কোলাজ মন্তাজ

বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বসাহিত্যে দেশভাগ যেন ট্রাজিক অভিজ্ঞতা। ১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত ভাগ নতুন দুটি দেশের গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত পরিবার পারস্পরিক গৃহবিনিময় করে উভয় রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করলেও অধিকাংশ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় বাস্তবতার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেককে চলে যেতে হয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে। হাসান আজিজুল হকের মতো অনেকককে ভারত ছেড়ে আসতে হয় বাংলাদেশে। এই জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতের রক্তক্ষরণ, নির্মম সময়ের দাগ আমাদের বাংলা সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে। গল্প, উপন্যাস এবং কবিতা সবক্ষেত্রে। কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো, খাজা আহমেদ আববাস, ভীষ্ম সাহানী, খুশবন্ত সিংরা যেভাবে উর্দু এবং হিন্দিতে এই বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন, তা বাংলা সাহিত্যেও এসেছে। এসেছে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক হর্ষ দত্ত যখন প্রশ্ন করেন, “নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোঁয়া রয়ে গেছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টা ঘুরেফিরে এসেছে?” সুনীল তখন উত্তর দেন, “দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সবসময় মনে পড়ে। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এত বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।”

গৌর কিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’, মনোজ বসুর ‘ইয়াসিন মিঞা’, এস এম বজলুল হকের ‘ভাগ না দিয়ে ভাগানো’, অঞ্জলি দেবীর ‘নবীন আশার খড়গ’, অপূর্ব কুমার মৈত্রের ‘স্বাধীনতার ব্যথা’, নরেন্দ্র দেবের ‘চলচ্চিত্র’, সুমথনাথ ঘোষের ‘উদ্বাস্তু’, হরি নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পুনশ্চ’, ‘ইতিহাস’ ও ‘লাঠিয়াল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিক পাত্র’ ও ‘সড়ক’, ফণীন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘গোপাল উড়ের লেন’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’, সমরেশ বসুর ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেডমাস্টার’ ও ‘পালঙ্ক’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘নেহায়েৎ গল্প নয়’, নূর আলীর ‘মোহাজের’, বেগম হাশমত রশীদের ‘ফরিয়াদ’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ছুরি’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্বেতকমল’ ও ‘অধিকার’, প্রতিভা বসুর ‘দুকূল হারা’ ও ‘অপরাহ্ণে’ ইত্যাদি দেশভাগের গল্প।

স্মৃতি’ আর ‘নতুন অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন’—এই দুটি মাত্রায় দেশভাগের সাহিত্য বিকশিত। দেশভাগের সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে এই স্মৃতি আর ফেলে আসা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। দেশভাগের এই গল্প সংকলনে অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ভিটেমাটির রূপকথা’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘দেশভাগের পর’, জাফর তালুকদারের ’পিতৃভূমি’, জীবন সরকারের ‘কোষা’, দেবেশ রায়ের ‘উদ্বাস্তু’, প্রতিভা বসুর ‘দু’কূল হারা’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মোজাহের’ মিহির মুখোপাধ্যায়ের ‘বাঙলাদেশ’, মিহির সেনগুপ্তের ‘পিতামহীর স্বদেশযাত্রা’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’, সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’, জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, প্রফুল্ল রায়ের ‘রাজা যায় রাজা আসে’, বনফুলের ‘দাঙ্গার সময়’, ইসহাক চাখারীর ‘রায়ট’ প্রভৃতি গল্পের নামই যেন দেশভাগের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিতবাহী।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্য করে ‘ধনী’ ও ধনী হয়ে ‘সাহিত্য’ করার গল্প

এছাড়া ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিকপাত্র’, কৃষণ চন্দরের ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর ‘যে তোমায় ছাড়ে’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পালঙ্ক’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দোসর’, বিমল করের ‘অন্তরে’, শওকত ওসমানের ‘আলিম মুয়াজিজন’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘তোমার উদ্দেশ্যে’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, সাদত হাসান মান্টোর ‘শরিফান’, সমরেশ বসুর ‘আবাদ’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘নেড়ে’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জুয়া’, প্রভৃতি গল্পে দেশভাগের পূর্ব ও পরেকার নানাবিধ মানসিক ও মানবিক সংঘাত, সংঘর্ষ, হাহাকার ফুটিয়ে তুলেছেন লেখকরা।

তবে বাংলাদেশের সাহিত্যে এ বিষয়ে কম লেখা হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া এবং দেশভাগের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এটিই স্বাভাবিক। দেশভাগের পর উপন্যাস পেতে আমাদের ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। ওপার বাংলার আরো কয়েকটি উপন্যাস হলো—অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, শক্তিপদ রাজগুরুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’, সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’।

“১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ হলে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠল। বাঙালি মুসলমান লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলেন। বলা বাহুল্য, তাঁরা বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ধারার উত্তরাধিকারটিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এবার তাঁদের নবযাত্রা শুরু হলো।” (বাংলাদেশের ছোটগল্প, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৯, পৃ. ছয়)

দেশভাগ নিয়ে ঢাকায়, সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্রে অনেকেই উপন্যাস লিখেছেন। কলকাতা থেকে ফিরে সাহিত্যের যে নবযুগের সূচনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ঔপন্যাসিক হলেন—আনোয়ার পাশা, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল ফজল, আবু ইসহাক, সত্যেন সেন, রাজিয়া খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েনউদ্দীন। এদের উপন্যাসে দেশবিভাগ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ও কাহিনীর মৌল বিবেচ্য হয়েছে। পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী ও সেলিনা হোসেনের উপন্যাসেও দেশবিভাগের ইতিহাস-অভিঘাত রূপায়িত হয়েছে।

আরো পড়ুন ➥ শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’

