বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বসাহিত্যে দেশভাগ যেন ট্রাজিক অভিজ্ঞতা। ১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত ভাগ নতুন দুটি দেশের গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত পরিবার পারস্পরিক গৃহবিনিময় করে উভয় রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করলেও অধিকাংশ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় বাস্তবতার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেককে চলে যেতে হয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে। হাসান আজিজুল হকের মতো অনেকককে ভারত ছেড়ে আসতে হয় বাংলাদেশে। এই জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতের রক্তক্ষরণ, নির্মম সময়ের দাগ আমাদের বাংলা সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে। গল্প, উপন্যাস এবং কবিতা সবক্ষেত্রে। কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো, খাজা আহমেদ আববাস, ভীষ্ম সাহানী, খুশবন্ত সিংরা যেভাবে উর্দু এবং হিন্দিতে এই বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন, তা বাংলা সাহিত্যেও এসেছে। এসেছে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক হর্ষ দত্ত যখন প্রশ্ন করেন, “নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোঁয়া রয়ে গেছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টা ঘুরেফিরে এসেছে?” সুনীল তখন উত্তর দেন, “দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সবসময় মনে পড়ে। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এত বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।”

গৌর কিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’, মনোজ বসুর ‘ইয়াসিন মিঞা’, এস এম বজলুল হকের ‘ভাগ না দিয়ে ভাগানো’, অঞ্জলি দেবীর ‘নবীন আশার খড়গ’, অপূর্ব কুমার মৈত্রের ‘স্বাধীনতার ব্যথা’, নরেন্দ্র দেবের ‘চলচ্চিত্র’, সুমথনাথ ঘোষের ‘উদ্বাস্তু’, হরি নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পুনশ্চ’, ‘ইতিহাস’ ও ‘লাঠিয়াল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিক পাত্র’ ও ‘সড়ক’, ফণীন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘গোপাল উড়ের লেন’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’, সমরেশ বসুর ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেডমাস্টার’ ও ‘পালঙ্ক’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘নেহায়েৎ গল্প নয়’, নূর আলীর ‘মোহাজের’, বেগম হাশমত রশীদের ‘ফরিয়াদ’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ছুরি’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্বেতকমল’ ও ‘অধিকার’, প্রতিভা বসুর ‘দুকূল হারা’ ও ‘অপরাহ্ণে’ ইত্যাদি দেশভাগের গল্প।

স্মৃতি’ আর ‘নতুন অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন’—এই দুটি মাত্রায় দেশভাগের সাহিত্য বিকশিত। দেশভাগের সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে এই স্মৃতি আর ফেলে আসা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। দেশভাগের এই গল্প সংকলনে অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ভিটেমাটির রূপকথা’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘দেশভাগের পর’, জাফর তালুকদারের ’পিতৃভূমি’, জীবন সরকারের ‘কোষা’, দেবেশ রায়ের ‘উদ্বাস্তু’, প্রতিভা বসুর ‘দু’কূল হারা’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মোজাহের’ মিহির মুখোপাধ্যায়ের ‘বাঙলাদেশ’, মিহির সেনগুপ্তের ‘পিতামহীর স্বদেশযাত্রা’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’, সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’, জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, প্রফুল্ল রায়ের ‘রাজা যায় রাজা আসে’, বনফুলের ‘দাঙ্গার সময়’, ইসহাক চাখারীর ‘রায়ট’ প্রভৃতি গল্পের নামই যেন দেশভাগের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিতবাহী।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প

এছাড়া ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিকপাত্র’, কৃষণ চন্দরের ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর ‘যে তোমায় ছাড়ে’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পালঙ্ক’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দোসর’, বিমল করের ‘অন্তরে’, শওকত ওসমানের ‘আলিম মুয়াজিজন’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘তোমার উদ্দেশ্যে’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, সাদত হাসান মান্টোর ‘শরিফান’, সমরেশ বসুর ‘আবাদ’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘নেড়ে’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জুয়া’, প্রভৃতি গল্পে দেশভাগের পূর্ব ও পরেকার নানাবিধ মানসিক ও মানবিক সংঘাত, সংঘর্ষ, হাহাকার ফুটিয়ে তুলেছেন লেখকরা।

তবে বাংলাদেশের সাহিত্যে এ বিষয়ে কম লেখা হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া এবং দেশভাগের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এটিই স্বাভাবিক। দেশভাগের পর উপন্যাস পেতে আমাদের ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। ওপার বাংলার আরো কয়েকটি উপন্যাস হলো—অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, শক্তিপদ রাজগুরুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’, সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’।

“১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ হলে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠল। বাঙালি মুসলমান লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলেন। বলা বাহুল্য, তাঁরা বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ধারার উত্তরাধিকারটিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এবার তাঁদের নবযাত্রা শুরু হলো।” (বাংলাদেশের ছোটগল্প, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৯, পৃ. ছয়)

দেশভাগ নিয়ে ঢাকায়, সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্রে অনেকেই উপন্যাস লিখেছেন। কলকাতা থেকে ফিরে সাহিত্যের যে নবযুগের সূচনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ঔপন্যাসিক হলেন—আনোয়ার পাশা, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল ফজল, আবু ইসহাক, সত্যেন সেন, রাজিয়া খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েনউদ্দীন। এদের উপন্যাসে দেশবিভাগ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ও কাহিনীর মৌল বিবেচ্য হয়েছে। পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী ও সেলিনা হোসেনের উপন্যাসেও দেশবিভাগের ইতিহাস-অভিঘাত রূপায়িত হয়েছে।

আরো পড়ুন ➥ শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’

প্রথম দিকের উপন্যাসে দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা, বাস্তুচ্যুতির জন্য বেদনাবোধ, স্মৃতিকাতরতা ও ভয়ার্ত অস্তিত্ব-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত লেখকদের উদারনৈতিক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডকুমেন্টিরির মতো করে দেশভাগের ঘটনার উপস্থাপন করা হয়েছে। তারপর কালে কালে তার বিস্তৃতি ঘটেছে। সেই ষাটের দশকের লেখক যারা, তারা এই এত বছর পরে এসেও যখন দেশবিভাগ নিয়ে উপন্যাস লিখেন, সেখানেও দেশবিভাগের অনিবার্য অভিঘাত চিত্রিত হয়। এর নিকতম উদাহরণ হলো ২০১০ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘আগুনপাখি’।

পঞ্চাশের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৯৪৩ থেকে দেশবিভাগ (১৯৪৭) সময়বৃত্তে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের কাহিনী বিন্যস্ত। আবু ইসহাকের মুখ্য অভিনিবেশ ছিল জয়গুনকেন্দ্রিক নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রামের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা। উপন্যাসের সূচনায় আছে মন্বন্তরের প্রসঙ্গ। দুর্ভিক্ষতাড়িত মানুষ স্বপ্ন দেখেছে, দেশ স্বাধীন হলে চালের দাম কমবে। দেশ একদিন স্বাধীন হয়। কিন্তু জয়গুনদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার হয় সমাধি। তাদের ভিটা থেকে আবার উচ্ছেদ হতে হয়। দেশবিভাগ অসংখ্য মানুষকে উদ্বাস্তু করেছিল। সেই বাস্তবতার পরিবর্তে পাকিস্তান রাষ্ট্রে জয়গুনদের নিরাশ্রয়তার নির্মম আলেখ্য রচিত হয় কাহিনীতে।

