলেন। সেই ছোটো বয়েসেও অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, তিনি কীভাবে বুঝেছিলেন একদিন তাঁর এমন পরিণতি হবে? সত্যি বলতে আজও এর উত্তর খুঁজে পাইনি। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ দু’জনের ওপরেই ছিল সরস্বতীর আশীর্বাদ। সেই অর্থে তাঁদের ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। তবে ছিলেন স্বশিক্ষিত। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক আবহ ছিল সংস্কৃতি চর্চায় পরিপূর্ণ। নজরুলও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর চাচা বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল অপরিসীম। চাচার প্রভাবে নজরুল লেটো দলে যোগ দেন এবং অতি স্বল্প সময়ে তিনি নিজের প্রতিভায় অন্যদের মুগ্ধ করেন। কবিতীর্থ সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে জানাতে চাই কীভাবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার প্রোগ্রাম হলো ?

এই বছর জানুয়ারি মাসের শেষদিকে কলকাতায় এক বিয়ের প্রোগ্রামে যেতে হচ্ছিল। সবসময়কার মতো কোথাও যাওয়ার নামে ঢোলে বাড়ি বাজলে আমার মন নেচে উঠে। কিন্তু যতই যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে ততই মনে হয়, ধুর না গেলেই ভালো হতো। কিন্তু ততদিনে ‘পি কে ডি’র প্ল্যান পেকে টসটসে হয়ে উঠে। অর্থাৎ টিকেট কাটা, থাকা, গাড়ির ব্যবস্থা করা সব কমপ্লিট। অতএব ব্যাগ গোছাতে হয় হাঁড়িমুখে। তবে যখন চাকরিতে ছিলাম তখন বেড়ানোর কথা হলে মন ময়ূরের মতো নেচে উঠত। সেই সময়টায় ছুটি পেতে নানারকমের ঝঞ্ঝাট পোহাতে হতো। আদম সন্তান! সহজলভ্য জিনিসের চেয়ে যেটি পেতে অসুবিধে হবে সেদিক পানে মন ছুটে যেত। ‘পি কে ডি’ দেখল কলকাতায় শুধু বিয়ে খেতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এরসাথে আর কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে বেশ হতো। আমার তো কলকাতায় যাওয়ার ইচ্ছেই নেই। তাই আর কোথায় যেতে চায় সে বিষয়ে কোনো কৌতূহল ছিল না। জানি মোগলের হাতে যখন বাবা সঁপে দিয়েছেন, তখন খানাটা তার সাথেই খেতে হবে।

অন্য কথা শুরু করার আগে ‘পি কে ডি’র নামের অর্থটা জানিয়ে দেয়া উচিৎ বলে মনে করি। কেননা লেখালেখির প্রথম জীবনে পাঠকদের মধ্যে একধরনের ঔৎসুক্য থাকত এই নাম নিয়ে। পি কে ডি, প্রদীপ কুমার দত্ত, যার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছি (‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’… তবে জানিয়ে রাখি এই গাঁটছড়ায় অন্য অনেক কিছুই আছে, সুর ছাড়া। কখন আপনারা আবার গান শোনার আবদার করে বসেন!)

তাঁর অন্যতম নেশা হলো বেড়ানো। অন্য স্ত্রীরা আনন্দে বাক বাকুম করত, সেখানে আমি মুখখানা বাংলা পাঁচের মতো করে রাখি, ঐ যে বললাম না সহজে পাওয়া জিনিসের কোনো মর্যাদা থাকে না! আর বাংলা পাঁচের সাথে অপ্রসন্ন চেহারার তুলনা যে কোন পণ্ডিত করেছেন জানি না। মানুষের চেহারা কখনও বাংলা পাঁচের মতো দেখাতে পারে, বলুন?

পি কে ডি ঠিক করলেন কলকাতার বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে দেওঘর, রামপুরহাট আর আসানসোল যাবে। দেওঘরের নাম আপনারা পড়েছেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে, যিনি তাঁর গল্পের কোনো চরিত্রের অসুখ করলেই হাওয়া বদলের জন্য দেওঘরে  পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু যখনই শুনলাম ঐ সময়ে দেওঘরে ভালোই শীত থাকবে, মেজাজ সপ্তমে পৌঁছাতে মোটেই সময় নিল না। এর মাস দুয়েক পূর্বে নৈনিতাল এবং আশেপাশের হিমালয়ের অঞ্চলসমূহে বেড়িয়ে এমন ঠাণ্ডায় ভুগেছিলাম, এরপরেও শীতের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে! মেজাজ কেন খারাপ হবে না বলুন? কে জানে পি কে ডির মনে কী আছে? সাধারণত বলা হয়ে থাকে স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটাই স্বাভাবিক। নারীদের হাতে ক্ষমতা থাকলে তাঁরা বলতেন পুরুষাণাং চরিত্রম দেবী ন জানন্তি, কুতো মনুষ্য! তবে আপনারা এইটি কোথাও ব্যবহার করবেন না। ইহা অধমার মস্তিষ্কপ্রসূত! দেওঘর হাওয়া বদল ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য তীর্থস্থানও বটে। রামপুরহাটও তাই। আর আসানসোল? যখন জানাল চুরুলিয়ায় যাবে, অমনি মেজাজ পঞ্চমে নেমে এলো। আর দেওঘরের শীতের হাওয়া নাচতে শুরু করল আমলকির ডালে ডালে।

কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম, লেখক ও পি কে ডি (প্রদীপ কুমার দত্ত)। ছবি: লেখক

সত্যি বলতে কি চুরুলিয়ায় গিয়ে বিশেষ কিছু দেখতে পাবো সেটি ভাবিনি। ভেবেছিলাম আমাদের দুখু মিয়া তো সেই কবে থেকেই দুঃখের সাগরে ভাসছিলেন। তাঁর সাথে আমরাও ভাসছিলাম বুকের গভীরে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে। একজন মানুষ এক জীবনে এতটা কষ্ট পেতে পারেন? এমন একটা প্রতিভা এভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল শুধুমাত্র সময় তাঁকে অবজ্ঞা করায়। তা না হলে আর কী বলা যেতে পারে? যদি নজরুল যুদ্ধের দামামার ভিতরে অসুস্থ না হয়ে আরও বছর কয়েক পরে অসুস্থ হতেন তাহলে হয়তো বা তাঁকে সুস্থ করা যেত। আর একেবারে তিনি যদি এই দুরারোগ্যে আক্রান্ত না হতেন, তা হলেই বা সংসারে কার কতটা ক্ষতি হতো? এই কথাগুলো অনেকের কাছে যেমন অর্থহীন মনে হবে, তেমনি অনেক নজরুলপ্রেমীর বুকের ভিতরটা চুরচুর করে ভেঙে পড়ে!

দেওঘর রামপুরহাটে দেবী দর্শন করে মনে হয় ভালোরকমের পূণ্য সঞ্চয় করেছিলাম। কেননা আসানসোল স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পর এক সুবেশধারী ভদ্রলোক আমাদের নিতে এলেন ততোধিক ঝকঝকে জীপ নিয়ে। এই লিঙ্কগুলো পি কে ডির রোটারির কানেকশনে। রোটারিয়ান হওয়ার এই এক সুবিধে।  পৃথিবীর যে কোনো দেশে রোটারিয়ানরা ফেলোশিপের হাত বাড়িয়ে দেয়। পূর্ব পরিচিতির প্রয়োজন নেই। অভিষেক তেমন একজন রোটারিয়ান, যাকে তাঁর সিনিয়র একজন বলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক রোটারিয়ান যাচ্ছেন তোমার শহরে। Help him with what he needs, ব্যস এটা তাঁর জন্য বেদবাক্য হয়ে গেল!

অভিষেক অবাঙালি। বাংলা বলতে পারেন। বয়েস বড়োজোর পয়ঁতাল্লিশ – পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাবা মা দু’জনেই আছেন। বহু বছর ধরে তাঁরা আসানসোলে বসবাস করছেন। কিন্তু পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল শহর থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে চুরুলিয়া সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারলেন না। তবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার জন্য নিজেদের একখানা গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন পরদিন সকালে। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি অভিষেক আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে আসানসোল ক্লাবে পৌঁছে দিল। নিজের কিছু কাজ সারতে চলে গেল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল ড্রাইভার এসে আমাদের নিয়ে যাবে ওদের বাড়িতে লাঞ্চ করার জন্য। তবে ঘন্টা দু’য়েক পরে নিজেই এসে হাজির ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। মা বাবা এবং অভিষেকের স্ত্রী সবাই অপরিচিত অতিথিদের সাথে বহুদিনের পরিচিতের ন্যায় আচরণ করলেন। সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন।

লাঞ্চ সেরে পি কে ডি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন মাইথন বাঁধ (Maithon Dam) দেখতে যেতে চায়। আমার ভালো লাগত একটু যদি বিছানায় গড়িয়ে নেয়া যেত। কিন্তু বেড়াতে বের হলে এটি পি কে ডি’র অভিধানে থাকে না। তাঁর হলো কম সময়ে কত বেশি দেখা যায় অথবা কতবেশি জানা যায়? আমি নিতান্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতার রক্তমাংসের মানুষ। সকালবেলায় ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়েছিল। কাজেই রাতের ঘুমের কোটা যেটুকু অপূর্ণ ছিল, সেটুকু পুরিয়ে নিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু এত বছরে এইটুকু বুঝেছি সব ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতে নেই। তাছাড়া অভিষেক ইতিমধ্যে ওদের ক্লাবের কয়েকজন রোটারিয়ানের সাথে কথা বলে সন্ধ্যেবেলায় একটা ফেলোশিপ মিটিং এর আয়োজন করেছে। রোটারিতে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা মিটিং হয়। অভিষেকদের মিটিং হয়ে গিয়েছিল। অভিষেক চাইছিল আমিও যেন মিটিং এ যাই। তাহলে ওর স্ত্রীও যাবে। অগত্যা।

অভিষেকদের একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম মাইথন বাঁধ দেখতে। কাপ্তাই বাঁধে যে স্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, সেটি দেখেও যখন পি কে ডির আশ মিটেনি তখন সাথে যেতেই হলো। তবে এই বাঁধটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র হলো মাটির নিচে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটিই প্রথম  ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ তৈরির স্থাপনা। এটি ষাট হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। ১৯৫৭ সালে উদ্বোধন হয় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। বিছানা তখন দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে আয় আয় আমার কাছে আয়। সে ডাক কি উপেক্ষা করা যায় ? পাগল!