প্রথম দিকের উপন্যাসে দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা, বাস্তুচ্যুতির জন্য বেদনাবোধ, স্মৃতিকাতরতা ও ভয়ার্ত অস্তিত্ব-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত লেখকদের উদারনৈতিক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডকুমেন্টিরির মতো করে দেশভাগের ঘটনার উপস্থাপন করা হয়েছে। তারপর কালে কালে তার বিস্তৃতি ঘটেছে। সেই ষাটের দশকের লেখক যারা, তারা এই এত বছর পরে এসেও যখন দেশবিভাগ নিয়ে উপন্যাস লিখেন, সেখানেও দেশবিভাগের অনিবার্য অভিঘাত চিত্রিত হয়। এর নিকতম উদাহরণ হলো ২০১০ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘আগুনপাখি’।

পঞ্চাশের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৯৪৩ থেকে দেশবিভাগ (১৯৪৭) সময়বৃত্তে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের কাহিনী বিন্যস্ত। আবু ইসহাকের মুখ্য অভিনিবেশ ছিল জয়গুনকেন্দ্রিক নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রামের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা। উপন্যাসের সূচনায় আছে মন্বন্তরের প্রসঙ্গ। দুর্ভিক্ষতাড়িত মানুষ স্বপ্ন দেখেছে, দেশ স্বাধীন হলে চালের দাম কমবে। দেশ একদিন স্বাধীন হয়। কিন্তু জয়গুনদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার হয় সমাধি। তাদের ভিটা থেকে আবার উচ্ছেদ হতে হয়। দেশবিভাগ অসংখ্য মানুষকে উদ্বাস্তু করেছিল। সেই বাস্তবতার পরিবর্তে পাকিস্তান রাষ্ট্রে জয়গুনদের নিরাশ্রয়তার নির্মম আলেখ্য রচিত হয় কাহিনীতে।

আবুল ফজলের ‘রাঙ্গাপ্রভাত’-এ দেশভাগ, পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংকট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা প্রকাশিত হয়েছে।

রাজিয়া খানের ‘বটতলার উপন্যাস’-এ দেশভাগজনিত সংকট এবং উপমহাদেশের বিশাল ভৌগোলিক পরিসরে চরিত্রপাত্রের জটিল সমস্যার বিন্যাস দেখানো হয়েছে। মঈনের স্বদেশ উন্মূলিত বাস্তবতা দেশভাগজনিত। তার ব্যক্তিজীবনের স্বপ্ন, প্রেম, এমনকি পারিবারিক পরিবেষ্টনীকে বিপর্যস্ত করেছে দেশভাগ। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরও মঈন কলকাতার মেয়ে সুমিতার প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব করেছে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাধারায় সেই অনুরাগ শেষ পর্যন্ত নতুন রাষ্ট্রের জটিল পরিস্থিতিতে শুভ পরিণতিতে উপনীত হতে পারেনি।

শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ১৯৩৮ থেকে ১৯৫১ কালপর্বের কাহিনী। দুটি গ্রাম বাকলিয়া ও তালতলী প্রধান হলেও কলকাতা ও ঢাকার পটভূমিও উপন্যাসটির ঘটনাধারায় বিস্তৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধোত্তর কলকাতার দাঙ্গা, দেশবিভাগের পর বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের পথপরিক্রমায় এগিয়ে গেছে ‘সংশপ্তক’-এর কাহিনী।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’ উপন্যাসের কাহিনী পরিব্যাপ্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। কবি রহমতের স্মৃতিকথার মধ্য দিয়ে দেশভাগ ও দেশবিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্মোচিত হয়েছে। স্বপ্নের ভূখণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক হায়াত খাঁ টঙ্গী সোনারগাঁ জুট মিলে শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণকালে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। অনেক সূর্যের প্রত্যাশায় লালিত ভূখণ্ডের এ বেদনার স্বরূপ নির্দেশের মধ্য দিয়েই উপন্যাসের সূচনা। দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নকল্পনা ও ভাবাবেগ কিভাবে বারবার বিচ্যুত হয়েছে তারই পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা উপন্যাসটির গভীরে প্রোথিত।

আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র কাহিনী শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালে এসে। এরপরই দেশভাগ থেকে শুরু হয়েছে ‘সংকর সংকীর্তন’-এর ঘটনা। কলকাতা ও তার আশপাশের পটভূমিতে প্রধান চরিত্র মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের জীবন চিত্রিত হয়েছে এখানে। তবে ফরাজি আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত এ উপন্যাসের ঘটনা। ব্রিটিশদের স্বার্থচালিত শোষণ-প্রক্রিয়া ও দ্বিজাতিতত্ত্ব উদ্ভাবনের মনস্তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। মূলত ‘ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ এবং ‘সংকর সংকীর্তন’ এই তিনটি উপন্যাসে একটি পরিবারের যোগসূত্রে বাঙালি মুসলমানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন। সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ ও তিন খণ্ডের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’য় দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবন ও তেভাগা প্রসঙ্গের রূপায়ণে পরোক্ষভাবে দেশভাগের প্রসঙ্গ রেখায়িত। মূলত ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন কালানুক্রমিক ঘটনাধারায় আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদী আদর্শ এবং প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক জীবনবোধের বিকাশ ঘটে।