আবুল ফজলের ‘রাঙ্গাপ্রভাত’-এ দেশভাগ, পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংকট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা প্রকাশিত হয়েছে।

রাজিয়া খানের ‘বটতলার উপন্যাস’-এ দেশভাগজনিত সংকট এবং উপমহাদেশের বিশাল ভৌগোলিক পরিসরে চরিত্রপাত্রের জটিল সমস্যার বিন্যাস দেখানো হয়েছে। মঈনের স্বদেশ উন্মূলিত বাস্তবতা দেশভাগজনিত। তার ব্যক্তিজীবনের স্বপ্ন, প্রেম, এমনকি পারিবারিক পরিবেষ্টনীকে বিপর্যস্ত করেছে দেশভাগ। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরও মঈন কলকাতার মেয়ে সুমিতার প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব করেছে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাধারায় সেই অনুরাগ শেষ পর্যন্ত নতুন রাষ্ট্রের জটিল পরিস্থিতিতে শুভ পরিণতিতে উপনীত হতে পারেনি।

শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ১৯৩৮ থেকে ১৯৫১ কালপর্বের কাহিনী। দুটি গ্রাম বাকলিয়া ও তালতলী প্রধান হলেও কলকাতা ও ঢাকার পটভূমিও উপন্যাসটির ঘটনাধারায় বিস্তৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধোত্তর কলকাতার দাঙ্গা, দেশবিভাগের পর বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের পথপরিক্রমায় এগিয়ে গেছে ‘সংশপ্তক’-এর কাহিনী।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’ উপন্যাসের কাহিনী পরিব্যাপ্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। কবি রহমতের স্মৃতিকথার মধ্য দিয়ে দেশভাগ ও দেশবিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্মোচিত হয়েছে। স্বপ্নের ভূখণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক হায়াত খাঁ টঙ্গী সোনারগাঁ জুট মিলে শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণকালে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। অনেক সূর্যের প্রত্যাশায় লালিত ভূখণ্ডের এ বেদনার স্বরূপ নির্দেশের মধ্য দিয়েই উপন্যাসের সূচনা। দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নকল্পনা ও ভাবাবেগ কিভাবে বারবার বিচ্যুত হয়েছে তারই পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা উপন্যাসটির গভীরে প্রোথিত।

আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র কাহিনী শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালে এসে। এরপরই দেশভাগ থেকে শুরু হয়েছে ‘সংকর সংকীর্তন’-এর ঘটনা। কলকাতা ও তার আশপাশের পটভূমিতে প্রধান চরিত্র মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের জীবন চিত্রিত হয়েছে এখানে। তবে ফরাজি আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত এ উপন্যাসের ঘটনা। ব্রিটিশদের স্বার্থচালিত শোষণ-প্রক্রিয়া ও দ্বিজাতিতত্ত্ব উদ্ভাবনের মনস্তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। মূলত ‘ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ এবং ‘সংকর সংকীর্তন’ এই তিনটি উপন্যাসে একটি পরিবারের যোগসূত্রে বাঙালি মুসলমানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন। সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ ও তিন খণ্ডের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’য় দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবন ও তেভাগা প্রসঙ্গের রূপায়ণে পরোক্ষভাবে দেশভাগের প্রসঙ্গ রেখায়িত। মূলত ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন কালানুক্রমিক ঘটনাধারায় আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদী আদর্শ এবং প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক জীবনবোধের বিকাশ ঘটে।

তিনটি স্মৃতিকথা

মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’, সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ এবং সীমা দাশের ‘দ্যাশ থেকে দেশে’ বই তিনটিতে আমরা দেশভাগের স্মৃতি দেখতে পাই। বিষাদবৃক্ষ লেখার আগে মিহির সেন গুপ্ত আরো তিনটি বই লিখেছিলেন, যদিও তার কোনোটারই বিষয় দেশভাগ ছিল না। চতুর্থ বইতে রচনাশৈলীতে অবশ্য তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়। বরিশালের প্রান্তিক গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারে লেখকের জন্ম। মিহির লিখেছেন, “আমার আলেখ্যর জন্যে সময়কাল হিসেবে আমি ন্যূনাধিক দশ বছরের মতো একটা পরিসর নিয়েছি। সেই দশ বছরের সময়কালটি উনিশশো একান্ন-বাহান্ন থেকে উনিশশো বাষট্টি-তেষট্টি পর্যন্ত বিসত্মৃত।” তাঁর বাড়ির পেছনদিকে ছিল একটা সরু খাল। “দুপাশের বাড়িঘর, আগান-বাগানের মাঝখান দিয়ে তার গতি লীন হতো গিয়ে বড় খালে। বড় খালটিও ওইরকমভাবে গিয়ে পড়ত নদীতে।” বাড়ির পেছনের এই ছোট খালটিকে লেখক তাঁর বরিশালি ভাষায় বলেছেন, ‘পিছারার খাল’। মিহিরের বর্ণনায়—“এই খালটি আমাদের বড় আত্মীয় ছিল।” এই পিছারার খালটিকে ঘিরে কতগুলো হিন্দু পরিবারের ক্রমবর্ধমান আর্থিক অবনতি, আঁকড়ে থাকা জমিদারি ঠাঁটবাট, সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলা, মুসলিম তালুকদার ইত্যাদি শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি মিহির বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশেষত আমাদের পরিবারের বা তার থেকেও ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে যেসব মধ্যস্বত্বভোগী আছে তাদের সমূহ সংকট। তাদের মধ্যস্বত্বের খাজনার পরিমাণের ব্যাপারটা অঙ্কে আসে না। কিছু খাসজমির উপজ তাদের বাঁচিয়ে রাখে।… এই খাসজমি যদি তারা নিজেরা চাষ করে তবুও কথা ছিল। কিন্তু তা কী করে হবে? তারা যে জমিদার। জমিদার জমি চষে না। প্রজাপত্তনির প্রজারাই তা চষে। জমিদার ফসলের ভাগ পায়। এই ব্যবস্থার জন্যে যখন প্রজাপত্তনি, মধ্যস্বত্ব যায় তখন খাসজমিও যাবার রাস্তা ধরে…।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