খুব বেশিক্ষণ অবশ্য বিছানার সাথে মিতালি করা গেল না। মিটিং এ যাওয়ার জন্য উঠতে হলো। ড্রাইভার আমাদের সাথেই ছিল। হঠাৎ করে ডাকা মিটিং এ রোটারিয়ানদের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। বেশি ছিল আন্তরিকতা আমাদের প্রতি তাঁদের। দুই ক্লাবের পতাকা বিনিময় হলো। পি কে ডি তাঁর নিজের ক্লাব নিয়ে এবং দেশ নিয়ে কথা বলল। ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। ভারতের বাইরের দেশগুলোকেও অচ্ছ্যুত রাখল না। অনেক কথাই হয়েছিল। সাথে খাবার দাবার তো ছিলই। একসময় মিলনমেলা ভাঙলো। ফেরার পথে অভিষেক জানাল পরদিন সকালে আসানসোলে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। এতক্ষণ আপনারা ধান ভাঙতে শীবের গীত শুনেছেন। এবারে  মূল প্রসঙ্গে আসি। যে কারণে আসানসোল আসা।

কবির পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রের পাশে লেখক; যেখানে প্রমীলা নজরুলসহ স্বজনদের কবর রয়েছে।

লেখার শুরুতেই বুঝে নিয়েছেন বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি, দুঃখী মানুষদের কবি, ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এতদূর আসা। কলকাতা থেকে আসানসোলের দূরত্ব ২১৩ কিলোমিটার। সড়কপথে বা রেলপথে যাওয়া যায়। আর আসানসোল থেকে চুরুলিয়া মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে। আমরা বাঙালিরা শান্তিনিকেতনে দৌড়ে যেতে (বারণ করছি না যেতে) যত পছন্দ করি, ততোটা কি চুরুলিয়ায় যাওয়ার কথা ভাবি ? নজরুল জীবিত থাকা অবস্থায় ছিলেন অবহেলিত, অসুস্থ অবস্থায়, ঢাকায় আসার আগে কেমন ছিলেন জানা নেই, তবে মৃত্যুর পরে যে আমাদের স্মৃতিতে ধুলো বালি জমতে শুরু করেছে সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

অভিষেক জানিয়েছিল আসানসোল শহর থেকে অদূরে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ওখনে হয়তো বা কোনো তথ্য পেতে পারি। রওনা দিলাম সেদিকে। যেহেতু পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে এসেছি উপাচার্য মহাশয়ের সাথে দেখা করতে তাই জায়গায় জায়গায় এখানে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে হচ্ছিল। অবশেষে উপাচার্য মহাশয়ের কক্ষে ডাক পড়ল। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে  প্রীত হলেন মনে হলো। তাঁর মামাবাড়ি একসময় চট্টগ্রামে ছিল। তাঁকে চট্টগ্রামে  আমাদের অতিথি হয়ে আসতে আমন্ত্রণ জানালাম। চুরুলিয়ায় যেতে চাই শুনে তিনি আরও উৎসাহিত বোধ করলেন। সাথে সাথে তাঁর ইউনিভার্সিটিতে যিনি  নজরুল সক্রান্ত কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। জানা  গেল তিনি সেদিন , অন্তত তখনও এসে পৌঁছাননি। অন্য আর একজনকে খবর পাঠিয়ে আনালেন। তাঁকে আমাদের পরিচয় জানিয়ে বললেন কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁদের যে মিউজিয়াম রয়েছে তার কার্যক্রম দেখাতে। তবে নতুন একটি মিউজিয়াম নির্মাণের পথে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল চুরুলিয়ায়। তবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্য সরকার (সি পি এম) এটি আসানসোলে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ভেবেছিলেন চুরুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে ওখানে ছাত্র সংখ্যা খুব বেশি হবে না। তাছাড়া ছাত্রদের জন্য হোস্টেল নির্মাণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ অনেক বেড়ে যাবে। এখনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন /চার সহস্রাধিক ছাত্র ছাত্রী পড়ছে। বাইশটি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। চুরুলিয়ায় গিয়ে আমাদেরও মনে হয়েছিল সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। উপাচার্য মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার আগে তাঁর সাথে ছবি তুলে নিলাম। ঐ সময়ে তাঁর সেলফোনে রিং বেজে ওঠায় অভদ্রতা হলেও ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ গেল। দেখতে পেলাম ‘সোনালী কাজী ইজ কলিং’। কথা সেরে স্যার জানালেন নজরুলের নাতনি ফোন করেছিলেন। মনে মনে বললাম ও আমার দেখে নিয়েছি! যদিও সোনালীর নাম আগে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ে না। (ক্রমশ…)

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;