তিনটি স্মৃতিকথা

মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’, সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ এবং সীমা দাশের ‘দ্যাশ থেকে দেশে’ বই তিনটিতে আমরা দেশভাগের স্মৃতি দেখতে পাই। বিষাদবৃক্ষ লেখার আগে মিহির সেন গুপ্ত আরো তিনটি বই লিখেছিলেন, যদিও তার কোনোটারই বিষয় দেশভাগ ছিল না। চতুর্থ বইতে রচনাশৈলীতে অবশ্য তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়। বরিশালের প্রান্তিক গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারে লেখকের জন্ম। মিহির লিখেছেন, “আমার আলেখ্যর জন্যে সময়কাল হিসেবে আমি ন্যূনাধিক দশ বছরের মতো একটা পরিসর নিয়েছি। সেই দশ বছরের সময়কালটি উনিশশো একান্ন-বাহান্ন থেকে উনিশশো বাষট্টি-তেষট্টি পর্যন্ত বিসত্মৃত।” তাঁর বাড়ির পেছনদিকে ছিল একটা সরু খাল। “দুপাশের বাড়িঘর, আগান-বাগানের মাঝখান দিয়ে তার গতি লীন হতো গিয়ে বড় খালে। বড় খালটিও ওইরকমভাবে গিয়ে পড়ত নদীতে।” বাড়ির পেছনের এই ছোট খালটিকে লেখক তাঁর বরিশালি ভাষায় বলেছেন, ‘পিছারার খাল’। মিহিরের বর্ণনায়—“এই খালটি আমাদের বড় আত্মীয় ছিল।” এই পিছারার খালটিকে ঘিরে কতগুলো হিন্দু পরিবারের ক্রমবর্ধমান আর্থিক অবনতি, আঁকড়ে থাকা জমিদারি ঠাঁটবাট, সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলা, মুসলিম তালুকদার ইত্যাদি শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি মিহির বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশেষত আমাদের পরিবারের বা তার থেকেও ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে যেসব মধ্যস্বত্বভোগী আছে তাদের সমূহ সংকট। তাদের মধ্যস্বত্বের খাজনার পরিমাণের ব্যাপারটা অঙ্কে আসে না। কিছু খাসজমির উপজ তাদের বাঁচিয়ে রাখে।… এই খাসজমি যদি তারা নিজেরা চাষ করে তবুও কথা ছিল। কিন্তু তা কী করে হবে? তারা যে জমিদার। জমিদার জমি চষে না। প্রজাপত্তনির প্রজারাই তা চষে। জমিদার ফসলের ভাগ পায়। এই ব্যবস্থার জন্যে যখন প্রজাপত্তনি, মধ্যস্বত্ব যায় তখন খাসজমিও যাবার রাস্তা ধরে…।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

লেখক সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছেন পূর্ববাংলায় দেশভাগের পক্ষে বাতাবরণ তৈরির মূলে ছিল জমিস্বার্থ। জমির মালিকানার হ্রাস-বৃদ্ধি যে কিভাবে পূর্ববাংলার হিন্দু ও মুসলিম মানসিকতা প্রভাবিত ও চালিত করেছিল তার যথাযথ বিবরণ আছে মিহিরের বিষাদবৃক্ষে। তিনি লিখেছেন, “পিছারার খালের চৌহদ্দিতে যেমন, গোটা পূর্ব বাংলায়ও তেমনি, সামন্তশ্রেণী বলতে হিন্দু সামন্তদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু তা ছিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর সামগ্রিক হিসেবে। তার অর্থ এই নয় যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জমিদার বা অন্য মধ্যস্বত্বভোগীরা সাধারণ এইসব মানুষকে শোষণ বা নির্যাতন করত না। আমার পরিমণ্ডলে আমি অনেক তথাকথিক তালুকদার দেখেছি যারা সাম্প্রদায়িকভাবে মুসলমান এবং শ্রেণীশোষণ বা নির্যাতনে ওখানকার হিন্দু জমিদার বা তালুকদারের তুলনায় কিছুমাত্র ভিন্ন নয়। সেক্ষেত্রে লিগপন্থীরা সাধারণদের বুঝিয়েছিল যে পাকিস্তান কায়েম হলে সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ হবে এবং অবস্থাপন্নদের সংযত রাখার জন্যে ইসলামি বিধি মতে ‘জাকাত’, ‘খয়েরাত’ ইত্যাদি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু পাকিস্তান কায়েম হবার পর এমনকি মধ্যস্বত্ব প্রথা উচ্ছেদ হবার পরও এই প্রতিজ্ঞা পালনের কোনো প্রচেষ্টাই হয়নি। না হওয়ার কারণটিও অবশ্য শরিয়তি ব্যবস্থার অন্তর্গত, অন্যের ‘হক্কের সম্পত্তি’ দখল করা না-জায়েজ, হারাম—এমত নির্দেশ। সে সম্পত্তি হিন্দুর হলে জায়েজ এবং মুসলমানের হলে না-জায়েজ, এসব বিতর্কে তখন অন্তত কেউ যাননি…।”

আরেক জায়গায় মিহির লিখেছেন, “আশেপাশের মুসলমান গ্রামগুলিতে যথেষ্ট উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবার বিশেষ ছিল না। মাঝারি মাপের যারা তারাই এখন সব ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পদ নিয়ে নিজেদের ঘর এবং জীবন সাজাতে চেষ্টা করছে। এই সময়টা থেকে বড়, মাঝারি এবং কিছু ছোট কৃষক পরিবারও ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তির পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনায় বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠে। রাতারাতি তাদের বাড়ি-ঘরদোরের চেহারা বদলে যেতে থাকে এবং তারা বেশ হোমড়াচোমড়া হয়ে দাঁড়ায়।” অন্যদিকে, “পিছারার খালের আশেপাশের হিন্দু সমাজটি তখন একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। ফলে অবশিষ্ট হিন্দু অধিবাসীদের মধ্যে একটা নৈতিক অধঃপতন আস্তে আস্তে পরিলক্ষিত হতে থাকে। পারিবারিক শাসন আলগা, অভিভাবকেরা উদাসীন, ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, বিবাহের বয়স অতিক্রান্ত মেয়েদের বিয়ে-থা দেওয়া হচ্ছে না। সে এক মাৎস্যন্যায়ী অবস্থা।”