লেখক সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছেন পূর্ববাংলায় দেশভাগের পক্ষে বাতাবরণ তৈরির মূলে ছিল জমিস্বার্থ। জমির মালিকানার হ্রাস-বৃদ্ধি যে কিভাবে পূর্ববাংলার হিন্দু ও মুসলিম মানসিকতা প্রভাবিত ও চালিত করেছিল তার যথাযথ বিবরণ আছে মিহিরের বিষাদবৃক্ষে। তিনি লিখেছেন, “পিছারার খালের চৌহদ্দিতে যেমন, গোটা পূর্ব বাংলায়ও তেমনি, সামন্তশ্রেণী বলতে হিন্দু সামন্তদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু তা ছিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর সামগ্রিক হিসেবে। তার অর্থ এই নয় যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জমিদার বা অন্য মধ্যস্বত্বভোগীরা সাধারণ এইসব মানুষকে শোষণ বা নির্যাতন করত না। আমার পরিমণ্ডলে আমি অনেক তথাকথিক তালুকদার দেখেছি যারা সাম্প্রদায়িকভাবে মুসলমান এবং শ্রেণীশোষণ বা নির্যাতনে ওখানকার হিন্দু জমিদার বা তালুকদারের তুলনায় কিছুমাত্র ভিন্ন নয়। সেক্ষেত্রে লিগপন্থীরা সাধারণদের বুঝিয়েছিল যে পাকিস্তান কায়েম হলে সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ হবে এবং অবস্থাপন্নদের সংযত রাখার জন্যে ইসলামি বিধি মতে ‘জাকাত’, ‘খয়েরাত’ ইত্যাদি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু পাকিস্তান কায়েম হবার পর এমনকি মধ্যস্বত্ব প্রথা উচ্ছেদ হবার পরও এই প্রতিজ্ঞা পালনের কোনো প্রচেষ্টাই হয়নি। না হওয়ার কারণটিও অবশ্য শরিয়তি ব্যবস্থার অন্তর্গত, অন্যের ‘হক্কের সম্পত্তি’ দখল করা না-জায়েজ, হারাম—এমত নির্দেশ। সে সম্পত্তি হিন্দুর হলে জায়েজ এবং মুসলমানের হলে না-জায়েজ, এসব বিতর্কে তখন অন্তত কেউ যাননি…।”

আরেক জায়গায় মিহির লিখেছেন, “আশেপাশের মুসলমান গ্রামগুলিতে যথেষ্ট উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবার বিশেষ ছিল না। মাঝারি মাপের যারা তারাই এখন সব ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পদ নিয়ে নিজেদের ঘর এবং জীবন সাজাতে চেষ্টা করছে। এই সময়টা থেকে বড়, মাঝারি এবং কিছু ছোট কৃষক পরিবারও ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তির পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনায় বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠে। রাতারাতি তাদের বাড়ি-ঘরদোরের চেহারা বদলে যেতে থাকে এবং তারা বেশ হোমড়াচোমড়া হয়ে দাঁড়ায়।” অন্যদিকে, “পিছারার খালের আশেপাশের হিন্দু সমাজটি তখন একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। ফলে অবশিষ্ট হিন্দু অধিবাসীদের মধ্যে একটা নৈতিক অধঃপতন আস্তে আস্তে পরিলক্ষিত হতে থাকে। পারিবারিক শাসন আলগা, অভিভাবকেরা উদাসীন, ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, বিবাহের বয়স অতিক্রান্ত মেয়েদের বিয়ে-থা দেওয়া হচ্ছে না। সে এক মাৎস্যন্যায়ী অবস্থা।”

বিদ্বজ্জনরা বিভিন্ন নিবন্ধে দেখিয়েছেন, পূর্ববাংলায় নিম্নবর্গীয় ও নমঃশূদ্ররা বরাবরই ছিল একটি দোদুল্যমান শ্রেণি। নিম্নবর্গীয় পরিচিতি সত্তা হিন্দু বা মুসলিমের সত্তা থেকে স্বতন্ত্র—এরকম একটা বোধ বরাবরই তাদের মধ্যে অটুট ছিল। তারা কখনো দাঁড়িয়েছে মুসলিমদের পাশে, কখনো হিন্দুদের। দেশভাগের প্রাক্কালে মুসলিম লিগের বন্ধু হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল হয়ে উঠেছিলেন নমঃশূদ্রদের অবিসম্বাদী নেতা। পরবর্তীকালে জিন্নাহর প্রথম সরকারে পূর্ববাংলা থেকে আমন্ত্রিত একমাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ১৯৫০ সালেই অবশ্য যোগেন্দ্রনাথ জিন্নাহর মন্ত্রিসভায় তিনি যে কতটা অবহেলার পাত্র তা বুঝে যান এবং একটি দীর্ঘ পদত্যাগপত্র লিখে ভারতে চলে আসেন। তা সত্ত্বেও অনেকদিন পর্যন্ত নিম্নবর্গীয়দের ধারণা ছিল, মুসলিম দাঙ্গাবাজরা তাদের স্পর্শ করবে না। কিন্তু যেখানে জমিস্বার্থই প্রধান এবং রাষ্ট্র যখন সরাসরি মদদ ও প্রশ্রয় দিচ্ছে তখন নিজেদের আর কতদিন নিরাপদ রাখা সম্ভব।

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

নিম্নবর্গীয়দের ওপর আক্রমণ মিহিরবাবু প্রত্যক্ষ করেছেন পঞ্চাশের দশকের শেষে। তিনি লিখেছেন, “আটান্ন-ঊনষাট সাল। পিছারার খালের আশেপাশের ভদ্র হিন্দু গেরস্তরা প্রায় শতকরা নিরানব্বই ভাগ তখন গ্রাম ত্যাগ করেছেন। শুধুমাত্র নিরুপায় হয়ে কিছু ভদ্র হিন্দু এবং নিম্নবর্ণীয়রা, যুগী, নাপিত, ধোপা, কামার, কুমোরেরা গ্রামে রয়ে গেছে। নিম্নবর্ণীয়দের তখনও ভরসা আছে যে মুসলমান শাসকশ্রেণী তাদের উপর আঘাত হানবে না।… পরে আর নিম্নবর্ণীয় বা বর্গীয় হিন্দু-মুসলমানদের অভিন্ন স্বার্থের কথা ক্ষমতাসীন কায়েমি স্বার্থান্বেষী সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের মনে থাকে না।… উচ্চবর্গীয়দের সম্পত্তি দখল হলে তাদের নজর পড়ে অপবর্গীয়/ বর্ণীয়দের গেরস্থালিতে। অতএব দখলকারিরা কায়দা পাল্টাতে শুরু করে।… তাঁতি বা যুগীদের ভিটেমাটি দখল শুরু হয়।… তখন আমাদের সংহতি সংগীতের সেইসব পংক্তিগুলো হারিয়ে যেতে থাকল—হিন্দু ও মুসলিম এক পরানেরআমরা করি না বিবাদ…।”