বিদ্বজ্জনরা বিভিন্ন নিবন্ধে দেখিয়েছেন, পূর্ববাংলায় নিম্নবর্গীয় ও নমঃশূদ্ররা বরাবরই ছিল একটি দোদুল্যমান শ্রেণি। নিম্নবর্গীয় পরিচিতি সত্তা হিন্দু বা মুসলিমের সত্তা থেকে স্বতন্ত্র—এরকম একটা বোধ বরাবরই তাদের মধ্যে অটুট ছিল। তারা কখনো দাঁড়িয়েছে মুসলিমদের পাশে, কখনো হিন্দুদের। দেশভাগের প্রাক্কালে মুসলিম লিগের বন্ধু হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল হয়ে উঠেছিলেন নমঃশূদ্রদের অবিসম্বাদী নেতা। পরবর্তীকালে জিন্নাহর প্রথম সরকারে পূর্ববাংলা থেকে আমন্ত্রিত একমাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ১৯৫০ সালেই অবশ্য যোগেন্দ্রনাথ জিন্নাহর মন্ত্রিসভায় তিনি যে কতটা অবহেলার পাত্র তা বুঝে যান এবং একটি দীর্ঘ পদত্যাগপত্র লিখে ভারতে চলে আসেন। তা সত্ত্বেও অনেকদিন পর্যন্ত নিম্নবর্গীয়দের ধারণা ছিল, মুসলিম দাঙ্গাবাজরা তাদের স্পর্শ করবে না। কিন্তু যেখানে জমিস্বার্থই প্রধান এবং রাষ্ট্র যখন সরাসরি মদদ ও প্রশ্রয় দিচ্ছে তখন নিজেদের আর কতদিন নিরাপদ রাখা সম্ভব।

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

নিম্নবর্গীয়দের ওপর আক্রমণ মিহিরবাবু প্রত্যক্ষ করেছেন পঞ্চাশের দশকের শেষে। তিনি লিখেছেন, “আটান্ন-ঊনষাট সাল। পিছারার খালের আশেপাশের ভদ্র হিন্দু গেরস্তরা প্রায় শতকরা নিরানব্বই ভাগ তখন গ্রাম ত্যাগ করেছেন। শুধুমাত্র নিরুপায় হয়ে কিছু ভদ্র হিন্দু এবং নিম্নবর্ণীয়রা, যুগী, নাপিত, ধোপা, কামার, কুমোরেরা গ্রামে রয়ে গেছে। নিম্নবর্ণীয়দের তখনও ভরসা আছে যে মুসলমান শাসকশ্রেণী তাদের উপর আঘাত হানবে না।… পরে আর নিম্নবর্ণীয় বা বর্গীয় হিন্দু-মুসলমানদের অভিন্ন স্বার্থের কথা ক্ষমতাসীন কায়েমি স্বার্থান্বেষী সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের মনে থাকে না।… উচ্চবর্গীয়দের সম্পত্তি দখল হলে তাদের নজর পড়ে অপবর্গীয়/ বর্ণীয়দের গেরস্থালিতে। অতএব দখলকারিরা কায়দা পাল্টাতে শুরু করে।… তাঁতি বা যুগীদের ভিটেমাটি দখল শুরু হয়।… তখন আমাদের সংহতি সংগীতের সেইসব পংক্তিগুলো হারিয়ে যেতে থাকল—হিন্দু ও মুসলিম এক পরানেরআমরা করি না বিবাদ…।”

একটি ন্যায্য প্রশ্ন হলো, মিহির তাঁর এই বইয়ের নাম বিষাদবৃক্ষ রেখেছেন কেন? যে-পিছারার খালের বর্ণনা দিয়ে তিনি তাঁর লেখা শুরু করেছিলেন তার পাড়ে আছে একজোড়া রেন্ট্রি গাছ—লেখকের ভাষায় একত্রে সেই মহাবৃক্ষ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এই বৃক্ষের নিচে একদা সুভাষচন্দ্র বসু এসেছিলেন। হিন্দু-মুসলিম বা নিম্নবর্গীয়দের বহু গান, কথকতা, যাত্রাপালার আসর বসত ওই বৃক্ষের আশপাশে, তারপর দেশভাগ হলো, একে একে চলে যেতে লাগল হিন্দুরা, সেই মর্মান্তিক ঘটনারও সাক্ষী ওই মহাবৃক্ষ। হিন্দুরা চলে যাওয়ার ফলে সেই পিছারার খাল আর বড় খালের দুই পাড়ে সৃষ্টি হলো এক বিশাল শূন্যতা। “সেই শূন্যতা আমি স্বয়ং উপলব্ধি করেছি, উপলব্ধি করতে দেখেছি ওখানে থেকে যাওয়া হিন্দুদের এবং মুসলমানজনেদেরও। এমনকি যারা হিন্দুদের দেশত্যাগজনিত কারণে সমূহ লাভবান, তাদের বাড়ির যুবজনেরা বা মেয়েরা এই শূন্যতার কারণে যে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করত তাও তো দেখেছি। এই শূন্যতা ভরাট করার উপায় এখানের মুসলমান সমাজের মানুষদের তখন ছিল না। পিছারার খালের আবেষ্টনীর মুসলমান এবং তফসিলিভুক্ত মানুষের মধ্যে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। যা দু-একজন এই শ্রেণীচরিত্রের ছিলেন, তারা শ্রেণী গঠন করেননি, শুধুই মধ্যবিত্ত হিসেবে স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির ফয়দা তুলেছেন। মধ্যবিত্তশ্রেণী বলতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভদ্রবাবুরাই ওখানে সমাজের স্তম্ভ এবং এ কারণেই তাদের দেশত্যাগ এই বিরাট শূন্যতার বাতাবরণ তৈরি করেছিল।”