একটি ন্যায্য প্রশ্ন হলো, মিহির তাঁর এই বইয়ের নাম বিষাদবৃক্ষ রেখেছেন কেন? যে-পিছারার খালের বর্ণনা দিয়ে তিনি তাঁর লেখা শুরু করেছিলেন তার পাড়ে আছে একজোড়া রেন্ট্রি গাছ—লেখকের ভাষায় একত্রে সেই মহাবৃক্ষ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এই বৃক্ষের নিচে একদা সুভাষচন্দ্র বসু এসেছিলেন। হিন্দু-মুসলিম বা নিম্নবর্গীয়দের বহু গান, কথকতা, যাত্রাপালার আসর বসত ওই বৃক্ষের আশপাশে, তারপর দেশভাগ হলো, একে একে চলে যেতে লাগল হিন্দুরা, সেই মর্মান্তিক ঘটনারও সাক্ষী ওই মহাবৃক্ষ। হিন্দুরা চলে যাওয়ার ফলে সেই পিছারার খাল আর বড় খালের দুই পাড়ে সৃষ্টি হলো এক বিশাল শূন্যতা। “সেই শূন্যতা আমি স্বয়ং উপলব্ধি করেছি, উপলব্ধি করতে দেখেছি ওখানে থেকে যাওয়া হিন্দুদের এবং মুসলমানজনেদেরও। এমনকি যারা হিন্দুদের দেশত্যাগজনিত কারণে সমূহ লাভবান, তাদের বাড়ির যুবজনেরা বা মেয়েরা এই শূন্যতার কারণে যে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করত তাও তো দেখেছি। এই শূন্যতা ভরাট করার উপায় এখানের মুসলমান সমাজের মানুষদের তখন ছিল না। পিছারার খালের আবেষ্টনীর মুসলমান এবং তফসিলিভুক্ত মানুষের মধ্যে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। যা দু-একজন এই শ্রেণীচরিত্রের ছিলেন, তারা শ্রেণী গঠন করেননি, শুধুই মধ্যবিত্ত হিসেবে স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির ফয়দা তুলেছেন। মধ্যবিত্তশ্রেণী বলতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভদ্রবাবুরাই ওখানে সমাজের স্তম্ভ এবং এ কারণেই তাদের দেশত্যাগ এই বিরাট শূন্যতার বাতাবরণ তৈরি করেছিল।”

এই সাংস্কৃতিক শূন্যতার বিষয়টি কোনো দেশভাগের ইতিহাস বইতে পাওয়া যাবে না। এই শূন্যতা কোনো সংবেদনশীল হৃদয় ছাড়া অনুভব করা অসম্ভব। এটাই একটা স্মৃতিকথার সাফল্য এবং হয়তো এ-কারণে তা অনেক গুরুত্বপূর্ণও বটে। আরো বোঝা যায়, লেখক পূর্ববাংলাকে ভালোবেসেছিলেন সেখানকার একজন মানুষ হিসেবে, হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান ধরে নিয়েই। সে-কারণেই ওই শূন্যতা তাঁর চোখে প্রকট হয়ে উঠেছিল। বিষাদবৃক্ষ হলো আসলে সেই শূন্যতারই কাহিনী। দয়াময়ীর কথা একটি অসম্ভব সুন্দর, সম্পূর্ণ ব্যাকরণসম্মত স্মৃতিকথা হলো সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’। ব্যাকরণসম্মত এই অর্থে যে, লেখক এখানে শুধু আদ্যোপান্ত স্মৃতিচারণই করেছেন—জিন্নাহ, নেহরু, কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ প্রসঙ্গ তাঁর রচনায় একবারও আসেনি। দয়ার জন্ম ১৯৫১ সালে ময়মনসিংহের দিঘাপাইত গ্রামে। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দশ বছর তিনি কাটিয়েছেন ওই প্রত্যন্ত গ্রামে। দয়ার কৃতিত্ব এই যে, পরিণত বয়সে নিজের আত্মকথা লেখার সময়েও তিনি তাঁর বোধবুদ্ধি ও সারল্য দিয়ে সেই দশকটিকে বিচার করেছেন। নিঃসন্দেহে দয়াময়ীর কথা পঞ্চাশের দশকের পূর্ববাংলার একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। লক্ষ করার মতো, লেখিকার ক্ষোভ বারবার ফুটে উঠেছে সে-যুগের হিন্দু ভদ্রলোকদের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। যেমন “আমার পালিকা মায়ের কথা আমার কাছে ছিল যেন নিয়তির বাণী।”, “দয়া ভুইল্যা যাইও না মাজম আমাদের কামলা, মোসলমানের পোলা, গরু-বাছুর, খ্যাত-খামার দেখনের মানুষ, তোমার রক্তের সম্পক্কের কেউ না। মিলন-মিশনের কাম নাই।” এই হলো এক হিন্দু উচ্চবিত্ত মহিলার অন্তরের কথা। আর তাঁর প্রজা দরিদ্র বর্গাচাষি মাজম ফজরের নামাজের সময় বলে, “ও মা, দয়া তুই কি পাগুলনি; আল্লাহর সঙ্গে দুগ্গা-লক্ষ্মীর কুন কাজিয়া নাই। বেহেস্তে সগ্গলের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা, কুন কাজিয়ার জায়গা নাই। ওইসব মাইনষে করে।” দয়াময়ীর কথা পড়লে বোঝা যায় সে-সময়ের পূর্ববাংলার প্রান্তিক গ্রামগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তেমন তীব্র ছিল না। দাঙ্গা, খুন-খারাবিও নয়। সাধারণ কিছু ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যা বাদ দিলে দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি অটুট ছিল। তবু বহু হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। দিঘাপাইত গ্রামটা ছিল শান্ত। কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই। তবু চারিদিকে যে একটা অশান্তির হাওয়া বইছে তা ওই নিস্তরঙ্গ গ্রামে বসেও টের পাওয়া যেত। সুনন্দা শিকদার লিখেছেন, “বড় তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছে চারিদিকের দৃশ্যপট।… পলুদাদের বাড়িটা কি তাড়াতাড়ি ভিটে হয়ে গেল। চলে গেল গরুর গাড়িতে করে থালাবাসন, কাঁঠাল গাছের পিঁড়ি, পোঁটলায় ভর্তি চিড়ে-মুড়ি, ট্রাঙ্ক, শতরঞ্চি দিয়ে বাঁধা বিছানা-বালিশ।… চোখ মুছতে মুছতে কেউ যেতেন, কেউ আবার চিৎকার করে বলতে বলতে যেতেন—‘ও গো চলি জন্মের মতন, যদি কোনো অপরাধ কইরা থাকি মাপ কইরা দিও।’ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতিদিন এই দৃশ্য দেখতাম। অনেকে আবার বলতেন, ‘ওরে বুড়ি যাইতেছি সারা জীবনের মতো। গাঁওয়ের কারো সঙ্গে তো আর দেখা হইব না। হিন্দুস্থানে গেলে তুই দেখা করিস।”

আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত

কোনো সন্দেহ নেই যে, দুই বাংলাজুড়ে লাখ লাখ মানুষের এই আকস্মিক বিচ্ছেদই হলো বঙ্গবিভাজনের অন্যতম ট্র্যাজিক পরিণতি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না থাক, ছোঁয়াছুঁয়ির সতর্কতা ছিল তীব্র। দয়াময়ীর কথায় তার অজস্র নিদর্শন আছে, “মাকে সিরাজদা একটা কথা বলত, তোমারও পিসিমা কম না। এতকাল তোমাগো সঙ্গে আমাগো সম্পক্ক, তাও তোমারে ছুঁইলে তোমাগো জাত যায়। দয়া একটা ছুট পোনাই, অরে কারো সঙ্গে মিলবার দেও না। তোমাগো ঘরবাড়ি পুড়ল, দ্যাশ ছাইড়ত্যাছো, কিন্তু জেদটা ঠিক পুইস্যা রাখছো।… রাগ কইরো না পিসিমা, অনেক দুঃখে এই কথা কইলাম। তুমি আমারে ঘরে ডাইক্যা কোনোদিন এক গিলাস পানি খাওয়াইছো?”

সুনন্দা শিকদারের মতে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বঙ্গবিভাজনের মূলে আছে ওই ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যা। হিন্দুদের শরীর মুসলমানে স্পর্শ করলে হিন্দুদের জাত যায়। এর অর্থ হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। এসে যায় জাতিবিরোধ। এই বিরোধে হিন্দুরাই যে সেই সময় হয়ে পড়েছিল দুর্বল প্রতিপক্ষ, সেকথা সবাই জানে। সে-কারণেই তো দলে দলে হিন্দুদের দেশত্যাগ। কিন্তু হিন্দুরা কি ছিল একেবারেই নির্দোষ, অবলা একটি জাতি! বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সুনন্দা শিকদার তাঁর সোবহান দাদার মুখ দিয়ে, “নোয়াখালিতে হিন্দুদের ওপর মুসলমানেরা ভীষণ অত্যাচার আর জুলুমবাজি করেছে। হিন্দু মেয়েদের অপমান করেছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে মুসলমানদের এত অপঘিন্না হিন্দুরা করেছে তারও তুলনা নেই।… হিন্দুরা কুনদিন মুসলমানদের ঘরে ঢুকতে দেয় নাই। ছুঁইলে জাত যায়। আলাদা হুঁকা, আলাদা বাসন। মুসলমান মেহমানেরে বাইরে বসাইয়া খাওয়ায়। অনেক বছর ধইরা এই ভুলগুলা হিন্দুরা করছে। তবে যেভাবে মোসলমানেরা শোধ তুলতাছে, এইডা কিন্তু আমাগো পছন্দ না।”

‘দ্যাশ থেকে দেশে’ স্মৃতিকথা হিসেবে সার্থক ঠিকই কিন্তু বইটিকে দেশভাগ বিষয়ক স্মৃতি আলেখ্যগুলোর তালিকায় স্থান দেওয়া উচিত কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সম্পূর্ণ বইটি তিনটি আলাদা খণ্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে দেশভাগ ও দেশত্যাগের যাবতীয় স্মৃতি সংকলিত হয়েছে দ্বিতীয় খণ্ডে যার নাম ‘দ্যাশ থেকে দেশে আসার বৃত্তান্ত’। এই খণ্ডটি মোট দুশো পাতার বইতে দখল করেছে মাত্র ছাব্বিশ পৃষ্ঠা। অর্থাৎ দেশভাগ এই লেখিকাকে শৈশবে যতটা আলোড়িত করেছিল পরবর্তীকালে তার রেশ আর তেমন তীব্র ছিল না। এই বইটি আরো এক বিচারে পূর্বে আলোচিত দুটি বইয়ের থেকে আলাদা। তা হলো, আগের দুটি বই পড়লে বোঝা যায় তাদের লেখক-লেখিকাদের মনে দেশভাগজনিত বিষণ্ণতা একটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। কিন্তু আলোচ্য বইয়ের লেখিকা সীমা দাশ কলকাতায় এসে আরো বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন এবং আরো অনেক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, যেগুলো তাঁর দেশত্যাগের বেদনা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। সম্ভবত সেটাই বাঞ্ছনীয়। তাই অতীতচারণ করতে গিয়ে তিনি পূর্ববাংলার জীবনকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, কলকাতার গণনাট্য সংঘ, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস ইত্যাদি স্বনামধন্য চরিত্রও সেখানে সমমর্যাদা পেয়েছে। দ্যাশ থেকে দেশে তাই আদ্যোপান্ত একটি স্মৃতিকথা হলেও পুরোপুরি দেশভাগ বিষয়ক স্মৃতিকথা নয়। আরো একটি বিষয় অবাক করার মতো। লেখক যতদিন পূর্ববাংলায় ছিলেন (শৈশব), কোনো মুসলমান চরিত্র তাঁর সেই শৈশবের স্মৃতিতে নেই। সীমা দাশের জন্ম পটুয়াখালীতে ১৯৩৮ সালে। বাংলার বিভাজনপূর্ব রাজনীতিতে পটুয়াখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। তার এক বছর আগে ১৯৩৭ সালে এই পটুয়াখালী আসনে মুসলিম লিগ নেতা ঢাকার নবাব নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করেছিলেন সদ্য গঠিত কৃষক প্রজাপার্টির নেতা ফজলুল হক। শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতের দৃষ্টি ছিল পটুয়াখালীর দিকে। এই নির্বাচনে জিতে হক সাহেব বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। শুধু তাই নয়, তাঁর জয় প্রমাণ করে দিয়েছিল বাংলার রাজনীতিতে নেতা নির্বাচন বা বর্জনের ক্ষেত্রে কৃষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর অ্যান্ডারসন নিজে নাজিমুদ্দিনের হয়ে প্রচার করে তাঁকে জেতাতে পারেননি। এসব ঘটনা সীমা দাশের বাবা, কাকা বা পড়শিজনদের মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলেছিল তা এই স্মৃতিকথাটি পড়লে বোঝা যায় না। লেখিকার জন্ম একটি সংগীতমগ্ন, সংস্কৃতিমনা পরিবারে। বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর চর্চা, প্রয়োগরীতি ইত্যাদি এই স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে বারবার। আবার লেখিকা ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার স্মৃতি উল্লেখ করেছেন, “মাঝরাতে হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসছে কোলাহল চিৎকার—আল্লা হো আকবার ধ্বনি।… আমাদের পাড়াটায় সবাই হিন্দু।… দূর থেকে তারা দেখতে পায় আগুন যেন আকাশ ছুঁতে চলেছে। এরই মধ্যে শোনা যায় দুরকম ধ্বনি—‘বন্দে মাতরম’, ‘আল্লা হো আকবর’… বাড়ির উঠোনে তখনও তীর, ধনুক, লাঠি, ইট, বালি পড়ে। এই আগুন জানিয়ে গেল ভেতরে ভেতরে হিন্দু মুসলমান একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে যৌনতা