এই সাংস্কৃতিক শূন্যতার বিষয়টি কোনো দেশভাগের ইতিহাস বইতে পাওয়া যাবে না। এই শূন্যতা কোনো সংবেদনশীল হৃদয় ছাড়া অনুভব করা অসম্ভব। এটাই একটা স্মৃতিকথার সাফল্য এবং হয়তো এ-কারণে তা অনেক গুরুত্বপূর্ণও বটে। আরো বোঝা যায়, লেখক পূর্ববাংলাকে ভালোবেসেছিলেন সেখানকার একজন মানুষ হিসেবে, হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান ধরে নিয়েই। সে-কারণেই ওই শূন্যতা তাঁর চোখে প্রকট হয়ে উঠেছিল। বিষাদবৃক্ষ হলো আসলে সেই শূন্যতারই কাহিনী। দয়াময়ীর কথা একটি অসম্ভব সুন্দর, সম্পূর্ণ ব্যাকরণসম্মত স্মৃতিকথা হলো সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’। ব্যাকরণসম্মত এই অর্থে যে, লেখক এখানে শুধু আদ্যোপান্ত স্মৃতিচারণই করেছেন—জিন্নাহ, নেহরু, কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ প্রসঙ্গ তাঁর রচনায় একবারও আসেনি। দয়ার জন্ম ১৯৫১ সালে ময়মনসিংহের দিঘাপাইত গ্রামে। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দশ বছর তিনি কাটিয়েছেন ওই প্রত্যন্ত গ্রামে। দয়ার কৃতিত্ব এই যে, পরিণত বয়সে নিজের আত্মকথা লেখার সময়েও তিনি তাঁর বোধবুদ্ধি ও সারল্য দিয়ে সেই দশকটিকে বিচার করেছেন। নিঃসন্দেহে দয়াময়ীর কথা পঞ্চাশের দশকের পূর্ববাংলার একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। লক্ষ করার মতো, লেখিকার ক্ষোভ বারবার ফুটে উঠেছে সে-যুগের হিন্দু ভদ্রলোকদের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। যেমন “আমার পালিকা মায়ের কথা আমার কাছে ছিল যেন নিয়তির বাণী।”, “দয়া ভুইল্যা যাইও না মাজম আমাদের কামলা, মোসলমানের পোলা, গরু-বাছুর, খ্যাত-খামার দেখনের মানুষ, তোমার রক্তের সম্পক্কের কেউ না। মিলন-মিশনের কাম নাই।” এই হলো এক হিন্দু উচ্চবিত্ত মহিলার অন্তরের কথা। আর তাঁর প্রজা দরিদ্র বর্গাচাষি মাজম ফজরের নামাজের সময় বলে, “ও মা, দয়া তুই কি পাগুলনি; আল্লাহর সঙ্গে দুগ্গা-লক্ষ্মীর কুন কাজিয়া নাই। বেহেস্তে সগ্গলের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা, কুন কাজিয়ার জায়গা নাই। ওইসব মাইনষে করে।” দয়াময়ীর কথা পড়লে বোঝা যায় সে-সময়ের পূর্ববাংলার প্রান্তিক গ্রামগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তেমন তীব্র ছিল না। দাঙ্গা, খুন-খারাবিও নয়। সাধারণ কিছু ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যা বাদ দিলে দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি অটুট ছিল। তবু বহু হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। দিঘাপাইত গ্রামটা ছিল শান্ত। কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই। তবু চারিদিকে যে একটা অশান্তির হাওয়া বইছে তা ওই নিস্তরঙ্গ গ্রামে বসেও টের পাওয়া যেত। সুনন্দা শিকদার লিখেছেন, “বড় তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছে চারিদিকের দৃশ্যপট।… পলুদাদের বাড়িটা কি তাড়াতাড়ি ভিটে হয়ে গেল। চলে গেল গরুর গাড়িতে করে থালাবাসন, কাঁঠাল গাছের পিঁড়ি, পোঁটলায় ভর্তি চিড়ে-মুড়ি, ট্রাঙ্ক, শতরঞ্চি দিয়ে বাঁধা বিছানা-বালিশ।… চোখ মুছতে মুছতে কেউ যেতেন, কেউ আবার চিৎকার করে বলতে বলতে যেতেন—‘ও গো চলি জন্মের মতন, যদি কোনো অপরাধ কইরা থাকি মাপ কইরা দিও।’ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতিদিন এই দৃশ্য দেখতাম। অনেকে আবার বলতেন, ‘ওরে বুড়ি যাইতেছি সারা জীবনের মতো। গাঁওয়ের কারো সঙ্গে তো আর দেখা হইব না। হিন্দুস্থানে গেলে তুই দেখা করিস।”

আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত

কোনো সন্দেহ নেই যে, দুই বাংলাজুড়ে লাখ লাখ মানুষের এই আকস্মিক বিচ্ছেদই হলো বঙ্গবিভাজনের অন্যতম ট্র্যাজিক পরিণতি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না থাক, ছোঁয়াছুঁয়ির সতর্কতা ছিল তীব্র। দয়াময়ীর কথায় তার অজস্র নিদর্শন আছে, “মাকে সিরাজদা একটা কথা বলত, তোমারও পিসিমা কম না। এতকাল তোমাগো সঙ্গে আমাগো সম্পক্ক, তাও তোমারে ছুঁইলে তোমাগো জাত যায়। দয়া একটা ছুট পোনাই, অরে কারো সঙ্গে মিলবার দেও না। তোমাগো ঘরবাড়ি পুড়ল, দ্যাশ ছাইড়ত্যাছো, কিন্তু জেদটা ঠিক পুইস্যা রাখছো।… রাগ কইরো না পিসিমা, অনেক দুঃখে এই কথা কইলাম। তুমি আমারে ঘরে ডাইক্যা কোনোদিন এক গিলাস পানি খাওয়াইছো?”