এই দাঙ্গার পর তাঁদের পরিবারটি আর বেশিদিন পূর্ববাংলায় থাকেনি। বোঝাই যায় ওই দাঙ্গা সেই শান্তিপ্রিয়, সংগীতপ্রেমী পরিবারটির অন্তঃস্থলে বিরাট ধাক্কা দিয়েছিল, পুড়ে গিয়েছিল তাঁদের দোকানটিও। সীমা দাশের বাবা তখন থেকেই কলকাতায় চাকরির সন্ধান শুরু করে দেন। এরপর আসে দেশত্যাগের গল্প। তার আগে অবশ্য লেখিকা স্বাধীনতা ও দেশভাগের দিনটি বর্ণনা করেছেন এভাবে, “স্বাধীনতার দিন বাড়িতে দুরকমের পতাকা টাঙানো হয়েছিল। একটা পাকিস্তানের অন্যটা কংগ্রেসের।… মুসলমান পাড়ার তুলনায় এ সাজ জৌলুসহীন, ওদের ওখানে কোনো কংগ্রেসের পতাকা নেই। কেবল শ’য়ে শ’য়ে জিন্নাহর ছবি। দূরে মুসলমান পাড়ায় আমরা ছোটরা কয়েকজন হাঁটতে হাঁটতে গেছি। ওরা কী করছে দেখি গে। ওদের টানাটানি, আপ্যায়নের ঠেলায় আমরা তো অস্থির। প্যাকেট প্যাকেট মিঠাই, তবক দেওয়া সব মুসলমানি মিষ্টি। তখন ছোট হলেও মনে সুখ পাচ্ছি না। যেন হেরে গেছি আমরা।”—এখানে লেখকের সরল সত্য ভাষণে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। প্রথমত, দেশভাগ হওয়ামাত্রই যে মুসলিমরা হিন্দু বিতাড়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তা নয়। দুটি আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত হলেও বিদ্বেষ তখনও ছিল না। যা এসেছে পরে, বিভিন্ন সামাজিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। দ্বিতীয়ত, লেখক মনে সুখ পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁরা হেরে গিয়েছেন। কেন এই পরাজয় বোধ? এই বোধের উত্তর কোনো স্মৃতিকথাতেই নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে এই পরাজয়ের পীড়নই ছিল অন্তত প্রথম পর্যায়ে দেশত্যাগের আসল কার্যকারণ। এই দেশত্যাগের বিষণ্ণতা সবার জন্যই একরকম, “সবার চোখে জল। কেউ বলে আবার আইস্যো। কেউ বলে আমাদের ভুলবা না তো। গিয়াই পত্র দিও। সবার কান্না দেখে মনটা হু হু করে ওঠে।” পরে আবার, “সব ছবি হয়ে যাচ্ছে, স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে,… ওই তো দূরে স্টিমার ঘাট, ওই তো পাবলিক থিয়েটার হল, ওই তো বাজার, ওই আদালত, পোস্টাপিস, কালীবাড়ি, ওই তো ওখানে সতীন সেনের বাড়ি।… আমরা আবার আসুম। মায়ের চোখেও জল।”

এই তিনটি স্মৃতিকথারই লেখক-লেখিকারা হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি এবং তিনটি রচনারই মূল সুর একটাই, দেশভাগ না হলেই ভালো হতো। কিন্তু একথা তো ঠিক, পূর্ববাংলার দরিদ্র মুসলিম কৃষকরা সর্বাত্মঃকরণে দেশভাগ চেয়েছিলেন। পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের তাঁদের কাছে কোনো তাৎপর্য ছিল না। তাঁরা ভেবেছিলেন, পাকিস্তান হলে বুঝি জমিদারি উচ্ছেদ ও তাঁদের দারিদ্র্যের অবসান হবে। অর্থাৎ কৃষকদের বিদ্রোহের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানপ্রাপ্তি। এর জন্য কৃষকদের দায়ী করা যায় না, দায়ী হলো তারা, যারা কৃষকদের সামনে সেই মরীচিকা তুলে ধরেছিল। দেশভাগ হলো আসলে সেই মরীচিকার কাহিনী আর ওপরে বর্ণিত স্মৃতিকথাগুলো হলো তার উপকাহিনী বা শাখা-প্রশাখামাত্র। আমাদের প্রার্থনা ও লক্ষ্য হওয়া উচিত এহেন মরীচিকার মায়াজালে জড়িয়ে হিন্দু বা মুসলিমরা যেন আর বিপথগামী না হয়। (তথ্যসূত্র: তিনটি স্মৃতিকথা ও দেশভাগ: গৌতম রায়)

দেশভাগের কারণ খুঁজেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকেও ভারত থেকে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। তাঁর বন্ধু জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেতে হয়েছে। দুই বন্ধুর বিচ্ছেদও লেখায় এসেছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেশভাগের কারণ খুঁজেছেন তার লেখায়। তার একটি লেখার শিরোনাম, ‘১৯৪৭ ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ’। তার বিশ্লেষণ এমন:
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি ট্র্যাজেডি খুবই ভয়ঙ্কর: একটি ঘটেছে ১৮৫৭ সালে, আরেকটি ১৯৪৭-এ। একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। মাঝখানে আছে স্বাধীনতাসংগ্রামের মহাকাব্য, কিন্তু সে সংগ্রামের পরিণতি মহাকাব্যিক হয়নি, হয়েছে ট্র্যাজিক। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল, আপাতদৃষ্টিতে তা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং পুরোপুরি অকল্পনীয়। কেউ ভাবেনি এমনটি ঘটবে। স্বাধীনতার নামে যে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস পাওয়া যাবে, এবং ভারতবর্ষ যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো ডমিনিয়ন হয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরেই রয়ে যাবে, এটা মোটামুটি জানা ছিল। কংগ্রেস ও লিগ এ ব্যাপারে সম্মত ছিল; কিন্তু দেশভাগ ঘটবে, বাংলা ও পাঞ্জাব দু-টুকরো হয়ে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হবে—এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

মুসলিম লীগ যা চেয়েছিল, সেটা হলো মুসলমানদের অন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি, তার জন্য যে দেশভাগ প্রয়োজন হবে, এটা তারা ভাবেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি ঢিলেঢালা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি ভৌগোলিক গ্রুপ তৈরির ধারণাটাকে গ্রহণ করেছিল, তার পেছনে এই বোধ কার্যকর ছিল, এর বেশি পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি হয়নি। কারণ তাদের বক্তব্য ছিল, ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ; এবং তাকে কোনো রকমেই বিভাজিত করা চলবে না। তবে দুই পক্ষই আবার এই ব্যাপারে একমত ছিল যে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যাবে না, রাষ্ট্র থাকবে এককেন্দ্রিক; বিরোধটা ছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা কিভাবে ভাগ করা যায়, তা নিয়ে। জওহরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেউই প্রাদেশিক নেতা হতে চাননি, চেয়েছেন সর্বভারতীয় কর্তা হবেন।

আরো পড়ুন ➥ চে, বিপ্লব ও বাজার

ওই যে এক জাতির দেশ বলে দাবি করা—এর ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ। কারণ এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। আসলে ভারতবর্ষ তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম নয়, ভাষা। সে হিসাবে ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষে একটি-দুটিও নয়, সতেরোটি জাতি ছিল। ভারতবর্ষের মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। কিন্তু কংগ্রেস ও লিগ কেউই শ্রেণি সমস্যার সমাধান চায়নি। দুই দলই ছিল বিত্তবানদের সংগঠন। তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকেরা তাদের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে, এবং তারা গদিতে বসে পড়ে ঠিক সেভাবেই দেশ শাসন করবে, যেভাবে ইংরেজরা করেছে। শাসন মানে আগের মতোই দাঁড়াবে শোষণ। শ্রেণিবিভাজনের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল; সেটা কংগ্রেস ও লিগ কেউ চায়নি; ইংরেজরা তো চায়ইনি। ইংরেজরা চেয়েছে তাদের আনুকূল্যে তৈরি বিত্তবান তাঁবেদার শ্রেণির হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাবে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে।

দেশভাগ হয়েছে এই তিন পক্ষের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। মেহনতি মানুষ এর ধারেকাছেও ছিল না। বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কংগ্রেস ও লিগের নেতাদের দর-কষাকষি চলেছে। জিন্নাহ ও নেহরুর সঙ্গে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নেহরুর সঙ্গে তো সম্পর্কটা বন্ধুত্বের পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। এই বন্ধুত্ব বড়লাটের স্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নেহরু-জিন্নাহর কলহটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার মতো। বাগ্বিতণ্ডা চলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ভাই-ই মেনে নিলেন যে ক্ষমতার ভাগটা দেশভাগ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে গেল।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জ্বলে নেভে ফ্যাসিস্ট ও বিপ্লবীর চরিত্র

ক্ষতি বিত্তবানদের হয়নি। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। ঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, তবে ধারণা করা হয়, ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষতিটা অপূরণীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব করা যায়নি, যাবেও না। অথচ মূল যে সমস্যা—যেটা হলো শ্রেণিবিভাজনের—তার কোনো সমাধান ঘটল না। ধনী-গরিবের পার্থক্য আগের মতোই রয়ে গেল। উন্নতি যা হলো তা বিত্তবানদের, সেই উন্নতির বাহক হয়ে থাকল মেহনতি মানুষ, আগে যেমন ছিল। শ্রেণি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমাজতন্ত্রীরা করেছিলেন। তাঁরা সংগ্রামে ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদী দলের হাতে। যারা ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত, এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী। বস্তুত দেশভাগে তড়িঘড়ি সম্মত হওয়ার পেছনে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তো ছিলই, আরো বড় করে ছিল সমাজবিপ্লবের ভয়। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার একটা মীমাংসা সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটলে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে—ছালা তো যাবেই, আমও হাতছাড়া হবে। অতএব যা পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ভালো। অস্পষ্টভাবে হলেও নেহরু-জিন্নাহরা জানতেন, ইংরেজের সঙ্গে দর-কষাকষি সম্ভব, কিন্তু মেহনতিরা উঠে এলে কোনো আলাপই চলবে না। তাঁরা জানতেন, ইংরেজ তাঁদের শত্রু বটে, তবে আরো বড় শত্রু হচ্ছে স্বদেশি মেহনতি মানুষ। এর প্রমাণ সুন্দরভাবে পাওয়া গেছে ‘স্বাধীনতা’র পরে। ভারতে কংগ্রেসবিরোধী মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হয়নি, যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি লিগবিরোধী কংগ্রেস; কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি।

শ্রেণি সমস্যা আড়াল করার জন্যই কিন্তু জাতি সমস্যাকে প্রধান করে তোলা হয়েছিল। এবং জাতীয়তার মূল ভিত্তি যে ভাষা, সেটাকে অস্বীকার করে ধর্মকে নিয়ে আসা হয়েছিল সামনে। ফলে সম্প্রদায় জাতি হয়ে গেল, জাতি রয়ে গেল আড়ালে। কংগ্রেস বলল, দেশটা এক জাতির, লিগ বলল, সেটা সত্য নয়, দেশ দুই জাতির। এক ও দুইয়ের হট্টগোলে সতের জাতি হারিয়ে গেল। কমিউনিস্ট পার্টি সতের জাতির কথা বলেছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও লিগের যৌথ তৎপরতার কারণ ওই সত্যটিকে সামনে নিয়ে আসতে পারেনি।

   

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;

পাট পাতার পেলকা সজনে শাকের শোলকা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সোনালী আঁশ বা পাটের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাটোয়ারী পরিবারগুলো তো বটেই মৌসুমি পাটের ব্যবসায়ীরাও সমাজে মযার্দা পেত। কারণ, যারা পাটের ব্যবসা করতেন তাদের হাতে থাকতো প্রচুর টাকা। তখন পাটকলে যারা চাকরি করতেন তাদের পরিবারেরও অনেক সচ্ছলতা ছিল। নাইলন ও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে পাটের গুরুত্ব কমে যেতে শুরু করে। পাটের চট, রশি, শাড়ি আজকাল কেউ ব্যবহার করতে চায় না। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর বড় বড় যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে পাট শাকের চাহিদা বেড়ে যায়।

কারণ, পাট পাতার বহুবিধ গুণ। পাট শাক তেতো ও মিষ্টি দুটোই সমভাবে মানুষের কাছে প্রিয়। পাট শাক দিয়ে তৈরি এক ধরণের জনপ্রিয় খাবারের নাম ‘পেলকা’। এই পেলকা ভাজা চালের গুঁড়ো, খাবার সোডা, কাঁঠালবিচি, গোটা রসুন ও কাঁচা মরিচ দিয়ে মিশিয়ে তৈরি করে সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই রান্নায় নানা ধরণের মশলা ব্যবহার করা হয়। যেগুলো বেশিরভাগ ঘরে তৈরি ভাজা উপকরণের ঢেঁকিছাটা সুগন্ধি গুঁড়ো বা শিলপাটায় পেষানো মিহি মশলা। সাধারণত: পেলকা ও শোলকা রান্নার আগে সরিষা, মেথি, ধনে, মৌরি, কালোজিরা ইত্যাদি ভেজে এই বিশেষ মশলা তৈরি করা হয়। সবকিছুর সংমিশ্রণে ভারী স্যুপের মতো করে সবুজ রংঙের এই রান্না সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। যার ফলে পেলকার স্বাদ হয় খুবই অনন্য ও লোভনীয়।

অনেকে পাটের মৌসুমে পেলকা খাওয়ার লোভে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এই বিশেষ রান্নার আয়োজন করতে বায়না ধরে থাকেন। অনেকে পাট শাকের শুকতানি তৈরি করে শুকিয়ে সারা বছরের ভেষজ খাবার হিসেবে যত্ন সহকারে ঘরে সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অনেকের কাছে পাট শাকের শুকতানি ভেজা পানি নানা রোগের মহাষৌধ হিসেবে বিবেচিত। অধুনা শহরের বহুতল ছাদ বাগানে পাট শাকের আবাদ করতে দেখা যাচ্ছে।

আরেকটি বিশেষ খাবারের নাম শোলকা। যেটি কচি সজনে পাতা দিয়ে তৈরি কর হয়। পাট শাকের তৈরি পেলকা মৌসুমি রান্না। কিন্তু সজনে পাতার তৈরি শোলকা সারা বছরব্যাপী রান্না করে খাওয়া যায়। বিশেষ করে বারোমাসী সজনে গাছ বাড়িতে থাকলে তো কোন কথাই নেই।