সুনন্দা শিকদারের মতে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বঙ্গবিভাজনের মূলে আছে ওই ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যা। হিন্দুদের শরীর মুসলমানে স্পর্শ করলে হিন্দুদের জাত যায়। এর অর্থ হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। এসে যায় জাতিবিরোধ। এই বিরোধে হিন্দুরাই যে সেই সময় হয়ে পড়েছিল দুর্বল প্রতিপক্ষ, সেকথা সবাই জানে। সে-কারণেই তো দলে দলে হিন্দুদের দেশত্যাগ। কিন্তু হিন্দুরা কি ছিল একেবারেই নির্দোষ, অবলা একটি জাতি! বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সুনন্দা শিকদার তাঁর সোবহান দাদার মুখ দিয়ে, “নোয়াখালিতে হিন্দুদের ওপর মুসলমানেরা ভীষণ অত্যাচার আর জুলুমবাজি করেছে। হিন্দু মেয়েদের অপমান করেছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে মুসলমানদের এত অপঘিন্না হিন্দুরা করেছে তারও তুলনা নেই।… হিন্দুরা কুনদিন মুসলমানদের ঘরে ঢুকতে দেয় নাই। ছুঁইলে জাত যায়। আলাদা হুঁকা, আলাদা বাসন। মুসলমান মেহমানেরে বাইরে বসাইয়া খাওয়ায়। অনেক বছর ধইরা এই ভুলগুলা হিন্দুরা করছে। তবে যেভাবে মোসলমানেরা শোধ তুলতাছে, এইডা কিন্তু আমাগো পছন্দ না।”

‘দ্যাশ থেকে দেশে’ স্মৃতিকথা হিসেবে সার্থক ঠিকই কিন্তু বইটিকে দেশভাগ বিষয়ক স্মৃতি আলেখ্যগুলোর তালিকায় স্থান দেওয়া উচিত কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সম্পূর্ণ বইটি তিনটি আলাদা খণ্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে দেশভাগ ও দেশত্যাগের যাবতীয় স্মৃতি সংকলিত হয়েছে দ্বিতীয় খণ্ডে যার নাম ‘দ্যাশ থেকে দেশে আসার বৃত্তান্ত’। এই খণ্ডটি মোট দুশো পাতার বইতে দখল করেছে মাত্র ছাব্বিশ পৃষ্ঠা। অর্থাৎ দেশভাগ এই লেখিকাকে শৈশবে যতটা আলোড়িত করেছিল পরবর্তীকালে তার রেশ আর তেমন তীব্র ছিল না। এই বইটি আরো এক বিচারে পূর্বে আলোচিত দুটি বইয়ের থেকে আলাদা। তা হলো, আগের দুটি বই পড়লে বোঝা যায় তাদের লেখক-লেখিকাদের মনে দেশভাগজনিত বিষণ্ণতা একটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। কিন্তু আলোচ্য বইয়ের লেখিকা সীমা দাশ কলকাতায় এসে আরো বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন এবং আরো অনেক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, যেগুলো তাঁর দেশত্যাগের বেদনা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। সম্ভবত সেটাই বাঞ্ছনীয়। তাই অতীতচারণ করতে গিয়ে তিনি পূর্ববাংলার জীবনকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, কলকাতার গণনাট্য সংঘ, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস ইত্যাদি স্বনামধন্য চরিত্রও সেখানে সমমর্যাদা পেয়েছে। দ্যাশ থেকে দেশে তাই আদ্যোপান্ত একটি স্মৃতিকথা হলেও পুরোপুরি দেশভাগ বিষয়ক স্মৃতিকথা নয়। আরো একটি বিষয় অবাক করার মতো। লেখক যতদিন পূর্ববাংলায় ছিলেন (শৈশব), কোনো মুসলমান চরিত্র তাঁর সেই শৈশবের স্মৃতিতে নেই। সীমা দাশের জন্ম পটুয়াখালীতে ১৯৩৮ সালে। বাংলার বিভাজনপূর্ব রাজনীতিতে পটুয়াখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। তার এক বছর আগে ১৯৩৭ সালে এই পটুয়াখালী আসনে মুসলিম লিগ নেতা ঢাকার নবাব নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করেছিলেন সদ্য গঠিত কৃষক প্রজাপার্টির নেতা ফজলুল হক। শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতের দৃষ্টি ছিল পটুয়াখালীর দিকে। এই নির্বাচনে জিতে হক সাহেব বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। শুধু তাই নয়, তাঁর জয় প্রমাণ করে দিয়েছিল বাংলার রাজনীতিতে নেতা নির্বাচন বা বর্জনের ক্ষেত্রে কৃষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর অ্যান্ডারসন নিজে নাজিমুদ্দিনের হয়ে প্রচার করে তাঁকে জেতাতে পারেননি। এসব ঘটনা সীমা দাশের বাবা, কাকা বা পড়শিজনদের মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলেছিল তা এই স্মৃতিকথাটি পড়লে বোঝা যায় না। লেখিকার জন্ম একটি সংগীতমগ্ন, সংস্কৃতিমনা পরিবারে। বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর চর্চা, প্রয়োগরীতি ইত্যাদি এই স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে বারবার। আবার লেখিকা ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার স্মৃতি উল্লেখ করেছেন, “মাঝরাতে হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসছে কোলাহল চিৎকার—আল্লা হো আকবার ধ্বনি।… আমাদের পাড়াটায় সবাই হিন্দু।… দূর থেকে তারা দেখতে পায় আগুন যেন আকাশ ছুঁতে চলেছে। এরই মধ্যে শোনা যায় দুরকম ধ্বনি—‘বন্দে মাতরম’, ‘আল্লা হো আকবর’… বাড়ির উঠোনে তখনও তীর, ধনুক, লাঠি, ইট, বালি পড়ে। এই আগুন জানিয়ে গেল ভেতরে ভেতরে হিন্দু মুসলমান একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে যৌনতা