তবে কালের স্রোতে সৌখিন এসব খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্যস্ত কর্মজীবি মানুষ আজকাল সামনে যা পায় তাই ঝট্পট খেয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। পেলকা ও শোলকা রান্নার মতো সময় ও ধৈর্য্যধারণ করার ক্ষমতা আজকাল গ্রামীণ গৃহবধূদেরও নেই। বাজার থেকে পাট শাক কিনে কোন শহুরে পরিবারে রান্না হলে বাচ্চারা সেটা তিতা বলে খেতে চায় না। কিন্তু বিদেশি তিতো চকোলেটযুক্ত দামি চকোপাই বা আইসক্রীম তাদের কাছে খুবই প্রিয়।

এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় খাবার দুটো। কিন্তু অবাধ ইন্টারনেটের এই যুগে আবারো পাট ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। কচি পাট পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শক্তিবর্ধক ভেষজ ওষুধ ও টনিক। আর সজনে পাতা ‘সুপার ফুডের’ তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে ফেলেছে।

একজন জাপানিজ গবেষক আফ্রিকা থেকে সজনে পাতা এনে গবেষণা করে এই মিরাক্কেল শাক থেকে ‘মরিঙ্গা পাউডার’ তৈরি করে এর বহুবিধ গুণ প্রচার করেছিলেন। সজনে গাছকে তিনি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ হিসেবে জানতেন। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ড্রামস্টিক ট্রি’বা সজনে গাছ এত সহজলভ্য এবং এতটাই সুপরিচিত যে তিনি সেটা জানতে পেরে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’প্রতি আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা ও অবহেলা তাকে খুবই বিস্মিত করে তুলেছিল।

সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’ প্রচার ও এর চাহিদার দিকে লক্ষ্য করে আজকাল সজনে বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। সজনে বাগান কেন্দ্রিক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখনায় মহিলা শ্রমিক সহ অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সজনে পাতার পাউডার—এর ব্যাপক গুণকীর্তন চালু থাকায় বাজারে এর চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ।

প্রচারে প্রসার—এই তত্ত্ব যেন সজনে পাতাকে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। সাইবার জগতের এই বিরাট সাড়া আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোন জাগরণ তৈরি করেছে কবলে মনে হচ্ছে না। আগেকার দিনে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে নানাব্যঞ্জন রান্না করা হতো। পরিবারের সদস্যরা সেগুলো মজা করে খেতেন। তাই তখন এত রোগ—বালাই হতো না। এটি মূলত: একটি সাধারণ প্রচলণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ।

আজকাল মানুষ কৃত্রিম খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও বাহারি রং মেশানো খাবার পাতে না হলে আধুনিক মানুষের মন ভরে না। আধুনিক মশলার মধ্যে আসলে কি কি উপাদান মিশ্রিত রয়েছে তা যাচাই করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ভেজালের এই যুগে বিএসটিআই—এর প্রতীক লাগানো কতকিছুই হরদম জব্দ করে জরিমানা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে উন্নয়নের অতিপ্রচার দেখে বিদেশিরা বাংলাদেশের দিকে ঘন ঘন তাকানো শুরু করেছে। তবে ঋণ ও ক্ষমতা লাভের জন্য তাদের দিকে আমরা আরো বেশি করে তাকিয়ে থাকি। এই পরনির্ভরশীলতা আমাদেরকে আরো বেশি পঙ্গু করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এবছর দেশের একদিকে দারুণ খরা, অন্যদিকে হঠাৎ বন্যা শুরু হয়েছে। কেউ বষার্কালে গভীর নলকূপের পানিতে সেচ দিয়ে রোপা আমন ধানের চারা লাগাচ্ছে আবার কারো বীজতলা তলিয়ে গেছে ঢলের পানিতে। এরই মাঝে এডিস মশা দেশের সব জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ায় সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৩ পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যাক ৬৫৭ জন মারা গেছেন। মফস্বলের হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে।

ঢাকায় গিয়ে হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝে, বারান্দায়, ওয়েটিং রুমে মাদুর পেতে রোগী নিয়ে শুয়ে আছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যখন কোন জটিল রোগীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন তখন। মফস্বল থেকে আসা অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়—স্বজন রক্ত দেয়ার ব্যাপারে সজাগ নন। রক্ত দেয়ার কথা শুনলেই তারা অনেকে আঁৎকে উঠেন। কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করে দেন। এছাড়া বাইরে থেকে রক্ত সংগ্রহ, খরচ বহন ইত্যাদির জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত নন।

এরই মাঝে রাজপথের একটি লেনে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের মিছিলের লম্বা লাইন যখন ৪—৫ মাইল লম্বা হচ্ছে তখন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দলও অপর দিকের বাকি লেনটি দখল করে মিছিল শুরু করে দিচ্ছে। ডেঙ্গুর হটস্পট রাজধানী ঢাকায় সারা দেশ থেকে ভাড়ায় মানুষ ডেকে এনে সম্মেলন ও মিছিল করাচ্ছে সরকারি দলও! এর ফলে প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ ডেঙ্গু।

অন্যদিকে দেশে কেউ যেন কিছকেইু ঠিকমতো পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। স্থানীয় জনগণের উপলব্ধিকে পাত্তা না দেয়া আমাদের দেশজ উন্নয়ন অবনমনের প্রধান কারণ বা অন্তরায় হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। এদেশে কেউ তার নিজের দোষ সহজে স্বীকার করতে অভ্যস্ত নয়। তাই মিথ্যা-জালিয়াতির বেসাতিতে বিপদ বেড়েই চলেছে চারদিকে। সেজন্য অতিদ্রুত পারস্পরিক দোষারোপ ও পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে দেশজ তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক গবেষণা করে, দেশজ সম্পদ রক্ষা করতে হবে।

আমরা যখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘুমিয়ে থাকি তখন অন্যেরা এসে ধরে উজাড় করে দেয়। আমরা যখন জাল ফেলি তখন নদী মাছশূন্য। বিদেশি লুটেরাদের হাতে উজাড় হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সম্পদ। ইলিশ মাছের শুধু এক ভিডিও সব ইউটিউবারদের ‘তুমি সুড়ংঙ্গে’ ছড়াছড়ি। অথচ ইলিশের এই ভরা মৌসুমে কাঁচাবাজার ইলিশ শূন্য। বাড়ছে অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ফুলে ফেঁপে উঠা সংখ্যার মতো বিষফোঁড়া। মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ হলে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই দশ হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাবে বলে ভাষ্য দেন কোন বিচারক!

খুব দ্রুত আধুনিক হবার জন্য শোলকা পেলকার মতো দেশজ খাবার ত্যাগ করে যখন দুর্বল শরীর নিয়ে কালাতিপাত করছি ঠিক তখন জাপানিজ গবেষকের উদ্ভাবিত সজনে পাতার পাউডার আমাদেরকে নবজীবন দান করতে পারবে বলে সেই আশায় সেদিকে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছি। তবে শোলকা—পেলকার মতো দেশজ খাবার গ্রহণ করে মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে শুরু না করলে বৈশ্বিক উজানের হঠাৎ ঢল এসে সাতকানিয়ার নতুন রেললাইন বাঁকা করে দেয়ার মতো ঘটনা আরো ঘন ঘন জেঁকে বসতে থাকবে বৈ—কি?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;