এই দাঙ্গার পর তাঁদের পরিবারটি আর বেশিদিন পূর্ববাংলায় থাকেনি। বোঝাই যায় ওই দাঙ্গা সেই শান্তিপ্রিয়, সংগীতপ্রেমী পরিবারটির অন্তঃস্থলে বিরাট ধাক্কা দিয়েছিল, পুড়ে গিয়েছিল তাঁদের দোকানটিও। সীমা দাশের বাবা তখন থেকেই কলকাতায় চাকরির সন্ধান শুরু করে দেন। এরপর আসে দেশত্যাগের গল্প। তার আগে অবশ্য লেখিকা স্বাধীনতা ও দেশভাগের দিনটি বর্ণনা করেছেন এভাবে, “স্বাধীনতার দিন বাড়িতে দুরকমের পতাকা টাঙানো হয়েছিল। একটা পাকিস্তানের অন্যটা কংগ্রেসের।… মুসলমান পাড়ার তুলনায় এ সাজ জৌলুসহীন, ওদের ওখানে কোনো কংগ্রেসের পতাকা নেই। কেবল শ’য়ে শ’য়ে জিন্নাহর ছবি। দূরে মুসলমান পাড়ায় আমরা ছোটরা কয়েকজন হাঁটতে হাঁটতে গেছি। ওরা কী করছে দেখি গে। ওদের টানাটানি, আপ্যায়নের ঠেলায় আমরা তো অস্থির। প্যাকেট প্যাকেট মিঠাই, তবক দেওয়া সব মুসলমানি মিষ্টি। তখন ছোট হলেও মনে সুখ পাচ্ছি না। যেন হেরে গেছি আমরা।”—এখানে লেখকের সরল সত্য ভাষণে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। প্রথমত, দেশভাগ হওয়ামাত্রই যে মুসলিমরা হিন্দু বিতাড়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তা নয়। দুটি আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত হলেও বিদ্বেষ তখনও ছিল না। যা এসেছে পরে, বিভিন্ন সামাজিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। দ্বিতীয়ত, লেখক মনে সুখ পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁরা হেরে গিয়েছেন। কেন এই পরাজয় বোধ? এই বোধের উত্তর কোনো স্মৃতিকথাতেই নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে এই পরাজয়ের পীড়নই ছিল অন্তত প্রথম পর্যায়ে দেশত্যাগের আসল কার্যকারণ। এই দেশত্যাগের বিষণ্ণতা সবার জন্যই একরকম, “সবার চোখে জল। কেউ বলে আবার আইস্যো। কেউ বলে আমাদের ভুলবা না তো। গিয়াই পত্র দিও। সবার কান্না দেখে মনটা হু হু করে ওঠে।” পরে আবার, “সব ছবি হয়ে যাচ্ছে, স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে,… ওই তো দূরে স্টিমার ঘাট, ওই তো পাবলিক থিয়েটার হল, ওই তো বাজার, ওই আদালত, পোস্টাপিস, কালীবাড়ি, ওই তো ওখানে সতীন সেনের বাড়ি।… আমরা আবার আসুম। মায়ের চোখেও জল।”

এই তিনটি স্মৃতিকথারই লেখক-লেখিকারা হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি এবং তিনটি রচনারই মূল সুর একটাই, দেশভাগ না হলেই ভালো হতো। কিন্তু একথা তো ঠিক, পূর্ববাংলার দরিদ্র মুসলিম কৃষকরা সর্বাত্মঃকরণে দেশভাগ চেয়েছিলেন। পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের তাঁদের কাছে কোনো তাৎপর্য ছিল না। তাঁরা ভেবেছিলেন, পাকিস্তান হলে বুঝি জমিদারি উচ্ছেদ ও তাঁদের দারিদ্র্যের অবসান হবে। অর্থাৎ কৃষকদের বিদ্রোহের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানপ্রাপ্তি। এর জন্য কৃষকদের দায়ী করা যায় না, দায়ী হলো তারা, যারা কৃষকদের সামনে সেই মরীচিকা তুলে ধরেছিল। দেশভাগ হলো আসলে সেই মরীচিকার কাহিনী আর ওপরে বর্ণিত স্মৃতিকথাগুলো হলো তার উপকাহিনী বা শাখা-প্রশাখামাত্র। আমাদের প্রার্থনা ও লক্ষ্য হওয়া উচিত এহেন মরীচিকার মায়াজালে জড়িয়ে হিন্দু বা মুসলিমরা যেন আর বিপথগামী না হয়। (তথ্যসূত্র: তিনটি স্মৃতিকথা ও দেশভাগ: গৌতম রায়)

দেশভাগের কারণ খুঁজেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকেও ভারত থেকে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। তাঁর বন্ধু জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেতে হয়েছে। দুই বন্ধুর বিচ্ছেদও লেখায় এসেছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেশভাগের কারণ খুঁজেছেন তার লেখায়। তার একটি লেখার শিরোনাম, ‘১৯৪৭ ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ’। তার বিশ্লেষণ এমন:
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি ট্র্যাজেডি খুবই ভয়ঙ্কর: একটি ঘটেছে ১৮৫৭ সালে, আরেকটি ১৯৪৭-এ। একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। মাঝখানে আছে স্বাধীনতাসংগ্রামের মহাকাব্য, কিন্তু সে সংগ্রামের পরিণতি মহাকাব্যিক হয়নি, হয়েছে ট্র্যাজিক। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল, আপাতদৃষ্টিতে তা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং পুরোপুরি অকল্পনীয়। কেউ ভাবেনি এমনটি ঘটবে। স্বাধীনতার নামে যে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস পাওয়া যাবে, এবং ভারতবর্ষ যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো ডমিনিয়ন হয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরেই রয়ে যাবে, এটা মোটামুটি জানা ছিল। কংগ্রেস ও লিগ এ ব্যাপারে সম্মত ছিল; কিন্তু দেশভাগ ঘটবে, বাংলা ও পাঞ্জাব দু-টুকরো হয়ে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হবে—এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

মুসলিম লীগ যা চেয়েছিল, সেটা হলো মুসলমানদের অন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি, তার জন্য যে দেশভাগ প্রয়োজন হবে, এটা তারা ভাবেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি ঢিলেঢালা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি ভৌগোলিক গ্রুপ তৈরির ধারণাটাকে গ্রহণ করেছিল, তার পেছনে এই বোধ কার্যকর ছিল, এর বেশি পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি হয়নি। কারণ তাদের বক্তব্য ছিল, ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ; এবং তাকে কোনো রকমেই বিভাজিত করা চলবে না। তবে দুই পক্ষই আবার এই ব্যাপারে একমত ছিল যে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যাবে না, রাষ্ট্র থাকবে এককেন্দ্রিক; বিরোধটা ছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা কিভাবে ভাগ করা যায়, তা নিয়ে। জওহরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেউই প্রাদেশিক নেতা হতে চাননি, চেয়েছেন সর্বভারতীয় কর্তা হবেন।

আরো পড়ুন ➥ চে, বিপ্লব ও বাজার

ওই যে এক জাতির দেশ বলে দাবি করা—এর ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ। কারণ এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। আসলে ভারতবর্ষ তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম নয়, ভাষা। সে হিসাবে ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষে একটি-দুটিও নয়, সতেরোটি জাতি ছিল। ভারতবর্ষের মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। কিন্তু কংগ্রেস ও লিগ কেউই শ্রেণি সমস্যার সমাধান চায়নি। দুই দলই ছিল বিত্তবানদের সংগঠন। তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকেরা তাদের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে, এবং তারা গদিতে বসে পড়ে ঠিক সেভাবেই দেশ শাসন করবে, যেভাবে ইংরেজরা করেছে। শাসন মানে আগের মতোই দাঁড়াবে শোষণ। শ্রেণিবিভাজনের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল; সেটা কংগ্রেস ও লিগ কেউ চায়নি; ইংরেজরা তো চায়ইনি। ইংরেজরা চেয়েছে তাদের আনুকূল্যে তৈরি বিত্তবান তাঁবেদার শ্রেণির হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাবে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে।

দেশভাগ হয়েছে এই তিন পক্ষের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। মেহনতি মানুষ এর ধারেকাছেও ছিল না। বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কংগ্রেস ও লিগের নেতাদের দর-কষাকষি চলেছে। জিন্নাহ ও নেহরুর সঙ্গে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নেহরুর সঙ্গে তো সম্পর্কটা বন্ধুত্বের পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। এই বন্ধুত্ব বড়লাটের স্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নেহরু-জিন্নাহর কলহটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার মতো। বাগ্বিতণ্ডা চলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ভাই-ই মেনে নিলেন যে ক্ষমতার ভাগটা দেশভাগ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে গেল।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জ্বলে নেভে ফ্যাসিস্ট ও বিপ্লবীর চরিত্র

ক্ষতি বিত্তবানদের হয়নি। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। ঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, তবে ধারণা করা হয়, ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষতিটা অপূরণীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব করা যায়নি, যাবেও না। অথচ মূল যে সমস্যা—যেটা হলো শ্রেণিবিভাজনের—তার কোনো সমাধান ঘটল না। ধনী-গরিবের পার্থক্য আগের মতোই রয়ে গেল। উন্নতি যা হলো তা বিত্তবানদের, সেই উন্নতির বাহক হয়ে থাকল মেহনতি মানুষ, আগে যেমন ছিল। শ্রেণি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমাজতন্ত্রীরা করেছিলেন। তাঁরা সংগ্রামে ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদী দলের হাতে। যারা ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত, এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী। বস্তুত দেশভাগে তড়িঘড়ি সম্মত হওয়ার পেছনে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তো ছিলই, আরো বড় করে ছিল সমাজবিপ্লবের ভয়। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার একটা মীমাংসা সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটলে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে—ছালা তো যাবেই, আমও হাতছাড়া হবে। অতএব যা পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ভালো। অস্পষ্টভাবে হলেও নেহরু-জিন্নাহরা জানতেন, ইংরেজের সঙ্গে দর-কষাকষি সম্ভব, কিন্তু মেহনতিরা উঠে এলে কোনো আলাপই চলবে না। তাঁরা জানতেন, ইংরেজ তাঁদের শত্রু বটে, তবে আরো বড় শত্রু হচ্ছে স্বদেশি মেহনতি মানুষ। এর প্রমাণ সুন্দরভাবে পাওয়া গেছে ‘স্বাধীনতা’র পরে। ভারতে কংগ্রেসবিরোধী মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হয়নি, যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি লিগবিরোধী কংগ্রেস; কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি।

শ্রেণি সমস্যা আড়াল করার জন্যই কিন্তু জাতি সমস্যাকে প্রধান করে তোলা হয়েছিল। এবং জাতীয়তার মূল ভিত্তি যে ভাষা, সেটাকে অস্বীকার করে ধর্মকে নিয়ে আসা হয়েছিল সামনে। ফলে সম্প্রদায় জাতি হয়ে গেল, জাতি রয়ে গেল আড়ালে। কংগ্রেস বলল, দেশটা এক জাতির, লিগ বলল, সেটা সত্য নয়, দেশ দুই জাতির। এক ও দুইয়ের হট্টগোলে সতের জাতি হারিয়ে গেল। কমিউনিস্ট পার্টি সতের জাতির কথা বলেছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও লিগের যৌথ তৎপরতার কারণ ওই সত্যটিকে সামনে নিয়ে আসতে পারেনি।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;